Tuesday 14 August 2018

তুর্কি যুগে আরবী সাহিত্যচর্চা


তুর্কি যুগে আরবী সাহিত্যচর্চা
কাজী মহঃ মাকীন

তুর্কি যুগের আরবী সাহিত্য সম্পর্কে জানার আগে আরবী সাহিত্যের যুগ বিভাজনের মধ্যে তুর্কি যুগের অবস্থানটা জেনে নেওয়া দরকার। মূল প্রসঙ্গে আসার আগে, মতানৈক্যের সম্ভাবনা সহ নীচে এক পলকে যুগ বিভাজনটা তুলে ধরা হল
 ইসলামপূর্ব যুগঃ আনুমানিক ৫০০- ৬২২ খ্রীঃ
 ইসলামী যুগঃ ৬২২- ৬৬১ খ্রীঃ
 উমাইয়া যুগঃ ৬৬১- ৭৫০ খ্রীঃ
 আব্বাসী যুগঃ ৭৫০- ১২৫৮ খ্রীঃ
 স্পেনীয় যুগঃ ৭৫০- ১৪৯২ খ্রীঃ
 মামলুক যুগঃ ১২৫৮- ১৫১৭ খ্রীঃ
 তুর্কি যুগঃ ১৫১৭- ১৭৯৮ খ্রীঃ
 আধুনিক যুগঃ ১৭৯৮- চলমান

উল্লেখ্য যে, প্রথম চারটি যুগে সাহিত্য চর্চা আরব উপদ্বীপ কেন্দ্রিক ছিল। পঞ্চমটি ছিল ইউরোপের স্পেনে গড়ে ওঠা আব্বাসী যুগের সমান্তরালে বয়ে চলা। শেষ তিনটি ক্ষেত্রে এর অভিমুখ আফ্রিকার মিশর কেন্দ্রিক হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে মামলুক ও তুর্কি যুগকে একত্রে অনেক ইতিহাসবিদ সাহিত্যের পতনের যুগ বলে অভিহিত করেছেন।       
যে আরবী সাহিত্য ও আরবীয় জ্ঞানচর্চা আব্বাসী খিলাফতে সমৃদ্ধির চরম শিখরে গিয়েছিল তার সঙ্গে কী এমন ঘটেছিল যে মামলুক ও তুর্কি যুগে তার খ্যাতির তথা চর্চার শিখা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল? খুব সংক্ষেপে আমরা ইবনে কাসীরের আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ গ্রন্থের ভূমিকার নির্যাস লক্ষ্য করলে তার কারণ আংশিক অবহিত হব।
৬০০ বছর ধরে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যের সর্বস্তরে সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ ১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এসে মাত্র ছদিনে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের হাতে কেবল পরাজিত নয়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাদের নির্বিচার লুটপাট, গণহত্যা বাগদাদকে বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করে। বায়তুল হিকমাহ এর মত জ্ঞানচর্চার বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য সাহিত্য সম্ভার। ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে বিধ্বংসী হালাকু খান। মোঙ্গল-তাতার জাতি বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল সেই সময়।
এইরকম পরিস্থিতিতেই বহু সাহিত্যিক, জ্ঞানপিপাসু প্রানভয়ে বাগদাদ ত্যাগ করে। যাদের একটা বৃহৎ অংশ ক্রমশ মিশর অভিমুখে পা বাড়ায়। আরবী সাহিত্য চর্চা মিশর অভিমুখী হওয়ার সেটাই ছিল সূচনা। চোখের সামনে নিদারুণ ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ, ভয়, অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে সাহিত্যচর্চার বাতাবরণ সুদূরপরাহত ছিল। একটা দীর্ঘ সময় সাহিত্য চর্চা ছিল ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটিসম। মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যকে আরব দুনিয়ার শেষ রাজবংশ বলা যায়। সূচনা হয় মূলত ১২৪৯ খ্রীষ্টাব্দে। ১২৬০ সালে তাদের হাতেই আইন জালুতেরযুদ্ধে প্রতিহত ও পরাজিত হয় মিশর দখলে লোলুপ ১২৫৮ সালে বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকু খান। ক্রমশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এইরূপ পরিস্থিতিতে সাহিত্যচর্চা কিছু সময়ের জন্য স্তিমিত থাকলেও এই যুগেই এমন কিছু ধর্মতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ জন্ম নেন- যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ইবনে খাল্লিকান, ইবনে খালদুন, ইবনে হিশাম, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইবনু হাজার আসকালানী, আত-তাফতাযানী, আব্দুল কাহির জুরজানী, আয-যাহাবী, ইবনু তিকতাকা, ফিরোযাবাদী, আবুল ফিদা, ইবনে মানযুর, ইবন বতুতা, বূসীরী, সফীউদ্দীন হিল্লী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব চর্চাও কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল মামলুক যুগে।
এবার চলে আসি তুর্কি যুগে।
অনারব তুর্কি সুলতান প্রথম সেলীম ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে  মিশরীয় মামলুকদের পরাজিত করে তুর্কি শাসনের সূচনা করে। অভাবিত ভাবে মিশরবাসী এক চরম নির্যাতনের সাক্ষী হয়। শাওক্বী দ্বায়েফের তারীখুল আদাবিল আরাবীথেকে জানতে পারি, মিশর জয়ের পর আটমাস সেখানে অবস্থানপূর্বক তাদের ধনরত্ন; প্রাসাদ, গ্রন্থাগার, মসজিদে রক্ষিত গ্রন্থসমূহ; শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি লুট করা হয়। লেখ, সাহিত্যিক, ধর্মতত্ত্ববিদদের চরম হেনস্থা করা হয়। অনেকের মতে, বহু জ্ঞানীগুণী ও পুস্তকরাজির সলিলসমাধি ঘটিয়েছিল তারা। এভাবে অনারব তুর্কিরা আরবী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। যা আগামী তুর্কি শাসনকাল জুড়ে বিরাজ করে। কারণ তার প্রশাসনিক ভাষা রূপে তুর্কি ভাষার আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আরবী সাহিত্য চর্চায় ভাটা পড়ে। আরবী ভাষআকে দাবিয়ে রাখা, আরবী ভাষীর উপর অত্যাচারএই রকম মানসিক অবস্থায় সৃষ্টিশীল রচনার উৎপাদন নিতান্তই কষ্টকল্পনা ছিল।
তবে যে জাতির ধর্মীয় ভাষা, দৈনন্দিন উপাসনার ভাষা আরবী, যে জাতির সাহিত্যচর্চা সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ততারা বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম যে করবেই এ আর আশ্চর্য কী! আন-নাবলুসী, যায়নুদ্দীন হামিদি, ইবনে মাতূক, আশ-শায়বানী, আল-মাক্কারী, হাজী খলীফা, ইবনে কাসীর, আল-খাফাজী প্রমুখ একাধারে হাদীস, তফসীর, ফেকাহ, সাহিত্য, ইতিহাস, ভ্রমণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
অতএব, সামগ্রিকভাবে দেখলে এই পাঁচ শতাধিক বৎসরকাল একেবারে যে সাহিত্য বা জ্ঞানচর্চাহীনতায় নিমজ্জিত ছিল তা আদৌ নয়। বরং প্রতিভা যে চাপা থাকে না তারই যেন আদর্শ উদাহরণ বয়ে চলে এই যুগ। তাই একে পতনের যুগ না বলে বলা ভাল স্থবিরতার যুগ।

[লেখকের আবেদনঃ উপরোক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমরা একজন করে একটা সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখলে সকলে উপকৃত হব।]

গ্রন্থপঞ্জীঃ
১) তারীখুল আদাবিল আরাবী- আ. হা. যাইয়াত
২) তারীখুল আদাবিল আরাবী- শাওকি দ্বায়েফ
৩) আল বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ- ইবনে কাসীর
৪) আরবী সাহিত্যের ইতিবৃত্ত- ড. মু. শহীদুল্লাহ

No comments:

Post a Comment