Tuesday 5 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ ক্লাস ওয়ান থেকে টু’য়ে



ক্লাস ওয়ান থেকে টু’য়ে

তারপরের দিন সকালে যথারীতি গিয়ে ক্লাসে বসলাম।  গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস থ্রি পাশ করে যাওয়ার সুবাদে বাংলা, অংক এবং ইংরেজিতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। গ্রামের মক্‌তবে উর্দু ও আরবি শিখেছিলাম। তাই উর্দু পড়ার পাশাপাশি একটু আধটু বলতে ও লিখতেও পারতাম। বুঝতামও খানিকটা। কিন্তু আরবি পড়তে পারলেও তেমন লিখতে পারতাম না। বুঝতে তো পারতামই না। কারণ, আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গারই একই অবস্থা, আরবি অনেকেই পড়তে শেখে কিন্তু লিখতে, বুঝতে এবং বলতে শেখে না। এমনকি যারা আরবিতে গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স করেছে বা করে তাঁদেরও অনেকে সঠিকভাবে আরবি লিখতে ও বলতে অক্ষম।

যাইহোক প্রথমদিন, অচেনা পরিসর, এক অদ্ভুত রকমের আড়ষ্টতা নিয়ে ক্লাস ওয়ানের শ্রেণীকক্ষে ঢুকলাম। এবং টিফিনের আগের প্রায় সবকটা পিরিয়ডই মোটামুটি ভাবে উতরে গেলাম। টিফিন বিরতিতে বইখাতা ক্লাসে রেখেই ফিরে গেলাম রুমে। হস্টেলের মাত্‌বাখ (রান্নাঘর) থেকে পাওয়া এক চামুচ সেদ্ধ ছোলা আর বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া এক বাটির মতো মুড়ি সর্ষে তেলে মেখে টিফিন করলাম। তারপর গেলাম ক্লাসে। টিফিনের পর প্রথম পিরিয়ডটা ছিল আরবির। পড়তে পারলেও মানে বুঝতাম না। তাই কী করবো, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঐ দিকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেই এক এক করে সবাইকে নির্ধারিত অংশের অর্থ জিজ্ঞেস করছিলেন। না পারলে, ছড়ি দিয়ে হাতের তালুতে আঘাত করছিলেন। আমি বসেছিলাম দ্বিতীয় লাইনে। ভয়ে, শুনে শুনে ঐ অংশটুকুর অর্থ মুখস্থ করে ফেললাম। যখন শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, না-দেখে পুরোটাই মুখস্থ শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি যাতে বুঝতে না পারেন, তার জন্য  বইয়ের উপর খামোখা আঙ্গুল ফেরাচ্ছিলাম। 

ক্লাস শেষে ফিরে গেলাম হস্টেল বিল্ডিঙে। যোহরের সালাতের (মধ্যাহ্ন প্রহরের নামায) আধ ঘণ্টা আগে ছুটি হয়েছিল। দ্রুত স্নান সেরে মসজিদে গেলাম। নামায শেষে ঘরে ফিরে থালাটা নিয়ে ছুটলাম মাত্‌বাখের দিকে। ছোটদের আলাদা লাইনে দাঁড় করানো হতো। কখনো কখনো একই লাইনে সবাইকে দাঁড় করানো হতো, সেক্ষেত্রে বড় দাদারা ছোট ভাইদের লাইনের প্রথমে পাঠিয়ে দিতেন। তাই গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনের প্রথমে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল জামিল (বাবুর্চি) কাকু। তিনটে বড় বড় গামলায় ভাত, তরকারী ও ডাল। ভাত ও তরকারীর গামলার দায়িত্বে দুজন শিক্ষক আর ডালের দায়িত্বে এক সিনিয়র দাদা। এবং এই পুরো সিস্টেমটাই রুটিন মাফিক ভাগ করা ছিল শিক্ষক ও কিছু সিনিয়র দাদাদের মাঝে। সেদিনের দায়িত্বে ছিলেন মাস্টার আব্দুর রশিদ ও ইউসুফ। তবে ডালের দায়িত্বে থাকা ঐ দাদার কথা মনে করতে পারছি না এখন। যাইহোক ভাত-ডাল-তরকারী নিয়ে কামরায় ফিরলাম। হস্টেলের খাবার কেমন হয় তা অনেকের জানা। বিশেষ করে হস্টেলের ডাল; সমুদ্রে মুক্তো খুঁজতে ডুবুরী যেমন পরিশ্রম করে ঠিক তেমনই মুশুরের দানা খুঁজতে হস্টেলের আবাসিকরা। স্বভাবতই অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করলাম। 

উপমহাদেশের বেশির ভাগ মাদ্‌রাসায় মধ্যাহ্ন ভোজনের পর, আসরের সালাত (বিকেলের নামায) পর্যন্ত ছেলেরা যে যার কামরায় (রুমে), কেউ হাতের লেখা লেখে, কেউ হোমওয়ার্ক করে, কেউ বসে বসে বই পড়ে, আবার কেউ বেঘোরে ঘুমোয় তো কেউ ক্বায়লুলাহ্‌ (মধ্যাহ্ন ভোজনের পর শুয়ে, তবে জেগে একটু আরাম করা। এবং নবি (সা) প্রায়শই এভাবে দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নিতেন। তাই এটি একটি সুন্নত রূপে সমাদৃত) করে। তখন আমি জাহাঙ্গীর কাকুর রুমে থাকতাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেদিন ক্লাসে কী কী হয়েছে সব কাকুকে খুলে বললাম। শেষে বললাম, “কাকু আমি না সব পারছি। শুধু আরবি আর হিন্দিতে একটু অসুবিধাআমার মনে হয় ক্লাস টু’তে ভর্তি হলে ভালো হবে!”

জাহাঙ্গীর কাকু ও তার রুমমেটরা সবাই মিলে আমাকে একদিনেই হিন্দি পড়তে এবং একটু আধটু লিখতে শিখিয়ে দিল। আমি উর্দু ভাষা টুকিটাকি জানতাম, ফলে হিন্দি বুঝতে আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কেন না ঐ দু’টো  ভাষা তো সহোদরা। একটা যদি মা হয়, তো আরেকটা হল মাসি। সন্ধ্যাবেলা, মাগ্‌রিবের সালাত (সূর্যাস্তের নামায) আদায়ের পর ওদের শেখানো কৌশল অনুযায়ী সালাম দিয়ে ঢুকলাম প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসে। কাঁদো কাঁদো স্বরে আমার সব কথা বললাম। হিন্দি বইটা সামনে ধরে ‘লাল মুর্‌গি কুক্‌ কুক্‌ কুক্‌’ গল্পের প্রথম পাতাটা এক শ্বাসে পড়ে ফেললাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, “যাও কাল থেকে ক্লাস টু’র ঘরে বসবে”
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

No comments:

Post a Comment