ভিড়তন্ত্রের কবলে
ছোটবেলায় গল্পটা শুনেছিলাম।
সম্ভবত, নানিমা-র কাছে। স্রষ্টা যখন সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে
দিলেন, একজন ফেরেশতা – তাঁর নাম মালাকুল্ মাউত্
- দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, প্রভু আপনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন ‘জান কবজ’ করার। সবাই তো আমাকে গালাগাল দেবে। অভিশাপ দেবে। স্রষ্টা
উত্তর করলেন, তুমি যেমনটা ভাবছ, ঘটনা তার বিপরীত হবে। কোনো
প্রাণীর মৃত্যুর পূর্বে সিনারিও এমন তৈরি হবে যে কেউ তোমার কথা খেয়ালই করবে না।
সবাই মৃত্যুর কারণ-ঘটনা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করবে। আর সেই সাথে ‘এটা না করলে বেঁচে যেত, ওখানে না গেলে কিছুই হত না’-টাইপ কথা আওড়ে আফসোস করবে।
(এই কথাগুলো তত্ত্ব ও তথ্যের বিচারে কেমন তা আমার জানা নেই।)
বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি
সবে দিল্লীর মসনদে বসেছেন। পুনেতে আইটি সেক্টরের কর্মচারী মুহ্সিন শেখ নিহত হলেন
কিছু অতি-রাষ্ট্রবাদীদের হাতে। ক’দিন খুব আলোচনা চলল, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। ভেসে উঠল তাঁর ‘মুসলিম চেহারা’-র ছবিটা। সময়ের সাথে সবাই ভুলে গেল; শুধু ভুলতে পারেনি সেই মা
যার নাড়ি ছিঁড়ে কোন এক ভোরে পৃথিবীর আলো দেখেছিল মুহ্সিন।
আখলাক খুন হলেন। দাদরির
কোনো এক মহল্লায়। ফ্রিজে তাঁর মাংস ছিল। ‘মাংস’ কীসের ছিল তা নিয়ে চলল জোর বিতর্ক-আলোচনা। প্রেস্টিটিউটদের টক শ’তে। শুনেছিলাম মাংসের কিছুটা ফরেনসিক না কীসব টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ‘খুন’ বেমালুম হারিয়ে গেল বিতর্ক ও সময়ের গোলক ধাঁধাঁয়; শুধু হারায়নি আখলাক স্ত্রী-সন্তানদের মন থেকে। তাঁর আর্মি ছেলে হয়তো খুন হওয়া
পিতার ছবি মনে ও মোবাইলে নিয়ে কাশ্মীরের কোথাও পাহারা দিচ্ছে তেরঙ্গার আব্রুকে।
জে এন ইউ-র ঢাবা ও জঙ্গলের
মাঝে কোথাও হারিয়ে গেল নাজিব। নিখোঁজ সে। কোনো হদিশ নেই তাঁর। তাঁর মা’র আহাজারি কানকে ছুঁলেই মনে প্রশ্ন জাগে, সবুজে ঘেরা ওই সুন্দর
ক্যাম্পাসটির কোথায় আছে বারমুডা ট্রাঙ্গেল-টা? নাজিবের স্বপ্ন-উড়ান যেটাতে
ভ্যানিশ হয়ে গেল। হয়তো আজ থেকে পাঁচ বছর পরে সেই নাজিবেরই ডাক্তার ছোট বোনের হাতে
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে কোন অতি-রাষ্ট্রবাদী ভক্ত।
‘সোনে কি চিড়িয়া’-র কোনো না কোনো প্রান্তে
সপ্তাহান্তে এমন এক-আধটা ঘটনা শোনাই যায়। যেগুলোতে খুন হয় আফরাজুল-পেহ্লু-জুনাইদ-ফারুক-আকবর-রা
‘ভিড়’-এর হাতে। নেপথ্যে থাকে কিছু বাঁধাধরা কারণ– গোমাংস, গো-তসকরি, গো- হত্যা, লাভ্ জেহাদ, ছেলে-পাচারকারী, বাইকচোর ইত্যাদি। বাস্তবের
মাটিতে সে-কারণগুলোর সাধারণত কোন অস্তিত্ব থাকে না। তবে ‘গোদি মিডিয়া’-র স্ক্রিনে দেখানো হয় কতকিছু। ফলে আলোচনা-বিতর্ক সবই চলে, তবে খুনের বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে। আর প্রেস্টিটিউট-রা মেতে ওঠেন কু-অজুহাতের নানান
মোড়কে ঢেকে সেই হত্যাকে বৈধ সাব্যস্ত করতে। এভাবেই মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হতে
থাকে সিনারিওগুলো আর বেমালুম মুক্তি পেয়ে যায় সেই ‘ভিড়’, জান কবজকারী এই দানবরা...!
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment