Sunday 17 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ জল ও জীবন এবং আমি...!


Image result for লাঙ্গলের পেছনে ছোট ছেলে
জল ও জীবন এবং আমি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম



আমি তখন খুব ছোট। পড়ি কদমডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সকালে উঠে, কিছুক্ষণ বইখাতা নিয়ে বসতাম। তারপরে খেয়েদেয়ে বাবার সাথে যেতাম মাঠে। বাবা হাল বাইতেন আর আমি বাবার পেছন পেছন থাকতাম। বর্ষাকালে সঙ্গে থাকতো একটি থলে। তখনকার দিনে হাল-চাষের সময় জলের সাথে ভেসে আসত ছোট ছোট মাছ। সেগুলি ধরে থলের মধ্যে রাখতাম। দুপুর বেলা বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দিতাম সেই মাছগুলি। আবার আলু তোলার পর আলুর খেতে হাল বাইলে, খুঁজে না-পাওয়া আলুগুলো বেরোতো; আর আমরা সেগুলো কুড়িয়ে থলেতে, কখনো হাফপ্যান্টের পকেটে, কখনো লুঙির কোছায় রাখতাম। প্রায়ই মাঠের আলে বসে কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা দিয়ে বাবার সাথে পান্তাভাত খেতাম পরমানন্দে। 

তখন আমাদের গ্রামে জলের ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না; টিউব-ওয়েলের পাশাপাশি লোকে কুয়োর জলও খেত। আমাদের অত বড় গ্রামে মাত্র তিনটে টিউবওয়েল ছিল; পূব পাড়ে একটা, পশ্চিম পাড়ে একটা, আর একটা আমাদের বড়-বাড়িয়াতে। তবে কুয়ো ছিল বেশ ক'টা। খোদ আমাদের বাড়িতেই ছিল একটা। কুয়োর জলে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, চান করা সবই করতাম। এমনকি পানও করতাম। 

সেদিনগুলিতে জল পান নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না কারোর। এর জন্য অবশ্য কলেরা-ডাইরিয়ার মতো মহামারী এবং অত্যন্ত ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয়েছে প্রান্তিক মানুষদের। সেসময় স্কুলে গিয়ে আমরা তুলাই নদীর জল পান করেছি। উত্তরের মাঠে গেলে বাটুয়াদীঘির জল, পূবের মাঠে গেলে ফকিরকুড়ির জল, এছাড়াও পুকুরের জল, গাঙের জল, চৌকার জল আমাদের তেষ্টা মিটিয়েছে। 


তারপর এক দীর্ঘ যাত্রা, প্রায় কুড়ি বছরের...। 
এখন আমি থাকি কোলকাতায়। ভালো মাইনের সরকারী চাকরি করি। কলেজে গেলে অ্যাকুয়াগার্ডের জল আর ফ্ল্যাটে মিনারেল ওয়াটার; এর বাইরের জলের সাথে আমার জিভের আর তেমন সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। এখনো যখন মাঝেমধ্যে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাই, দেখি অসংখ্য মানুষ, পুরুষ-মহিলা সকলে চৈত্রের জ্বলন্ত দুপুরে খাঁ খাঁ মাঠে কাজ করছে; মাথায় একটা ছেঁড়া লুঙি বা এক ফালি কাপড়। গায়ে বহু পুরনো জীর্ণ একখানা গেঞ্জি। কারুর অবস্থা আরও করুণ...। 

তবে তাঁরা এখন আর গাঙের জল খায় না। বাড়ি থেকে প্লাস্টিকের বোতলে করে জল আনে। সেই বোতল পুকুরের জলে বা গাঙের পানিতে বা খেতের কাদাজলে ডুবিয়ে রাখে; যাতে জল গরম না হয়। এসব দৃশ্য দেখে আমার অজান্তেই হাতদুটো প্রসারিত হয়। স্মৃতি আর বাস্তবের সংগমে দাঁড়িয়ে হাতড়াই বাবার সেই হাতদুটো। খুঁজি, আর খুঁজে চলি; কিন্তু খুঁজে আর পাই না...। 

ক'দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসি আবার এই তিলোত্তমার বুকে। যেখানে এখন শুধুই স্বার্থের গন্ধ। কংক্রিটের বিশাল জঙ্গল, আরও কতকিছু। তবে এখানেও সবাই অ্যাকুয়ার জল পায় না। মিনারেলও না। টাইম-কলের পাশে লম্বা লাইনে দাঁড়ায় বালতি-বোতল-গামলারা। মারামারি-হাতাহাতি-ঝগড়াও করে মালিকেরা। 

সুদীর্ঘ সংগ্রামের পরে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। হয়তো তার চেয়েও দীর্ঘ সংগ্রামের প্রয়োজন এক ফোটা স্বাদু ও পেয়ো জল সবার মুখে তুল দিতে। তাই প্রস্তুত হতে হবে এখনই। আরো একটা লড়াই লড়তে হবে। তবে এবারের লড়াইটা হবে জীবনের জন্য; জলের জন্য...।   

১৭-০৩-২০১৮
পার্কসার্কাস, কোলকাতা

No comments:

Post a Comment