Sunday 17 December 2017

আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসঃ ১৮ই ডিসেম্বর


 আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসঃ ১৮ই ডিসেম্বর 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আজ ১৮ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি আরব বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পালিত ও উদযাপিত হচ্ছেপশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা ও ভাষা ইনস্টিটিউটে দিবসটি বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করা হয়। অন্যান্য ভারতীয়দের ন্যায় আমরা বাঙালিরাও প্রতিনিয়ত পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। এমনকি বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় আরবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি; যথা- ইংরেজি, ফরাসী, চীনা, রাশিয়ান ও স্প্যানিশ। আরব নেতাদের নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। অন্য ভাষাতে তাঁদেরকে বক্তব্য প্রদান ও শ্রবণ করতে হতো। এমনকি নথিপত্র আরবি থেকে কোন দাপ্তরিক ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থাপন করতে হতো। অতঃপর সৌদি আরব ও মরক্কো সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে ৪র্থ ডিসেম্বর জাতিপুঞ্জের নবম অধিবেশনে ৮৭৮ নং প্রস্তাবে বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা আরবিতে লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। সাথে এ শর্ত জুড়ে দেয়, অনুবাদের ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে১৯৬০ সালে জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবিতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনগুলোতে অন্য ভাষা থেকে আরবিতে এবং আরবি থেকে অন্য ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবি ভাষাকে ইউনেস্কোর সাধারণ সভা ও কর্ম পরিষদের কার্যকরি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে সৌদি ও মরক্কোর পাশাপাশি আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপে ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিদ্ধান্তে আরবিকে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।      
জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো-র ১৯৯৯ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সম্মান জানাতে প্রতি বছর ২১ই ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসউদযাপনের প্রস্তাব জাতিপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ছ’টি ভাষার জন্যও পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ঘোষণা করা হয়২০শে মার্চ আন্তর্জাতিক ফরাসী ভাষা দিবস; ২০শে এপ্রিল আন্তর্জাতিক চীনা ভাষা দিবস, চীনা বর্ণমালার প্রতিষ্ঠাতা সঙ জি হৈ এর স্মরণে; ২৩শে এপ্রিল আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস, উইলিয়াম সেক্সপিয়ারের মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণে; ৬ই জুন আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস, রাশিয়ান কবি আলেকজান্ডার পুশকিনের জন্ম বার্ষিকী স্মরণে; ২১শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক স্প্যানিশ ভাষা দিবস এবং ২০১২ সালে ১৮ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসঘোষণা করা হয়। অতঃপর সে বছরেই ১৩-১৮ই অক্টোবর প্যারিসের সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের ১৯০তম সভায় আরব রাষ্ট্রদূতগণের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক এ দিবসের প্রতীক অনুমোদন করা হয়
আরবি পৃথিবীর প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। বর্তমান ২৭টি দেশের প্রধান ভাষা। বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠীর ভাব বিনিময়য়ের মাধ্যম। দেড়শ কোটিরও বেশি মুসলমান দৈনন্দিন জীবনে এভাষা অল্পবিস্তর ব্যবহার করেন। জাতিপুঞ্জ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসি সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার দাপ্তরিক ভাষা এমনকি বর্তমানে ট্রেড ল্যাংগুয়েজ হিসেবেও বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে এই ভাষাআন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে পণ্যের বিজ্ঞাপন ও গুণাগুণ আরবিতে লেখা দেখতে পাওয়া যায়।
আরবি ভাষার সাথে ভারতীয়দের পরিচয় ঘটে সুদূর অতীতে বাণিজ্যসূত্রে। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে এবং ধর্মচর্চার আবহে তখন থেকেই এদেশে আরবির চর্চা শুরু হলেও আজও তা ধর্মীয় গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না আরবি ভাষা এদেশের আধুনিক জীবন-যাত্রার সাথে এখনো সম্পৃক্ত হতে পারেনি। যদিও আমরা বাঙালিরাও দৈনন্দিন জীবনের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খা, দুঃখ-বেদনা ও অভিমত ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য আরবি শব্দ অহরহ ব্যবহার করে থাকিতাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী আরব দেশগুলোতে কর্মের সন্ধানে, বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আরবি চর্চার প্রয়োজন আমরা সকলেই অনুভব করি।

মনে রাখা দরকার, ভাষা কখনো হিন্দু বা মুসলিম হয় না। ভাষা তাঁদের যারা সে ভাষায় চর্চা করে। তাই আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব এই কালজয়ী ভাষাটিকে শিখে এর সমৃদ্ধ সাহিত্যকে আস্বাদন করা। প্রয়োজনে একক ও সম্মিলিত, সরকারী ও বেসরকারীভাবে উদ্যোগ নেওয়া। পত্র-পত্রিকা, নিউজ, টেলিভিশন ইত্যাদির সাহায্যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। চরম পরিতাপের বিষয় যে, কবিগুরু আরবদের নিকট অত্যন্ত সমাদৃত। কিন্তু তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের কিঞ্চিতরই আরবিতে অনুবাদ হয়েছে; তবে সেগুলি ইংরেজি বা ফরাসীর মাধ্যমে, সরাসরি বাংলা থেকে হয়নি; সহজভাবে বললে- অনুবাদের অনুবাদ। অন্যদিকে নাজিব মাহফুযের কায়রো ট্রিলজি, খলিল জিবরানের দ্য প্রোফেট-এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি দারবেশ, অ্যাডোনিস, আশরাফ ফাইয়ায প্রমুখরা বাঙালী সাহিত্যমোদীদের নিকট অত্যন্ত সুপরিচিত। কিন্তু তাঁদের সৃজনশীলতাকে এই সমাজ জানতে পারে ইংরেজি বা ইংরেজি হতে কেউ অনুবাদ করলে তার মাধ্যমে। আরবি হতে সরাসরি বাংলায় অনূদিত সাহিত্যকর্ম কলকাতার বই-বাজারে এত দুর্লভ কেন- আরবি পড়ুয়া ও শিক্ষকদের নিকট সমাজের একটি অব্যক্ত প্রশ্ন।


No automatic alt text available.
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ পূবের কলম-এ প্রকাশিত

2 comments:

  1. ماشااللہ
    আল্লাহ রব্বুল আলামীন তোমার কলমে বারাকাহ দান করুন।

    ReplyDelete