Friday 9 November 2018

ঈদ মিলাদুন্‌ নবীঃ কিছু কথা


 ঈদ মিলাদুন্‌ নবীঃ কিছু কথা  
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
আমাদের উপমহাদেশে, হিজরি সনের তৃতীয় মাস, রবিউল্‌ আউয়াল-এর বারো তারিখের রাতটি বেশ আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয়। এ রাতে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-উৎসব, জালসা-মহফিলে মুখরিত হয়ে ওঠে অনেক পাড়া-মহল্লা। কোথাও আবার দেওয়াল-লিখনের পাশাপাশি ঠোঁটেও উচ্চারিত হতে থাকে- সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদ-ই-মিলাদ
এসব দেখে-শুনে মাথার মধ্যে কিলবিল করে কিছু প্রশ্ন- ঈদ-এর অর্থ কী? মিলাদুন্‌ নবি বলতে কী বোঝায়? ইসলামে ঈদ আসলে ক’টি? নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে নবি (সা)-র প্রকৃত জন্মদিন কোনটি? নবি (সা) বা তাঁর অনুগামীরা কি এদিনটিকে উদযাপন করতেন! করলে কীভাবে করতেন? শরিয়তের দৃষ্টিতে এসব রীতিরেওয়াজের বিধানই বা কী? এধরণের প্রশ্নগুলো মাঝে মাঝেই মনকে জারণ করে।
ঈদ একটি আরবি শব্দ। অর্থ উৎসব, এমন উৎসব যা ফিরে আসে বারবার। আর মিলাদ শব্দের অর্থ জন্ম বা জন্মতিথি। তাই, মিলাদুন্‌ নবি বলে নবি (স)-এর জন্মদিনকে বোঝানো হয়।   
নবি মুহাম্মদ (সা)-এর জন্ম কোন দিনে?- তা সবার জানা, সোমবারে। কিন্তু, কত তারিখে?- তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মতভেদ অনেকের মতে তাঁর জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল। আবার অনেকের মতে ৯ই রবিউল আউয়াল। তবে বিশ্ববরেণ্য ও বিশুদ্ধতম সিরাত-গ্রন্থ আর্‌-রাহীক্বুল্‌ মাখতূম-এ বলা হয়েছে রাসূল (সা) ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে ৯ই রবিউল আউয়াল, মোতাবেক ২০শে এপ্রিল সোমবার প্রত্যুষে জন্ম গ্রহণ করেন (পৃ-৪৫)একই অভিমত বিখ্যাত ইসলামি বিদ্বান আল্লামা মুহাম্মদ সুলাইমান সাল্‌মান মানসূরপুরি (রাহ্‌মাতুল্‌ লিল্‌-‘আলামীন পৃ-৩৪) ও মিশরের প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা’র আল্লামা শিবলি নোমানি ও সাইয়েদ সুলাইমান নাদভি তাঁদের সীরাতুন্‌ নাবী গ্রন্থে লিখেছেন- নবি (সা)-এর জন্মদিন সম্পর্কে মিশরের বিখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী মাহমূদ পাশা একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। তাতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, নবি (সা)-এর জন্ম ৯ই রবিউল আউয়াল, রোজ সোমবার, মোতাবেক ২০শে এপ্রিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে’ (১ম খণ্ড, পৃ-১৩৬, ১৩৭) বহু সহিহ হাদিসে নবি (সা) নিজেই বলেছেন যে, তাঁর জন্ম সোমবারে হয়েছে (মুসলিম ১১৬২)এই তথ্যকে ভিত্তি করে মাহমূদ পাশা গবেষণা ও হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, সে-বছর ১২ই রবিউল আউয়াল পড়েছিল বৃহস্পতিবার। আর সোমবার ছিল ৯ই রবিউল আউয়াল (সীরাতুন্‌ নাবী ১/১৩৭) পাশার এই গবেষণালব্ধ অভিমতকে এখনো কেউ খণ্ডন করতে পারেনি। বরং বর্তমানে অনেকেই এই মতকে গ্রহণ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নবি (সা)-এর জীবনাবসান হয়েছিল সর্বসম্মতভাবে ১২ই রবিউল আউয়াল-এ।  
তাছাড়া, জন্মদিন পালন করা ইসলামের কোন বিধিবদ্ধ নিয়ম নয়। এমনকি অধিকাংশের মতে, জন্মদিন পালন ইসলামি সংস্কৃতির পরিপন্থী একটি রীতি। তাই কারো জন্মদিন পালন করা-কে ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলামের ইতিহাস ও হাদিস অধ্যয়নে আরও স্পষ্ট হয় যে, নবি (সা) নিজে তাঁর জন্মদিন পালন করেননি। এমনকি তাঁর সাহাবারাও (অনুগামী) না। অথচ তাঁরা নবি-প্রেমের বহু অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁদের সামনেই খ্রিষ্টানেরা ঈসা (যীশু) (আ)-এর জন্মদিন (বড়দিন) উদযাপন করত। কিন্তু তাঁরা কখনো নবি (সা)-এর জন্মদিনে ঈদ বা অনুষ্ঠান করেননি। তাই ইসলামি শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা একে একটি ‘নব আবিষ্কৃত রীতি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উমার (রা) একদিন সকল সাহাবাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন, একটি নতুন বর্ষগণনা-পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ পরামর্শ দেন, নবি (সা)-এর জন্ম তারিখ থেকে সন গণনা শুরু করা হোকআবার কেউ বলেন, তাঁর (সা) মৃত্যুদিন থেকেউমর (রা) তৎক্ষণাৎ এসব প্রস্তাব বাতিল করে বলেন, এ পদ্ধতি খ্রিষ্টানদের। অতঃপর, কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে হিজরতের দিন থেকে ইসলামি সন গণনা আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (বুখারি ৩৯৩৪, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, ইবনু কাসির ৪/৫১০-৫১২)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জন্মদিবস কেন্দ্রিক উৎসব-অনুষ্ঠান অ-মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতি। যেমন- বড়দিন, জন্মাষ্ঠমী, বৌদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি। আর এ মর্মে মনে রাখতে হবে, যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ৩৫১২, সহিহ আবু দাউদ, আল্‌বানি ৩৪০১) উল্লেখ্য যে, এ কারণেই আযান প্রচলনের ঘটনায় নবি (সা) আগুন জ্বালানো (পারসিক), ঘণ্টা ধ্বনি (খ্রিষ্টান), বাঁশি বাজানো (ইহুদি)-র প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন (তিরমিযি ১৮৯, আবু দাউদ ৪৯৯, ইবনু মাজাহ্‌ ৭০৬)   
এবার প্রশ্ন, ইসলামে ঈদ ক’টি? কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে, ইসলামে ঈদ হল দু’টি- ঈদুল্‌ ফিত্‌র ও ঈদুল্‌ আয্‌হা। আর এ কথা নবি (সা) মদিনা-জীবনের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন। তিনি মদিনায় পৌঁছে দেখলেন, বছরের দু’টি দিন মদিনাবাসীরা বেশ আনন্দ-ফুর্তি করছে। এবং প্রাক-ইসলামি যুগ থেকেই এ দু’দিন তারা আনন্দ-ফুর্তি করে আসছে। নবি (সা) তাঁদেরকে সম্বোধন করে বললেন, মহান আল্লাহ্‌ এ দুদিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দু’টি দিন তোমাদেরকে দিয়েছেন। তা হল ঈদুল্‌ আয্‌হা ও ঈদুল্‌ ফিত্‌র” (আবু দাউদ ১১৩৪) আর এ বিষয়টি (ইসলামে ঈদ দুটি) যেমন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক তেমনই ‘ইজ্‌মা-য়ে উম্মাত’ দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত। অতএব কোনো তৃতীয় ঈদের প্রচলন কখনই বিধিবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না বলে আমার বিশ্বাস কারণ, আমাদের এই দ্বীনে যে নতুন কোনো বিষয়ের প্রচলন করবে সে প্রত্যাখ্যাত হবে” (বুখারি ২৬৯৭, মুসলিম ৪৪৯২)এবং “নব-প্রবর্তিত প্রতিটি বিষয়ই বিদ‘আত (ধর্মীয়-অনুশীলন বিষয়ক নতুন রীতি) আর প্রতিটি বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা” (আবু দাউদ ৪০৬৭)   
এ মর্মে এও উল্লেখ্য যে, নবি (সা) জীবনভর সোমবার ও বৃহস্পতিবার নফল (ঐচ্ছিক) রোযা রেখেছেন। তাই অনেকে মনে করেন, জন্মদিন উপলক্ষে তিনি (সা) সোমবারে রোযা রাখতেন। আর প্রমাণস্বরূপ তারা উল্লেখ করেন, একবার নবি (সা)-কে সোমবারের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- “এ দিনে আমার জন্ম এ দিনেই আমি নবুওয়াত (নবিত্ব) লাভ করেছি এবং এ দিনেই আমার উপর প্রথম অহি (সুরাতু আল্‌-আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচ আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছিল” (মুসলিম ১১৬২) এ হাদিস উল্লেখ করে তারা বলতে চেয়েছেন যে, ঐ দিনে রোযা পালন করে তিনি (সা) জন্মদিন উদযাপন করেছেন। অতএব ঈদ-ই-মিলাদ সুন্নত। কিন্তু তারা বেমালুম ভুলে যান যে, খুদ সে-হাদিসেই আরও কয়েকটি কারণের উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া নবি (সা) সোমবার ছাড়া বৃহস্পতিবারও রোযা রাখতেন। এবং এ বিষয়ে তাঁর (সা) স্পষ্ট বিবৃতিও রয়েছে, ,“সোমবার ও বৃহস্পতিবার মানুষের সম্পাদিত কর্মসমূহ আল্লাহ্‌র নিকট পেশ করা হয়। কাজেই আমি পছন্দ করি, যখন আমার আমলসমূহ পেশ করা হবে তখন যেন আমি রোযা অবস্থায় থাকি” (সাহিহুল্‌ জামে’, আল্‌বানি ১৫৮৩)আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, তিনি ঐ দিনে রোযা রেখেছেন। আর ঈদ আসে রোযার শেষে; ঈদের দিন রোযা হয় না আর রোযার দিন ঈদও হয় না। তাছাড়া, এক লহমার জন্য যদি মেনে নেওয়া হয় যে, সোমবারে রোযা রাখার মাধ্যমে তিনি (সা) জন্মদিন পালন করেছেন, তাহলে তো প্রতি সোমবারে আমাদের ঈদ-ই-মিলাদ উদযাপন করতে হয়; আর তা হতে হবে সিয়াম পালনের মাধ্যমে; খেয়ে-দেয়ে, নানা রকমের আলোকসজ্জার মাধ্যমে কখনই নয়!
বরং আমি মনে করি, সারা বছর ধরে তাঁর (সা) জীবন ও কর্ম নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সমাজে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ, নিজ আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন কাজকর্মে তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা-ই হবে তাঁর (সা) প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
[পূবের কলম, ৯ নভেম্বর ২০১৮-তে প্রকাশিত]

1 comment:

  1. website tike sajan https://www.youtube.com/watch?v=ZH6FkVKFT0A&list=PLf3qsnGljClRFWE4_kS1gQiPOKJFxEEg8&index=2

    ReplyDelete