Wednesday 26 October 2022

নাজিব মাহফুজ নোবেল বিজয়ী মিশরীয় ঔপন্যাসিক

 

নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় নোবেল বিজয়ী মিশরীয় ঔপন্যাসিক  

(১৯১১ ২০০৬)

 

আরবি ভাষার কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক নাজিব মাহফুজ। ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। আরব লেখকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ও সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী। আরবি সাহিত্যে যেসব লেখক অস্তিত্ববাদ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে তিনি অবস্থান করে নিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা সাহিত্যিকদের তালিকায়।

 

জন্ম ও পরিচিত

পূর্ণ নাম নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় আব্দুল আজীজ ইব্‌রাহীম আহ্‌মাদ আল্‌-বাশা। জন্ম মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মিশরে। ১৯১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর কায়রোর আল-জামালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তাঁর বাবা তাঁর জন্মস্থান আল-জামালিয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আল-আব্বাসিয়া গ্রামে চলে যান। তাঁরা বহু বছর সেখানে বসবাস করেন। পিতার মৃত্যুর পরও নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় তাঁর মাকে নিয়ে সেখানে অনেকদিন বসবাস করেন। তারপর তিনি চলে আসেন পুরনো কায়রোর আল-আজহার এলাকায়।

 

প্রতিপালন ও শিক্ষা

তাঁর বয়স যখন সাত, ১৯১৯ সালের বিখ্যাত বিপ্লব ঘটে মিশরে, যা পরবর্তী জীবনে তাঁকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯৩০ সালে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকেই দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তারপর তিনি স্নাতকোত্তরের অভিসন্দর্ভ রচনা আরম্ভ করেন। বিষয় ছিল ইসলামি দর্শনে সৌন্দর্য। কিন্তু মাঝ পথে নিজ চিন্তার পরিবর্তন ঘটান। অতঃপর দর্শনের পরিবর্তে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।

 

কর্মব্যস্ততা

ওয়াক্‌ফ মন্ত্রণালয়ের সাংসদ সচিব রূপে দীর্ঘ আট বছর (১৯৩৮ ১৯৪৫) কাজ করেছেন। তারপর নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক সচিব রূপে। তারপর সেন্সর বোর্ডের সেক্রেটারির দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি চলচিত্র পর্ষদের পরিচালক হন। তারপর চলচিত্র, সম্প্রচার ও টিভি-রেডিও বিভাগের উপদেষ্টা হন। শেষে চলচিত্র ও সম্প্রচার বিভাগের সভাপতি রূপে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত কাজ করেন। তারপর সরকারী কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

 

সংসার জীবন

৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন নাজিব মাহফুজ। তার আশঙ্কা ছিল, যদি বিয়ে করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে লেখালেখির ক্ষতি হবে। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে পাশে রেখে ১৯৫৪ সালে আতিয়াতুল্লাহ ইব্‌রাহিম নামের এক নারীকে বিয়ে করেন নাজিব মাহফুজ। তাদের সংসারে দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তবে তিনি তার নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সব সময়ই খুব অন্তর্মুখী ছিলেন ও একা থাকতে ভালোবাসতেন। প্যারিস রিভিউকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তাই তিনি নিজেই বলেছেনআমি কখনো ডিনার পার্টি বা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে চাই না। এমনকি আমার বন্ধুদের বাড়িতেও ঘুরতে যাই না। আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি ক্যাসিনো কাসর আ-নীল অথবা কোনো কফি হাউজে।

 

মৃত্যু ও পরলোকগমন

১৯৭২ সাল পর্যন্ত নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন। চাকরি ছাড়ার পরে নিয়মিত কলাম লিখতেন বিভিন্ন প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায়। তবে বেশি লিখতেন আল-আহরাম পত্রিকায়। এসব কলাম নিয়ে পত্রিকাটি ২০০১ সালে একটি বইও বের করে। প্রায় ৭০ বছর লেখালেখিতে সক্রিয় থাকা এ মহান সাহিত্যিক ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট কায়রোয় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। এ দীর্ঘ জীবনে তিনি আরবি সাহিত্যকে তুলে ধরেন বিশ্বদরবারে।

 

সৃজনশীলতা ও রচনাসমূহ

তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই দর্শনের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। ১৯৩৪ সালে বর্তমান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন সাহিত্যের একজন গভীর পাঠক। ছাত্রজীবনে ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় রচিত বহু গ্রন্থ গভীর আনন্দের সাথে অধ্যয়ন করেনবিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকাকালীনই তিনি তিনটি ছোট আকৃতির ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে ফেলেন। তিনি ১৭ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর লিখিত প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। তবে লেখালেখির শুরুতেই খ্যাতি পেয়ে জাননি, করতে হয়েছে অনন্য সাধনা। প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর লেখালেখি শুরুর গল্প বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন

১৯২৯ সালে আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু। তখন আমার সবগুলো গল্প প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। মাজাল্লার সম্পাদক সালামা মুসা বলতেন, “তুমি সম্ভাবনাময়, কিন্তু এখন পর্যন্ত ভালো কিছু লিখতে পারনি। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে, কারণ সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু, হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন। আমার গল্প আবা আল-আকদারপত্রিকায় ছাপা হলো, সেটা আমার জন্য মাজাল্লা প্রকাশকদের পক্ষ থেকে একধরনের অপ্রত্যাশিত উপহার ছিল। সেটা আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

 

১৯৫২ সালের জুলাই মাসে সংগঠিত মিসর বিপ্লবের আগে তার প্রায় ১০টি বই প্রকাশিত হয়। এই বিপ্লবে তার লেখালেখি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এরপর তিনি বেশকিছু বছর তাঁর লেখালেখি বন্ধ রাখেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস সুলাসিয়্যাতুল্‌ কাহেরাহ্‌’ (কায়রো ট্রিলজি) যা তাঁকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে তোলে। তাঁর লিখিত মোট উপন্যাসের সংখ্যা ৩টি, ছোটগল্পের সংখ্যা ২২৩টি। এছাড়াও লিখেছেন টি নাটক এবং ২৬টি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। তাঁর লিখিত অনেক গল্প নিয়ে মিসরে ও বিভিন্ন দেশে নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র।

 

নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রথম দশ বছর যে কয়েক ডজন ছোটগল্প রচনা করেছেন, তার অধিকাংশই শহুরে জীবনের নানা অন্ধকার দিক নিয়ে লিখিত এবং তাঁর গল্পের অনেক চরিত্রই সরাসরি জীবন থেকে নেয়া। ফলে অতি দ্রুত সময়ে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন১৯৪৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে তাঁর যে উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হয়, তা সাধারণভাবে বাস্তবতাবাদী সামাজিক উপন্যাস বলে অভিহিত হয়। এসব উপন্যাসের মধ্যে খান আল্‌-খালীলী, জুকাকুল্‌ মিদাক (মিদাক সরণী), আস্‌-সারাব (মরীচিকা), বিদায়াহ্‌ ওয়া নিহায়াহ্‌ (শুরু ও শেষ) সুলাসিয়্যাতুল্‌ কাহেরাহ্‌ (কায়রো ট্রিলজি) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য১৯৫৯ সালে প্রকাশিত আওলাদু হাররাতিনা ৯জেবেলাউইর শিশুরা) দিয়ে তার লেখালেখিতে পরিবর্তন আসে। রূপক ও প্রতীকধর্মী রাজনৈতিক বিষয়াদি এ সময়ে তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেন। লেখায় দার্শনিক ও জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সমূহ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। তাঁর এই গ্রন্থটি একইসাথে বিখ্যাত এবং বিতর্কিত। নিজ দেশ মিশরে আজও বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৭ সালে লেবানন থেকে সর্বপ্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসটি। এ সময়ে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে, আল্‌-লিস্‌সু ওয়াল্‌ কিলাব (চোর ও কুকুর), সার্‌সারাতুন্‌ ফাওকান্‌ নীল (নীলের ছোট ছোট কথা) এবং মিরামার ইত্যাদি।

 

খান-আল-খালীলী কায়রোর আল-আযহার মসজিদের পাশের একটি বাজার। এই বাজারের অজস্র অলিগলি ও তাদের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করেই নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় লিখেছেন তার খান-আল-খালীলী উপন্যাসটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কায়রো শহরকে কীভাবে বদলে দেয়, সেই কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে যূকাকুল্‌ মিদাকমাহফুজের প্রথমদিকের উপন্যাসের মধ্যে এই উপন্যাস সবচাইতে বিখ্যাত, সম্ভবত তখন পর্যন্ত তার সবচাইতে পরিণত সৃষ্টিও। এই উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে মেক্সিকো থেকে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে মিদাক গলি নামেই।

 

মাহফুজকে মিশরে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয় তার বিখ্যাত উপন্যাস কায়রো ট্রিলজিএই সুবৃহৎ উপন্যাসের রয়েছে আলাদা আলাদা তিনটি খণ্ড যথাবাইনাল্কাস্রাইন (প্যালেস অব ওয়াক), কাস্‌রুশ্‌ শাওক (প্যালেস অব ডিজায়ার) আস্‌-সুক্‌কারিয়াহ্‌ (সুগার স্ট্রিট); এগুলো মূলত নাজিব মাহফুজের পুরনো গ্রাম আল-জামালিয়ার তিনটি রাস্তার নামে নামকরণকৃত। কেউ কেউ এই উপন্যাসকে আরব বিশ্বের ওয়ার অ্যান্ড পিসবলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কায়রো ট্রিলজির জন্য নাজিব মাহ়্ফ়ুজ় ১৯৫৭ সালে মিশরের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

 

নাজিব মাহফুজের প্রায় সব উপন্যাসে কাল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার চরিত্ররা সবসময় কাল নিয়ে ভাবে। তার উপন্যাসে আমরা প্রায়শ এই সব বাক্যাবলীর সাক্ষাৎ পাইসময় এক ভয়ঙ্কর সহযাত্রী, সময় আমার বন্ধুর অবস্থা এ কী করেছে? তার মুখে একটি বীভৎস মুখোশ এঁটে দিয়েছে! তাঁর এই কালজয়ী সৃষ্টিই তাঁকে বিশ্বের দরবারে অমর করে তুলেছে নোবেলের মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কারে পুরস্কৃত করেছে সেই সাথে তাঁর হাত ধরেই বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গেছে আরবি উপন্যাস ও আরব মননশীলতা

 

কলমেআব্দুল মাতিন ওয়াসিম

No comments:

Post a Comment