মোনাফেক এখনো আছে...
বিংশ শতাব্দীর চারের দশকের শেষের দিকে আমেরিকা গেলেন সামিরা মুসা। পরমাণু নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজকে কেন্দ্র করেই পাড়ি জমিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। তখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। এই অল্প বয়সেই মিসরীয় মুসলিম মহিলা পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর বেশ নাম্-ডাক হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান তিনি।
রকেট-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কাজ করছিলেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। নাম ফাদি মোহাম্মদ আল-বাতস। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাগরিক। সম্প্রতি নিজ কর্মস্থান কুয়ালালাম্পুরেই নিহত হন তিনি।
আরেক মিসরীয় বিজ্ঞানী ড. সামির নাজিব গবেষণা করছিলেন পরমাণু প্রযুক্তির সামরিক প্রয়োগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৭ সালে তাঁকেও হত্যা করা হয় মার্কিন শহর ডেট্রয়টে।
১৯৮০ সালের জুনে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রহস্যজনকভাবে নিহত হন ইরাকের পরমাণু প্রকল্পের প্রধান ড. ইয়াহ্ইয়া আমিন আল-মুর্শেদ। ইরাকি পরমাণু চুল্লিতে ফরাসি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য প্যারিসে গিয়েছিলেন তিনি। তিনিও ছিলেন মিসরীয়।
আরও এক মিসরীয় বিজ্ঞানী সাইদ আল-বোদায়ের'কে তার নিজ বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে কিছু অজ্ঞাতপরিচিত দুর্বৃত্ত, ১৯৮৯ সালে। মাইক্রোওয়েভ বিষয়ে কাজ করছিলেন তিনি।
লেবাননের এক উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন রামাল হাসান রামাল। ১৯৯১ সালে, প্যারিসে তাঁকেও খুন করা হয় রহস্যজনকভাবে।
ক'বছর আগে, ২০০৪ সালে ইরানি পদার্থবিজ্ঞানী মাসুদ আলি মোহাম্মদিকে তেহরানে তাঁর বাসভবনের বাইরে হত্যা করা হয়। কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি।
গত বছর তিউনেশীয় অ্যাভিয়েশন প্রকৌশলী মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে হত্যা করা হয় তাঁর দেশের মাটিতেই। ফিলিস্তিনের খুব বড় সমর্থক ছিলেন তিনি। ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। নিজ বাসভবনের বাইরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী হাসান আলি খাইরুদ্দিন রহস্যজনকভাবে নিহত হন। কানাডায় বিশ্ব অর্থনীতিতে ইহুদি আধিপত্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি। না থামলে মেরে ফেলা হবে- এমন হুমকি আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছিল ২৩ বছর বয়সী এই গবেষককে। শেষ পর্যন্ত সেন্ট ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় তাঁকে হত্যা করা হয়।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সে হত্যা করা হয় লেবাননের আরেক বিজ্ঞান-শিক্ষার্থী হিশাম সালিম মুরাদকে। তিনি জোসেফ ফুরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
চলতি বছরের ২৫ মার্চ, গাজার পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি রসায়নবিদ ইমান হোসাম আর্-রোযাকে হত্যা করে ইসরাইল।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন যে সকল রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক তাঁদের মতে, এসব বিজ্ঞানীদের হত্যার পেছনে হাত রয়েছে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী দুই গোয়েন্দা সংস্থার। আবার অনেককে অন্য পন্থায় দমন করা হয়েছে। যেমনভাবে অত্যন্ত কৌশল করে দমন করা হয়েছে পাকিস্তানের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকিকে। তিনি ছিলেন এমআইটির গ্রাজুয়েট। নামমাত্র এক অভিযোগে তাঁকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে মার্কিন সরকার। তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে পাগল বানিয়ে এক নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। আর এভাবেই সারা বিশ্বে মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যা করে যেমন নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে তারা, ঠিক তেমনই 'তিন শ তেরো'র গৌরবধারী এ জাতিকে রণ ও জ্ঞান-ক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখার অপকৌশল করে চলেছে লাগাতার। আরব ও মুসলমানরা যাতে বিজ্ঞান, বিশেষ করে পরমাণু প্রযুক্তি ও সামরিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্য এই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারা। আর কিছু মোনাফেক টাকার বিনিময়ে এমন বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও গবেষকদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে হয়তো।
অভিযোগ রয়েছে, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিও ইসলামপন্থী মানুষদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দিতেন। অনেক সময় ইসলামপন্থীদের জঙ্গি তকমা দিয়ে লেখা কলাম বিভিন্ন মার্কিন জার্নালে প্রকাশ করতেন। আর এসবের বিনিময়ে তিনি পেতেন মোটা অংকের টাকা। তবে, এ অভিযোগ কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা তা আমার জানা নেই। আর এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করছি, কিছু মানুষ অর্থাৎ সৌদি-পন্থীরা খাশোগির কুৎসা করে চলেছে। অন্যদিকে, কিছু মানুষ অর্থাৎ সৌদি-পরিপন্থীরা খাশোগির স্তুতি গাইছে। আবার যারা আসাদ-পন্থী, সিরিয়া সম্পর্কে তাঁর অভিমত ও কলামগুলোর কারণে তাঁর কুৎসা গাইছে এবং তাঁরও মৃত্যুকে 'গো আসাদ কার্স' হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই, তার খুন যেমন মর্মান্তিক তেমনই রহস্যজনক আমার দৃষ্টিতে। হয়তো সময়ের স্রোতে সব কিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে, হয়তো বা অন্যান্য বহু হত্যার মত তার হত্যাও চলমান হত্যাযজ্ঞের সমুদ্রের গভীরে পলি রূপে চাপা পড়ে যাবে...!
বিঃ দ্রঃ ইসলাম কোনোভাবেই এধরণের হত্যাকে সমর্থন করে না। কারণ, ইসলাম একটি প্রাণের হত্যাকে সমগ্র মানবতার হত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে (সুরাতু আল-মায়েদাহ ৩২)। অতএব যে কোনো হত্যার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। এবং মুস্লা (অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির শরীর বিকৃত করা)-ও ইসলামে হারাম।
No comments:
Post a Comment