Friday 19 March 2021

বদিউর রহমানঃ একটি অব্যক্ত বেদনা


একটা অব্যক্ত বেদনা
বদিউর রহমান
 
কখনো-সখনো এক একটা বেদনা বুকের মধ্যে এমন চাড়া দিয়ে ওঠে যা ভাষায় ব্যক্ত করা প্রায় দুঃসাধ্য। অনেক সময় ইচ্ছে হয় কোনো বিশেষ মানুষের সঙ্গে দু-দণ্ড কথা বলে একটু হাল্কা হই। ইদানিং মুঠো ফোনের দৌলতে সেই সুবিধাটুকু থাকায় সে সমস্যা অনেকখানি মিটে যায়। কিন্তু কোন কারণে যোগাযোগের নাম্বারটা হারিয়ে গেলে সেই ইচ্ছাটা পূরণ করা দূরুহ হয়ে পড়ে। এমনটাই ঘটেছে আমার এক বিশেষ জনের ক্ষেত্রে। স্বীকার করতে বাধা নেই তার ফোন নাম্বারটা আমিই একদিন মিটিয়ে দিই। তার কারণ হলো মাঝে মধ্যে গায়ে পড়ে আমি তাকে ফোন করে কথা বলতাম। শেষবার কথা বলার পর আমার অকস্মাৎ মনে হয়েছিল যে আমিই তো তাকে ফোন করি সে তো ভুলেও কখনও আমার সঙ্গে কথা বলে না। হঠাৎ ওই কথাটা মাথায় আসতে আমার নিজের মনে হলো সে হয়তো আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই রকম একটা কথা মনে আসলে আমার একটু অভিমান হলো আর সে জন্যে তার ফোন নাম্বারটা মুছে দিই। অবশ্য ক্ষীণ আশা ছিল যে ফোনের ডায়রিতে তার নাম্বারটা নিশ্চয় লেখা আছে। লকডাউন এর পর থেকে তার কথা প্রায়শ মনে হয়। দু-চারবার এই ভেবে তাকে ফোন করিনি যে তো কখনো আমাকে ফোন করে না। থাক আমিও যোগাযোগ করব না। কিন্তু দু-মাস যাবৎ তার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করতে থাকে। তিন তিনটে ফোনের ডায়রির পাতা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার নাম নাম্বারটা পাইনা। তাঁর বাড়ির আশে পাশের মানুষ-জনের মধ্যে যাদের পেলাম তারা বর্তমানে সকলে দেশ-গ্রাম ছেড়ে কোলকাতায় বসবাস করেন। যাকে আমার প্রয়োজন তার হদিশ এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। মাস খানেক পূর্বে পোষ্ট অফিস থেকে ইনল্যাণ্ড লেটার কিনে তাকে চিঠি লিখলাম। চিঠিতে আমার ফোন নাম্বার দিলাম। লেখা শেষে তার ঠিকানা লিখতে গিয়ে সঠিক পিন কোড লেখার জন্য দু-চারজনকে জিজ্ঞাসা করে বিফল মনোরথ হই। শেষে এক ছাত্র গুগল সার্চ করে তার পিনকোড জানালো। যথারীতি চিঠি পোষ্ট করা হলো। পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে উত্তর পাব অথবা ফোনে তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু আজ প্রায় এক মাস হয়ে গেলো তার তরফ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। মনস্থির করেছি আবার একটা চিঠি দেব। এমনও আশা করেছিলাম যে প্রাপকের দেখা না পেলে পিওন হয়তো প্রেরকের ঠিকানায় চিঠিটা ফেরত দেবে। সেটা ফেরতও আসেনি
 
যদিও আমি নিরাশ হয়েছি তা সত্ত্বেও তাকে আবার চিঠি দেব। সে চিঠির উত্তর না দিক অন্ততঃপক্ষে আমার সঙ্গে কথা তো বলবে আমার কাঙ্খিত সেই মানুষটা কোন বিখ্যাত স্বনামধন্য মানুষ না হলেও আমার জীবনের অনেক কিছু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সে আর কেউ নয়, সে হল শফিকুল আলম আজাদ কলেজে পড়ার সময় সে ছিল আমার এক বছরের জুনিয়র। আমি পড়তাম আরবী আর সে ইংরেজি। বেকার হোস্টেলের দোতলায় দক্ষিণমুখি দুটো রুমে দুজন থাকতাম। অনার্সের দ্বিতীয় বৎসরে পড়ার সময় একদিন বলল তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিয়েতে অনিবার্যভাবে আমাকে যেতে হবে। বি.. পাশ করার আগেই একটা ছাত্র বিয়ের পিঁড়িতে বসবে মানতে পারিনি। সে আমার উপদেশের কোন তোয়াক্কা না করে বিয়ের দিনক্ষণ জানিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ (বলা ভাল আব্দার) করে যে আমাকে ওই অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। আমি একটা শর্তে রাজি হয়ে তাকে বলি ‘তুমি যে তোমাদের গ্রামের বগা ডাকাতের কথা কয়েকবার শুনিয়েছ তাকে দেখাতে পারবে?” সে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়। বিয়ে ছাড়াও মুখ্যতঃ জলজ্যান্ত দুর্ধষ্য এক ডাকাত দেখার লোভে তার বিয়ের আগের দিন বিকালে তাদের গ্রাম ইচ্ছু-ভাগড়া যাই। রাস্তার ধারে ওদের কাপড়ের দোকানে আমার থাকার সুবন্দোবস্ত করেছিল। সেখানে পৌঁছানোর পর পরই শফিককে বগা ডাকাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সে বলল কথাটা মনে আছে। বগাকে ঠিক দেখাব।তারপর শুনলাম যেহেতু তার এক চাচতো বোনের সঙ্গে বিয়ে এবং তাদের যৌথ পরিবার এবং একই বাড়িতে বসবাস তাই সন্ধ্যের পর শফিককে পালকি করে গ্রাম ঘোরানো হবে। সেই অভিনব ব্যাপারে খুব পুলকিত হয়েছিলাম।
 
ফাল্গুন মাসের আগুন সন্ধ্যায় শফিক পাল্কিতে চড়ে বসল। বরের ঘাড় পর্যন্ত মোটা করে পাউডারের প্রলেপ। সিল্কের পাঞ্জাবীর খোলা বোতাম দিয়ে উঁকি মারছিল একটা সোনার চেন। ছোট-খাট স্থুল মানুষটা পাল্কি জুড়ে বসে আমাকেও বলেছিল পাল্কিটায় বসতে। বেশ কয়েকটা হ্যাচাক লাইট নিয়ে পাল্কির আগে আগে চলল কয়েকজন। তাদের পিছনে ছিল তাসা-পার্টি। পাল্কি কিছুদুর যায় আর এক একটা বাড়ির বয়স্কা মহিলাদের আব্দারে দাঁড়াতে হয়। ওই মহিলারা পাল্কির কাছে এসে হাতের হ্যারিকেন তুলে শফিককে দেখে মাথায় হাত দিয়ে দোওয়া করে। হঠাৎ শফিক আমাকে ডেকে একজনকে দেখাল। লম্বা ছিপছিপে চেহারা। ক্ষিপ্র পদচালনা। অন্ধকারেও মনে হল চিতাবাঘের চোখের চাহনি। সেদিনকার গ্রাম ঘোরার শেষ পর্যন্ত সাদা ধুতি কাপড় পরা সেই কুখ্যাত মানুষটাই হয়ে উঠল আমার বিশেষ লক্ষণীয়।
 
বিয়ের কিছুদিন পর শফিক হোস্টেলে চলে এল। তৃতীয় বৎসরের তিনটে পেপার পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার চিকেন পক্স লে বাকি রীক্ষাগুলো বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে দেওয়ার সময় ছোঁয়াচে অসুখকে ভয় না করে শফিক আমাকে সঙ্গ দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করে। সেদিক থেকে আমি তার কাছে চিরঋণি। এম.. পড়ার সময় কারমাইকেল হোস্টেলে সে আমার রুমমেট হয়। তার মুখ থেকে ইংরেজি বিভাগের বিভিন্ন স্যার ম্যাডামদের পড়ানর কথা শুনতাম। অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যের কিংলিয়ার পড়ানো অধ্যাপক পি-লালের ইলিয়ট পড়ানর কথা সে প্রায় শোনাত। আরও শোনাত শান্তাদি শোভনাদি, অধ্যাপক আর কে সেন প্রমুখদের কথা। বার্নার্ড , মারলো থেকে শেক্সপীয়ার ইত্যাদির কত কথা শুনতাম ওর কাছ থেকে ওদের ক্লাসের এক বিবাহিত ছাত্রীকে ওরা বৌদি বলত। গুটিকয়েক ছাত্রের সঙ্গে তার অভব্যতার কথা বলার সময় ক্ষোভে ফেটে পড়ত শফিক ওর বদৌলতে তার এক উজ্জ্বল সহপাঠি প্রসূনের সঙ্গে আলাপ হয়। তার খালি জিব্রানের উপর অগাধ পড়াশুনা দেখে অবাক হতাম। শফিকের প্রিয় পাঠ্য ছিল ট্রাজেডি কিন্তু সিনেমার বেলায় তার পছন্দ ছিল কমেডি। বলত সিনেমা দেখি একটু আনন্দ পাওয়ার জন্যে মনটাকে হাল্কা করার জন্যে পয়সা খরচ করে বিয়োগান্তিক ছবি দেখে মনকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না।যখন তার মেজাজটা বেশ ফুরফুরে থাকত তখন হিন্দি সিনেমার একটা গানের কলি নাচ মেরে বুলবুল তুঝে পায়সয়া মিলেগা”-টা গেয়ে যেত।
 
কারমাইকেল হোস্টেলে আট নম্বর রুমে সে আমার রুম মেট। অন্য একজন এক যুগ ধরে রুমে ছিলেন। তিনি হলেন সকলের দাদা ইকবাল ফাইয সাহেব। শফিক প্রতিমাসে বাড়ি থেকে ফিরে আমাকে তার হাঁটুটা ছড়ে যাওয়া দেখাত। ইকবাল সাহেব হা হা করে হেসে বলতেন বিবাহিত মানুষ। বাড়ি যাওয়া কমাও। হাঁটুতে আঘাত হবে না।সে একবার একটা ওয়ার্লড ম্যাপ কিনে দেওয়ালে লাগাচ্ছিল। ইকবাল সাহেব কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞাসা করেন ওটা কি হবে?” উত্তরে সে বলে ইংল্যাণ্ডের অবস্থানটা দেখব।ইকবাল সাহেব দুষ্টুমি করে বলেন শেক্সপিয়ারের সমাধিস্থলটা কোথায়?” সে ষ্ট্রাটফোর্ড খুঁজতে গিয়ে বার বার চশমার কাঁচ মুছতে থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি গ্রীনল্যান্ডটা কোথায়?” সে যখন সেটা দেখাল তখন জিজ্ঞাসা করি হোয়াটল্যান্ড দেখাও?” সে তৎক্ষণাৎ হোয়াটল্যান্ড খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অত সাদা-সিধে সরল মনের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। কখনো রাগ করতে দেখিনি। তার সম্পর্কে ছোট-খাট কত কথা মনে পড়ে।
 
এম পাশ করার পর রিসার্চ করার সময় হস্টেল ছাড়তে বাধ্য হই। প্রায় এক বৎসর পর বিয়ে করে দিল্লি চলে গেলে শফিকের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। দিল্লি ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় ওর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ হয়। ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে। হঠাৎ বলে বসি তোমাদের পুকুরে মাছ ধরা যাবে কি?” এক কথায় সে রাজি হলে সদলবলে তার বাড়ি গিয়ে অত্যাচার করে আসি।
 
বহুদিন পর একবার পাণ্ডুয়ায় আমার কাছে এসেছিল। আমি মাঝে মধ্যে ফোন করে কথা বলতাম। কখনো আমাকে ফোন করেছে বলে মনে পড়ে না। বেশ কিছুদিন থেকে তার কথা ভিষণ মনে হচ্ছে। অভিমান করে তার ফোন নাম্বারটা মুছে দিয়ে এখন খুব আফসোস হচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে তত একটা অব্যক্ত বেদনা গলার কাছে দলা পাকিয়ে বসছে। করোনাকালে প্রায় ঘর বন্দী ও আবদ্ধ জীবন-যাপনে বাধ্য হয়ে উঠে আর তার সঙ্গে দুটো কথা বলতে না পেরে কেন জানি না খুব কষ্ট হচ্ছে। এই মৃত্যুমিছিলে দিনগুলিতে কত প্রিয়জনকে হারালাম কতজনের প্রিয়জনেরা শুধু সংখ্যা হয়ে গেল। এই শোকাচ্ছন্ন পৃথিবীতে কে কতদিন আছি সে শঙ্কায় সকলের মত আমার দিন কাটছে। কিন্তু শফিক তুমি আমাকে ফোন না করলেও ভাল থেকো। আমার চিঠির উত্তর না দিলেও তুমি সুস্থ্য থেকো। সর্বান্তকরণে তোমার মঙ্গল কামনা করি। সকলের কাছে সহমর্মিতার অনুরোধ রইল।
 
[আবার একটা চিঠি মার্চের শুরুতে লিখেছি এখনো (১৭-০৩-২০২১) উত্তর পাইনি বুকটা দুরুদুরু করছে একটা কবিতার পংক্তি মনে পড়ছে “Tell them I came, but nobody answered.” এমনটা যেন না হয়]
 
২০-০২-২০২১
সল্টলেক, কোলকাতা

4 comments:

  1. অনবদ্য, অসাধারণ!!!

    ReplyDelete
  2. আপনার ইচ্ছা পূরণ হোক এই কামনা করি

    ReplyDelete
  3. আপনার গদ্য খুব সুন্দর। শেষদিকে মনটা ভারি হয়ে গেল। শফিক সাহেবকে আপনি খুঁজে পান এ কামনা করছি ।

    ReplyDelete