Saturday 12 October 2019

জল-সংরক্ষণ ও ইসলামী চেতনা


জল-সংরক্ষণ ও ইসলামী চেতনা
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
আমরা সকলেই জানি যে, সুস্থ সুন্দর জীবনধারণের জন্য প্রতিটি প্রাণিরই ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না। এবং পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু হলো জল জল ছাড়া আমাদের জীবন সম্পূর্ণ রূপে অচল। তাই “জলের অপর নাম জীবন”।  
নিঃসন্দেহে জল স্রষ্টার এক মূল্যবান আশীর্বাদ; কবির ভাষায়— “এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/ খোদা তোমার মেহেরবাণী”। পবিত্র আল্‌-কুর্‌আনে তেষট্টি জায়গায় জলের উল্লেখ রয়েছে। জল যে প্রাণী সৃষ্টির মূল উপাদান, তা এভাবে ঘোষণা করা হয়েছে— প্রাণবান সবকিছুই আমি জল হতে সৃষ্টি করেছি।” [সূরা আল্‌-আম্বিয়া ৩০], “আল্লাহ জল থেকে সব জীব সৃষ্টি করেছেন” [সূরা আন্‌-নূর ৪৫] এবং জীবনধারণে জলের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে এভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, “আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি, পরিমিত ভাবেঅতঃপর আমি তা সংরক্ষণ করে রাখি ভূগর্ভে; আমি জলকে অপসারিত করতেও সক্ষম। এবং ঐ জল দিয়ে আমি তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করেছি, যেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে অনেক ফলমূল, যা তোমরা আহার করো। [সূরা আল্‌-মু‘মিনূন ১৮-১৯] পাশাপাশি, পৃথিবীর কোনো কিছুই যে অকারণে সৃষ্টি করা হয়নি সে-কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—“এবং পৃথিবীতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি।” [সূরা আল্‌-হিজ্‌র, আয়াত- ১৯]  
পরিবেশ বলতে আমরা বুঝি সুন্দর, উন্নত পরিচ্ছন্ন চারপাশ জল হচ্ছে এই পরিবেশের প্রধান প্রাকৃতিক উপাদান জল ছাড়া গাছপালা, বন-বনানী, নদী-নালা, পশু-পাখি কল্পনাও করা যায় নাজলের অস্তিত্ব প্রাণের অস্তিত্বের পূর্বশর্ত এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর ঘোষণা— তিনিই (আল্লাহ) স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুবার্তাবাহী বায়ু প্রেরণ করেন। এবং আমি (আল্লাহ) আকাশ হতে পবিত্র বারি বর্ষণ করি; যা দ্বারা আমি মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং আমার সৃষ্টি জগতে বহু জীবজন্তু মানুষকে তা পান করাই।” [সূরা আল্‌-ফুর্‌ক্বান ৪৮-৪৯]
নিঃসন্দেহে জীবনধারণের ক্ষেত্রে নদীনালা ও সমুদ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই নদ-নদী ও সমুদ্র জলের অন্যতম উৎস ও আধার। মহান স্রষ্টা সমুদ্র ও নদীনালার জল হতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীজগতের উপকৃত হওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন এবং তিনি নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন” [সূরা ইব্‌রাহিম ৩২]। নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রের মাছ পৃথিবীর খাদ্যাভারের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাছাড়া সমুদ্রগর্ভে রয়েছে অফুরন্ত প্রাচুর্য ও সম্পদ। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন— “দু’টি সমুদ্র সমান নয়একটির পানি মিঠা, কোমল ও তৃষ্ণানিবারক এবং অপরটি নোনা ও তিক্ত। কিন্তু তোমরা উভয় সমুদ্র থেকেই তাজা মাংস আহার করো এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ করো আর তুমি দেখতে পাও, সমুদ্রের ঢেউ চিরে এগিয়ে চলেছে (কতশত) জাহাজ; যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ উপভোগ করতে পারো। (এসব জেনে-বুঝে) হয়তো তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।” [সূরা আল্‌-ফাতির ১২]। এবং, বাঁধ-প্রকল্পের সাহায্যে নদীর জল দ্বারা ফসল ও বাগান সেঁচের যে ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে, তার প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন—“আর তিনিই পৃথিবীকে স্থির ও বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে সৃষ্টি করেছেন বহু নদ-নদী [সূরা আন্‌-নাম্‌ল ৬১]
তাছাড়া, জলকে ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ জলকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অযু, গোসল ও বহু ইবাদত জল ছাড়া সম্ভবই না। তাই জলের স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
অন্যদিকে, সুস্থতার জন্য পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত পানীয় জল সবার প্রয়োজন। পানীয় জল যাতে কোনোভাবে দুষিত না হয়, এ জন্য নবী (সা) বহু আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, “তোমরা পান করার সময় ঐ জলের মধ্যে নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে না বা ফুঁ দেবে না” [তিরমিজি ১৪১০]। যাতে নিঃশ্বাসের সাথে যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় তা পানীয় জলকে দূষিত না করে দেয়।
আমরা জানি যে, জল দূষিত হলে মাটি, বায়ু এবং খাদ্যও দূষিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৬০ ভাগ জলই দূষিত। যার ফলে নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ ও পশুপাখি। এই জল দূষণের মূল কারণ হলো নর্দমার ময়লা, কারখানার বর্জ্য পদার্থ, মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র, কীটনাশকের মিশ্রণ প্রভৃতি। তাই ইদানীং বিশ্বব্যাপী জলকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। সুপেয় পানির অভাব এখন মানুষকে রীতিমত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের আশংকা, চলমান শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে যদি বড় ধরণের কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হয় তা হবে বিশুদ্ধ জলকে কেন্দ্র করে তাই জলকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য এর উৎসগুলি অর্থাৎ নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ইত্যাদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এবং এজন্যই নবী (সা) জলে আবর্জনা, মলমূত্র ও বর্জ্য ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, “তোমরা তিন প্রকার অভিশপ্ত কাজ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখো। সেগুলি হলো জলের উৎসসমূহে, রাস্তা-ঘাটে ও বৃক্ষের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করা” [সহিহ আবু দাউদ ২৬, সহিহ ইব্‌নু মাজাহ্‌ ২৬৬, ইর্‌ওয়াউল্‌ গালীল ৬২, আল্‌বানি (রাহ) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]।
পুকুর, নদী বা অন্যান্য জলাশয়ের জল যাতে দূষিত না হয়, তার জন্য নবী (সা) নির্দেশ দিয়েছেন—তোমরা আবদ্ধ জলে জলাশয়ের অর্থাৎ জমা জলে প্রস্রাব করবে নাপ্রস্রাব করে জলকে দূষিত করে আবার সেখানে গোসল করবে, এমনটা যেন না হয়”। [মুসলিম ৪২৪]
পাশাপাশি, যেসব বস্তু জলের স্বাদ, গন্ধ ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটায়, সেগুলো জলে ফেলা যাবে না। তাতে জল অপবিত্র ও দূষিত হয়ে যায়। জল যাতে আকাশের মেঘ থেকে নেমে আসা বারিধারার মতো স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন থাকে তার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। কোরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আকাশ থেকে বর্ষিত জলের একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতি রয়েছে। তা নির্মল, বিশুদ্ধ ও সুপেয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছে, “আমি তোমাদেরকে পান করাই সুপেয় জল” [সূরা আল্‌-মুর্‌সালাত ২৭] জল যেমন মানুষের জীবনকে চলমান রাখে এবং জল ছাড়া মানুষ একদিনও টিকতে পারে না, ঠিক তেমনি জলের মাধ্যমে বহু ধরণের রোগব্যাধিও ছড়ায়, যা অনেক সময় মানুষের জীবন সংকটাপন্ন করে তোলে। সুতরাং জলকে জীবাণুমুক্ত রাখা ও দূষণের হাত থেকে বাঁচনো আমাদের একান্ত কর্তব্য।
ইদানীং আমরা সকলেই অধিক জল ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। জলের অপব্যবহার বা অপচয় একটা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু শহরে টাইম কলের জল নদীর মতো বয়ে চলেছে, বলার কেউ নেই, দেখারও কেউ নেই। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। যদিও কিছু মানুষ ইদানীং বেশ সচেতন সব বিষয়ে, তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। কিন্তু ইসলাম সূচনালগ্ন থেকেই এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। নবী মুহাম্মদ (সা) নিজে “এক মুদ্‌ (আনুমানিক ৬২৮ মিলি লিটার) জলে অযু করতেন, আর গোসল করতেন এক সা’ (আনুমানিক ২.৫ লিটার) জলে” [মুস্‌লিম ৩২৫]। এবং এবিষয়ে তিনি নিজ অনুগামীদেরকেও সচেতন করেছেন। আদেশ করেছেন— তোমরা জল অপচয় করবে নাযদিও তোমরা বহমান নদীর তীরে থাকো” [মুস্‌নাদ আহ্‌মাদ ৬৭৬৮, ইব্‌নু মাজাহ্‌ ৪১৯, সিল্‌সিলাতুল্‌ আহাদিস আস্‌-সাহীহা ৩২৯২]  
মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সবকিছুই, পানাহার, পোশাক-আশাক ও সাজসজ্জা বৈধ পন্থায় ভোগ করার অনুমতি দিয়েছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করেছেন। যার অন্যতম হলো, কোনো কিছু অপচয় করা যাবে না; বিশেষ করে জল। কারণ জলের অপচয় জীবন ধ্বংসের নামান্তর। কোরআনে নির্দেশ, “তোমরা পানাহার করো; তবে অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না। [সূরা আল্‌-রাফ ৩১]। এজন্য জল অপচয় করা, বিনা প্রয়োজনে জল নষ্ট করা পরিবেশ-বিচারব্যবস্থার আওতায় একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল আটকে রেখে অন্য কাউকে সংকটের মুখে নিক্ষেপ করাও ঘোরতর অপরাধ। নবী (সা) বলেছেন, ঘাস উৎপাদন থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকে রাখা যাবে না [বুখারি ২২৫৪, ২২৫৫]
যেহেতু, আব-হাওয়া বা জল-বায়ু প্রকৃতির এবং আমাদের জীবনধারণের প্রধান জরুরী উপাদান। তাই জল ও বাতাসকে দূষণমুক্ত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব সামাজিক কর্তব্যভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, এই গ্রহের নিরাপত্তার জন্য আমাদেরকেই জল-বায়ু সংরক্ষণ করতে হবে, জলকে দূষণমুক্ত করতে হবে এবং জলের অপচয় রোধ করতে হবেপাশাপাশি আরও যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা সংরক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে মানব সভ্যতায় নেমে আসবে ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং সে-সবের জন্য, মানব সভ্যতার ধ্বংসের জন্য আমরাই দায়ী হব। এবং এ বিষয়ে আল্‌-কুর্‌আন আমাদেরকে এভাবে সচেতন করেছে যে—“জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটে মানুষের কৃতকর্মের ফলে” [সূরা আর্‌-রূম ৪১]।
অতএব জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাকে দূষণমুক্ত করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। কারণ জল সংরক্ষণ মানেই হল পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। তাই আমি বিশ্বাস করি, জল অপচয় রোধ করে, জলদূষণ বন্ধ করে পৃথিবীকে সুশীতল, বাসোপযোগী এবং সবুজ করিডোরে রূপান্তরিত করা একজন মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।  

[পূবের কলম, ২৫ অক্টোবর ২০১৯, দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment