ভাইয়ের দরদ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিসপাড়া। চারিদিক খুব ব্যস্ত। তখন দুপুর দুটো তিরিশ হবে। রাস্তার পাশের এক চেনা
দোকানে চা খাচ্ছে শাহিদ। এক যুবতী, বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে, ইতস্তত করতে করতে
ঢুকলো সেই দোকানে। হাতে একটা ট্রান্সপারেন্ট ফাইল। দেখা যাচ্ছে, ভিতরে রয়েছে কিছু মার্কশিট ও
সার্টিফিকেট। সারা শরীরে প্রসাধনের তেমন কোনো চিহ্ন নেই। তবে ঘামে ভেজা ও রোদে মাখা মুখটা
ছিল বেশ সপ্রতিভ। এক পা দু’ পা করে দোকানদারের কাছে গিয়ে বলল—দাদা, ভাত বা রুটি পাওয়া যাবে?
দোকানদার তখন একটা থালায় ভাত তুলছিল। উত্তর
দিল— হ্যাঁ,
ভাত পাবেন। বলুন
কী খাবেন— ডিম,
রুই,
পাবদা,
চারা পোনা,
মাছের ডিম,
মাংস? বলুন কী দেবো?
— শুধু সব্জি ভাত কত দাদা?
— ভাত,
ডাল, আলুভাজা এবং
সোয়াবিনের তরকারি পঁয়ত্রিশ টাকা।
— আমার সোয়াবিন চাই না। শুধু আলুভাজা
আর ডাল দিন। তিরিশ টাকায় হবে তো?
—হবে। বসুন, দিচ্ছি।
এরই মধ্যে ওর ফোনটা বেজে উঠল— “হ্যাঁ মা
বলো... হ্যাঁ, হ্যাঁ ইন্টারভিউ দিয়েছি... হ্যাঁ আরও কয়েকটা অফিসে যাবো কথা বলতে...
হ্যাঁ খেয়েছি... ভাত মাছ... তুমি ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়েছো তো?... হ্যাঁ আমি পাঁচটার ট্রেনটা ধরবো... ভাইকে
টিউশন থেকে ফেরার সময় স্টেশনে দাঁড়াতে বলবে... আচ্ছা, ঠিক আছে, রাখলাম... হুম...।”
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে আনমনে
তাকিয়ে থাকলো। হয়তো অসুস্থ মা, পড়ুয়া ছোট ভাইকে ঘিরে সাজানো স্বপ্নগুলো চোখে ভিড় করছিলো। শাহিদের মনে এক অদ্ভুত রকমের মায়া জন্মাল ওই অজানা-অচেনা যুবতীর প্রতি। নারী স্বাধীনতা কী, ওর কাছে শুনতে খুব ইচ্ছে করছিলো তার। চাকরির এই
আকাল-যুগে ও যে বেরিয়ে এসেছে এই আগুন-রোদের তলায়, নেমে এসেছে এই শক্ত-পাথুরে
মাটিতে জীবন-যুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে,
এখানেই অর্ধেক যুদ্ধ জিতে গেছে সে। মনে মনে
তাকে শুভ কামনা জানাল, আর বাকি অর্ধেকটা যে-দিন নিজের চাকরির টাকায় সত্যি সত্যি
মাছ ভাত খাবে সে-দিন জিতবে!
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দোকানদার ভাতের থালাটা
নিয়ে হাজির। তার সামনে রেখে বললো— আমি ভুল করে সোয়াবিনটা দিয়ে ফেলেছি। খেয়ে নিন প্লীজ। আর হ্যাঁ, ওই তিরিশ টাকাই দেবেন। বেশি দিতে হবে না।
—কিন্তু আমি তো শুধু আলুভাজা...।
—আমি ভুল করে তরকারিটা দিয়ে ফেলেছি। আপনি না
খেলে এই খাবারটা পুরোটাই নষ্ট হবে। খেয়ে নিন প্লীজ। ভুলটা তো আমার। তাই তিরিশ
টাকাই নেবো।
দোকানদারের সাথে শাহিদের বেশ সখ্যতা। দীর্ঘ
দিনের আলাপ তাঁদের। তাঁরা ক’জন সহকর্মী সপ্তাহে প্রায় পাঁচ দিনই তার দোকানে
দুপুরের খাবার খায়। ওই যুবতীকে খাবারটা দিয়ে এসে দোকানদার শাহিদের দিকে তাকিয়ে
চাপাস্বরে বলল— ব্যাবসায়
শুধু লাভ খুঁজলে হবে দাদা। এরকম ভুল করার সুযোগও তো খুঁজতে হবে। ওর জোর খিদে পেয়েছিল। বনগাঁতে আমার যে-বোনটা থাকে, অবিকল ওর মতো
দেখতে। দু’জনই একই বয়সের।
বলে আবারও নির্লিপ্ত মুখে হারিয়ে গেল সে চা-সিগারেট-ভাত-তরকারির দুনিয়ায়। শাহিদ ভাবতে
লাগল, আজকের এই খণ্ড যুদ্ধে কে জয়ী হল? চাকরির খোঁজে রোদে
পোড়া যুবতী, নাকি বনগাঁর সেই যুবতী, নাকি তার দাদা যে সল্টলেকের অথৈ ভিড়ে এক অচেনা
যুবতীর মধ্যে নিজের বোনকে খুঁজে নিয়ে দিব্যি আপ্যায়ন করল? হয়তো নিজ নিজ জায়গায়
তাঁরা সকলেই জয়ী! তবে মনে মনে সে কুর্নিশ করলো ওই দোকানদারকে এবং ভাবতে লাগলো,
জীবন-যুদ্ধ যে কত কঠিন যে বোঝে সে-ই জানে যোদ্ধার রক্ত,
ঘাম ও ক্ষিদের মূল্য!
সহকর্মীদের সাথে পায়চারী করতে করতে শাহিদ
পৌঁছে গেল অফিস বিল্ডিঙয়ের নীচে। তখনো তার চোখে ভাসছে ওই যুবতীর করুণ মুখটা। লিফটে
উঠে ১২ নম্বর বাটান প্রেস করলো। লিফট উপরে উঠতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে পড়ল, দু’
সপ্তাহ বাদে তো ইদুল্ আজ়্হ়া। তার কলেজ-পড়ুয়া বোন খুব বায়না ধরেছে এবার এক খানা
ভালো এন্ডরোয়েড কিনে দিতে। মনে মনে স্থির করলো, “আমি না হয় আরও দু’ মাস নিজের
ভাঙ্গা ফোনটাই ইউজ করবো। তবে এবার ঈদে বোনকে একটা ভালো এন্ডরোয়েড কিনে দেবোই।”
২১-০৯-২০১৮
কোলকাতা-৩৯
No comments:
Post a Comment