যদি কোন একটা প্রথা যুগ যুগ ধরে কোন অঞ্চলের মুসলিম সমাজে অব্যাহত থাকে, তার অর্থ এই নয় যে ওই প্রথাটি শরীয়ত সম্মত বা তার পক্ষে কোনো প্রমাণ রয়েছে। বরং একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে তার পক্ষে দলীল খোঁজা আমাদের কর্তব্য। তাছাড়া এক্ষেত্রে ইসলামের যাবতীয় বিষয় দু’ প্রকার— প্রথমটি হল আকীদাহ বা বিশ্বাস সংক্রান্ত আর দ্বিতীয়টি আমল বা কাজ অর্থাৎ ইবাদত। আর কোনো আমল শরীয়ত সম্মত হওয়ার জন্য তা অবশ্যই কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস-এর কোনো একটি দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হাদিস সংকলনসমূহের সকল হাদিসই সাহীহ বা বিশুদ্ধ নয়। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইব্নু হাজার, ইমামা জাহাবি ও তাঁদের উত্তরসূরিরা যুগ যুগ ধরে গবেষণা করে নির্ধারণ করেছেন বর্ণনা সূত্রের নিরিখে কোন হাদিসটি সহীহ, কোনটি যায়ীফ (দুর্বল) এবং কোনটি মাওজু (জাল)। তাই যেকোনো আমলের পক্ষে বিশুদ্ধ হাদিস খোঁজাও আমাদের কর্তব্য।
শবে বরাত ও লায়লাতুল্ বারাআত-এর অর্থ
কুরআনে শবে বরাতের উল্লেখ
এক শ্রেণীর ওলামা ও বিদ্বানগণ উল্লেখিত বরকতময় রজনী বলতে ১৫ই শা’বানের রাতকে নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু আমরা যদি আয়াতগুলোর অর্থের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে খুব সহজেই অনুমেয় যে এটা ১৫ই শা’বানের রাত নয়। কেননা মহান আল্লাহ্ এখানে ওই বরকতময় রাতে কুরআন অবতীর্ণ করার কথা উল্লেখ করছেন। আর পবিত্র কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে এ কথা সবার জানা। কুরআনেই রয়েছে, “রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল-কুরআন।” [সূরা আল্-বাকারাহ্ ১৮৫] এমনকি রমজান মাসের কোন্ রাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে তারও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, “আমি এই মহাগ্রন্থ আল্-কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আল্-কাদ্র-এর রাতে। তুমি আল্-কাদ্র-এর রাত সম্পর্কে কী জানো? আল্-কাদ্র এর এই রাত এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা (অর্থাৎ ফেরেশ্তাগণ) ও রূহ (অর্থাৎ জিব্রীল আঃ) অবতীর্ণ হন তাঁদের প্রভুর নির্দেশে। এ রাতে শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর (ঊষার উদয়) পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” [সূরা আল্-কাদর ১-৫] আর কাদ্র-এর রাত যে রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো একটা বিজোড় রাত, এ বিষয়ে অসংখ্য সহিহ হাদিস বর্ণীত হয়েছে। এবং এ বিষয়ে সকল ওলামা একমত। তাছাড়া উভয় সূরার এই আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমেয় হয় যে, এই আয়াতগুলো পরস্পরের ব্যখ্যা ও একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। অতএব লায়লাতুম্ মুবারাকাহ্ বা বরককতময় রাতটি প্রকৃত পক্ষে কাদ্র-এর রাত, যা রমজান মাসের একটি রাত, ১৫ই শা’বান নয়।
তাছাড়া অধিকাংশ মুফাস্সিরগণ মনে করেন, সূরা আদ্-দুখানে উল্লেখিত লায়লাতুম্ মুবারাকাহ্ বলে লায়লাতুল্ কাদ্রকেই বোঝানো হয়েছে। শুধুমাত্র বিখ্যাত তাবেয়ী ইকরামা (রাহঃ) এটি ১৫ শা’বানের রাত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁর এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তটি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও একাধিক হাদিসের ভাবনার পরিপন্থী হওয়ায় পরিত্যাজ্য। কেননা ওলামা-ই-সালাফদের মধ্যে বহু যশস্বী পণ্ডিত যেমন বিখ্যাত সাহাবী ইব্নু আব্বাস (রাঃ), মফাস্সির ইব্নু কাসীর ও কুর্তুবী প্রমুখ ইক্রামা (রাহঃ)-এর মতকে নস্যাৎ করে বলেছেন সূরা আদ্-দুখানে উল্লেখিত ‘লায়লাতুম্ মুবারাকাহ্’র অর্থ আল্-কাদ্রের রাত। [তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন] তাছাড়া ইমাম কুরতুবী (রাহঃ) তাঁর তাফসীরে লিখেছেন, “কোনো কোনো আলেম মনে করেন ‘লায়লাতুম মুবারাকাহ্’ বলে মধ্য শা’বানের রাত (অর্থাৎ ১৫ই শা’বানের রাত বা শবে বরাত)-কে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”
ইমাম আবু বাক্র আল্-জাস্সাস তাঁর আল্-জামে’ লি-আহ্কামিল্ কুরআন নামক তাফসীর গ্রন্থে লায়লালাতুম্ মুবারাকাহ্ দ্বারা মধ্য শা’বানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ মর্মে তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, লায়লাতুল্-কাদ্র-এর চারটি নাম রয়েছে, তা হল— লায়লাতুল্ কাদ্র, লায়লাতুম্ মুবারাকাহ্, লায়লাতুল্ বারাআত এবং লায়লাতুস্ সিক। [আল্-জামে’ লি-আহ্কামিল্ কুরআন, সূরা আদ্-দুখানের তাফসীর] একই কথা ইমাম শাওকানী (রাহঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর ফাত্হুল কাদীর-এ উল্লেখ করে বলেছেন, লায়লাতুল্ বারাআত লায়লাতুল্ কাদ্র-এরই একটি নাম। মধ্য শা’বান বা ১৫ই শা’বানের রাতের নাম নয়। [ফাত্হুল্ কাদীর]
হাদিসে শবে
বরাতের উল্লেখ
(ক) ইমাম তিরমিযী (রাহঃ) বলেছেন, আমাদের কাছে আহমাদ ইব্নু মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইয়াযীদ ইব্নু হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইব্নু আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইব্নু আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, মা আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি এক রাতে রাসূল (সাঃ)-কে বিছানায় পেলাম না। অতঃপর আমি তাঁকে (সাঃ) খুঁজতে বের হলাম। ‘বাকী’ কবরস্থানে তাঁকে পেলাম। তিনি (আমাকে দেখে) বললেন, (আয়েশা রাঃ) তুমি কি আশংকা করেছো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ মহান আল্লাহ মধ্য শা’বানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কাল্ব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকেদের ক্ষমা করে দেন।
ইমাম তিরমিযী বলেছেন, মা আয়িশা (রাঃ)-এর এই হাদীসটি আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী রাহঃ-কে) বলতে শুনেছি, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রাহঃ) আরও বলেছেন, ইয়াহ্ইয়া ইব্নু কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেন, হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়াহ ইব্নু কাসীর থেকে শুনেননি।[1] [তির্মিযী ৩/১১৬, ইব্নু মাজাহ ১/৪৪৪, আহ্মাদ ৬/২৩৮, ইব্নু আবি শায়বাহ্ ৬/১০৮]
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযী (রাহঃ)-এর উল্লেখিত মন্তব্যে প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দু’টো দিক থেকে মুন্কাতি’ অর্থাৎ বর্ণনাশৃঙ্খলের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইব্নু আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত।
অতএব হাদিসটিকে প্রামাণ্য রূপে গ্রহণ করা এবং এর উদ্ধৃতি দিয়ে বিশেষ কোনো আমলে মনোনিবেশ করা সম্পূর্ণ রূপে নীতিবিরোধী প্রথা। ওলামা-ই-সালাফদের মান্হাজ বা কর্মপদ্ধতির পরিপন্থী। তাছাড়া এই হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, নবীজি (সাঃ) মাঝ রাতে বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ)-কে ডাকলেন না। না অন্য কাউকে সাথে নিলেন। অথচ বর্তমান সমাজ ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্রিত হয়ে শবে বরাত উদযাপন করে। পক্ষান্তরে, নবীজি (সাঃ) রমজান মাসের শেষ দশকে নিজে রাত জেগে ইবাদাত করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন এবং বেশি বেশি করে নফল ইবাদত করতে বলতেন।
(খ) আলা ইব্নু হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, এক রাতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম। আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে নবীজি (সাঃ) বললেন, হে আয়িশা অথবা (বললেন) হে হুমায়রা! তোমার কি এটা মনে হয়েছিল যে, আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? আমি বললাম, নবীজি (সাঃ)! আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমার ধারণা হয়েছিল, আপনি ইন্তেকাল করেননি তো! অতঃপর নবীজি বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা মধ্য শা’বানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা নিজ বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং করুণা প্রার্থনাকারীদের প্রতি করুণা ও অনুগ্রহ করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন। [ইমাম বায়হাকী (রাহঃ) তাঁর শু‘আবুল্ ঈমান গ্রন্থে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এবং হাদীসটি মুর্সাল, সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়। কেননা বর্ননাকারী ‘আলা মা আয়িশা (রাঃ) থেকে কোনো হাদিসই শোনেনি।][2]
(গ) আলী ইব্নু আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন মধ্য শা’বানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করো আর দিনের বেলা সিয়াম পালন করো। কেননা মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি (আজ) আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। আছে কি কোনো রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি তাকে রিয্ক বা অন্ন দান করবো। আছে কি কোনো বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি আমি তাকে আরোগ্য দান করবো। এভাবে ফাজ্র অর্থাৎ ঊষার উদয় পর্যন্ত বলতে থাকেন। [ইব্নু মাজাহ ও ইমাম বাইহাকী শু‘আবুল্ ঈমানে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এবং এই হাদীসটি দুর্বল। কেননা এই হাদীসের সনদে (বর্ণনাসূত্রে) ইব্নু আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, অধিকাংশ হাদীস বিশারদ ও গবেষকদের নিকট তিনি জাল হাদিস রচনাকারী রূপে পরিচিত। [তুহ্ফাতুল্ আহ্ওয়াজী বি-শার্হি জামে'’আত্-তির্মিজী] তাছাড়া এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহঃ) এই হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, হাদীসটি সনদের দিক থেকে একেবারেই দুর্বল।[3] [ইব্নু মাজাহ ১/৪৪৪, বায়হাকি ৩/৩৭৯, মুসান্নাফ আব্দুর্ রাজ্জাক হাদিস নম্বর ৭৯২৩]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত হাদিসটির ভাবনা অপর এক সাহীহ হাদিসের একেবারেই পরিপন্থী, যে হাদিসটিকে ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম (রাহঃ) নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং হদিসটি হাদিসে নুজুল নামে পরিচিত। সেটি হল— আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আমাদের প্রভু মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছো আমার কাছে প্রার্থনা করবে আমি তার প্রার্থনা কবুল করবো। কে আছো আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করবো। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করবো। [ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রাহঃ) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন][4]
প্রথম হাদিসটির বক্তব্য হল, মহান আল্লাহ মধ্য শা’বানের রাতে নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের দু’আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসটির বক্তব্য হল, মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষের দিকে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং দু’আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এই দ্বিতীয় হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী-মুসলিম সহ সুনানের প্রায় সকল গ্রন্থে বর্ণীত হয়েছে। তাই হাদীসটি প্রসিদ্ধ ও প্রামাণ্য। অতএব এই প্রসিদ্ধ হাদীসটির বিরোধী হওয়ার কারণেও (গ) নং হাদীসটি পরিত্যাজ্য হবে। তবে কেউ যদি বলে, প্রতি রাতের মধ্যে ১৫ই শা’বানের রাতও অন্তর্ভুক্ত। তাহলে কী করে পরস্পরে বিরোধী হল! তার ভেবে দেখা উচিৎ, এই দুই হাদীসের মধ্যে আরও একটি বিরোধের জায়গা হল, আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল মহান আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। আর (গ) নং হাদীসের বক্তব্য হল শা’বান মাসের পনের তারিখের রাতের প্রথম প্রহর থেকে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।
(ঘ) উসমান ইব্নু আবিল্ ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয় : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কেউ কিছু চাইবার আমি তাকে তা প্রদান করবো। রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, সেদিন মুশরিক অর্থাৎ পৌত্তলিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হবে। [ইমাম বায়হাকী শু‘আবুল্ ঈমান গ্রন্থে হাদিসটি বর্ণনা করেন। এবং বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন যায়ীফ আল্-জামে’ গ্রন্থে ৬৫২ নম্বরে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।][5] [বায়হাকি ৩/৩৮৩]
ওলামা-ই-সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গি
শবে বরাতের এই রাত সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইব্নু তাইমিয়া (রাহঃ) বলেছেন, ১৫ই শা’বানের রাতে কেউ যদি একাকী কোনো নফল নামায পড়ে বা তাওবা-ইস্তিগফার করে, যেমনটা ওলামা-ই-সালাফদের কিছুজন করতেন, তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে মসজিদে সমবেত হয়ে কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে, যেমন জামাআতে এক শ’ রাকাআত আদায় করা বা এক হাজার বার সূরা ইখলাস পাঠ করা ইত্যাদি বিদ্আত। এবং তা ওলামা-ই-সালাফদের নিকট ঘৃণ্য। [আল্-ফাতাওয়া আল্-কুব্রা, ইব্নু তাইমিয়া ২/২৬২] তিনি আরও বলেছেন, মধ্য শা’বানের রাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস ও আসার বর্ণীত হয়েছে। তবে এ রাতে জামাআত বদ্ধ হয়ে সালাত আদায় করা শরীয়তের ব্যাকরণ বহির্ভূত কাজ। [মাজ্মু'’ল্ ফাতাওয়া, ইব্নু তাইমিয়া ২৩/১৩২] তবে তিনি ইক্তিজা নামক তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছেন, ওলামা-ই-সালাফ, ওলামা-ই-মাদিনা ও পরবর্তী বহু ওলামা এই রাতের মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করেছেন এবং তাঁরা এ সম্পর্কে বর্ণীত হাদিসগুলির বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। [ইক্তিজাউস্ সিরাতিল্ মুস্তাকীম ৩০২]
এ রাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। এবং সেসব বর্ণনার বিভিন্ন সূত্র ও বর্ণনাকারীদের ঘিরে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। আর তাই কিছুজন এর মাহাত্ম্যকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করেছেন। আবার কিছুজন নানা ভাবে অতিরঞ্জন করেছেন। আর সেই অতিরঞ্জনের বহর আমরা প্রতি বছর এই রাতে মুসলিম পাড়ামহল্লায় দেখতে পাই। দেখতে পাই কীভাবে আড়ম্বরের সাথে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে ভিত্তিহীন কিছু রীতিকে বর্তমান সমাজ ইসলাম বলে উদযাপন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। তাই এ বিষয়ে গবেষণা ও সচেতনতার মিশ্রণে সঠিক ও উপযুক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে আমাদেরকে। এ রাত সম্পর্কে আমাদের ভারতের বিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুর রাহ্মান মুবারাকপুরী তাঁর তুহ্ফাতে বলেছেন, এই রাত সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণীত হয়েছে, আর তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ রাতের কিছু গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অবশ্যই রয়েছে। ওয়াল্লাহু আ’লাম। [তুহ্ফাতুল্ আহ্ওয়াজী বি-শার্হি জামে’ আত্-তির্মিজী, বাবু মা জাআ ফি লায়লাতিন্ নিস্ফি মিন্ শা'বান]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অনেকেই বলেন দ্বিতীয় হিজরি সনের এ রাতেই কিব্লা পরিবর্তন করা হয়েছিলো বায়তুল্ মাক্দিস থেকে পবিত্র কা’বার দিকে। একাধিক বর্ণনায় কিব্লা পরিবর্তনের এই বিষয়টি এসেছে, তার মধ্যে কিছু বর্ণনায় ১৫ই শা’বানের উল্লেখ রয়েছে, আবার কিছু বর্ণনায় ১৭ই রাজাব, কিছু বর্ণনায় ৮ই মুহাররামেরও উল্লেখ রয়েছে। তাই অতিরঞ্জন বা অস্বীকারকে বর্জন করে কুরআন ও সহীহ হাদিসের প্রমাণ সাপেক্ষে সঠিক ও সাবলীল পথ অবলম্বন করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। শেষে দু’আ করি, মহান আল্লাহ্ যেন আমাদের সবাইকে সঠিক জিনিস জানার এবং তা মেনে চলার সুমতি ও শক্তি প্রদান করেন, আমীন!
عن
علي بن أبي طالب رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا كانت
ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس
إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى
فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب
الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند
المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في
هذا الحديث: إنه واه جداً)
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول
الله صلى الله عليه وسلم قال: ينزل ربنا تبارك وتعالى في كل ليلة إلى سماء الدنيا
حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن
يستغفرني فأغفرله. (أخرجه البخاري ومسلم)
عن عثمان بن أبي العاص رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إذا كان ليلة النصف من شعبان نادى مناد: هل من مستغفر فأغفرله، هل من سائل فأعطيه ، فلا يسأل أحد إلا أعطي إلا زانية بفرجها أو مشرك. (أخرجه البيهقي في شعب الإيمان وضعفه الألباني في ضعيف الجامع رقم 652)
No comments:
Post a Comment