Sunday 17 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ সেদিনের কালবৈশাখীতে

সেদিনের কালবৈশাখীতে

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

সেদিন বিকেলে, সূর্য তখন সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে গিয়ে বসেছে হাঁড়িয়া কোণের তালগাছটার মাথায়। একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আমি বাবার কেনি আঙুল ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি শাটিমারি হাটের পথে। আমার শৈশবজুড়ে শাটিমারি একটি রোমাঞ্চকর নাম; সেখানে গিয়ে বাবার কিনে দেওয়া এক টাকায় দুটো শিঙাড়া খাওয়ার কী যে মজা তা বয়ান করবার মতো শব্দ আমার অভিধানে নেই।

ছোটবেলায় আমাদের আর একটা ক্র্যায ছিল মেঘু। মেঘু কাকু পাশের গ্রাম আঁচরইলে থাকতো। রোজ বিকেলে তার ছোট্ট ডালিটা কাঁখে নিয়ে এসে হাজির হতো আমাদের পাড়ায়। তার বাঁধাধরা ক'টা খদ্দের ছিল আমাদের গ্রামে-- আমি, আমিরুল, নাসি, বিমল ও দেলোয়ার। মেঘু কাকু আমাদের বাড়ির কাছে এসে জোরে হাঁক ছাড়ত-- "পাঁ--পড় নিবেন নাকি বো পাঁপড়; গরম গরম পাঁপড়..."। ওর কণ্ঠ শুনে আমরা যেখানেই থাকি না কেন মুহূর্তের মধ্যে হাজির। সাথে চাল, কেউ বাটিতে করে, তো কেউ প্যান্টের পকেটে, কেউ আবার জামা বা গামছার এক প্রান্তে গুটিয়ে। আসলে মা' তো রোজ চাল আনতে দিত না। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, বিকেল হলে আমরা অনেকেই বায়না ধরতাম-- "মা বো মুই আইজকা মেঘুক খাম" (মা, আমি আজকে মেঘুকে খাবো)।

সেদিন হাটে পৌঁছে, যথারীতি আগে শিঙাড়ার দোকানে গেলাম। সেখানে বসিয়ে আমার হাতে দু'টো শিঙাড়া ধরিয়ে দিয়ে বাবা চলে গেলেন বাজার করতে। আর আমি বসে বসে শিঙাড়া খেতে লাগলাম মনের সুখে। ওদিকে ততক্ষণে মেঘের কাছে পরাজয় বরণ করেছে সূর্য। আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের আলোআঁধারিতে সূর্য কোথায় যে লুকিয়ে পড়েছে তার কোন আতাপাতা নেই। সাথে মেঘবালিকারা একে অপরকে ডাকাডাকি, তর্জনগর্জন শুরু করেছে ভীষণভাবে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি যেন তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। এসব দেখে বাতাসও আর বসে থাকল না। পিছিয়ে থাকল না বৃষ্টিও। মুহূর্তের মধ্যে সারা হাটজুড়ে একটাই শব্দ উচ্চারিত হতে লাগল, কালবৈশাখী!

বাবা কোথা থেকে সুপারম্যানের মতো উড়ে এসে এক হাতে আমাকে আর অপর হাতে হাটের ঝোলাটা নিয়ে ছুটতে লাগলেন। কোনোরকমে গিয়ে মাথা গুঁজলাম হাটের পশ্চিম-উত্তর কোণে মন্দিরের চালায়।

নিমেষেই ভরে গেল চালা। মাটির ঘরটাও ভর্তি হয়ে গেল। বাইরে তখন প্রবল বেগে বাতাস বইছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে শিলাবৃষ্টি নৃত্য করছে। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি আলোকসজ্জার কাজ করছে। আর হঠাৎহঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে আমাদের মনে। স্বভাবতই মুখ থেকে বেরোচ্ছে কী হবে এখন!

আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আমিও ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। বাঁচার জন্য যে যার মতো করে প্রার্থনা করছে। গুটিসুটি হয়ে খাপটি মেরে জাপটে ধরে আছি বাবার হাতটা। ঝড়ের তীব্রতা কোনোমতেই কমছে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ গোপেশ জ্যাঠুর। তবুও নাগাড়ে আওড়ে চলেছে মন্ত্র। মাথা নত করে আমাদের সবার জন্য প্রার্থনা করছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে দেবীর সম্মুখে। অন্যদিকে তখন বালা যাতে টলে যায়, সবাই যাতে মসিবতের হাত থেকে রেহাই পাই তার জন্য বিড়বিড় করে দুআ করছে সুভান বড়-আব্বা। কিন্তু ঝড়ের হম্বিতম্বি বেড়েই চলেছে। কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা থামার কোন নামই নিচ্ছে না। সুভান বড়-আব্বা দিশা-দুয়ার, কূল-কিনারা না-পেয়ে ঐ চালাতেই জোরে জোরে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলে আজান দিতে লাগলেন (মুসলিম সমাজে বিপদের সময় রক্ষা পেতে আজান দেওয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে। বিষয়টি তত্ত্ব ও তথ্যের নিরিখে কেমন তা আমার জানা নেই।)। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ঝড় থামল। আর আমরা যে যার বাড়ি ফেরত গেলাম।

সেদিনের ঐ ঘটনা সেখানে উপস্থিত কারোরই দৃষ্টিকটু মনে হয়নি। এমনকি এলাকায় কেউ কিছুই ভাবেনি। কিন্তু অমন ঘটনা যদি আজ কোথাও, কোনো মন্দিরে বা মসজিদে বা গির্জায় ঘটে; তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখুন। কত নিরপরাধ প্রাণের বলি চড়বে। দেশের কত সম্পদ নষ্ট হবে। বিঘ্নিত হবে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ। ভেঙে যাবে বিমল ও কামালের বন্ধুত্ব। সাদিয়া-সুস্মিতার মাঝে তৈরি হবে ঘৃণার এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। শুধু লাভ হবে রাজনীতির কারবারিদের...!

১৭-০৩-২০১৯
তপ্সিয়া, কোলকাতা

No comments:

Post a Comment