Saturday 26 October 2019

বদিউর রহমানঃ লেখালেখির জ্বালা



লেখালেখির জ্বালা
বদিউর রহমান
[কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের টি-ক্লাবের আড্ডায় পঠিত]

আমি তখন আজাদ কলেজে পড়ি। থাকি বেকার হস্টেলে। আমার রুমের ক’টা রুম পরেই থাকত একটি ছেলে। আমার থেকে এক বছর জুনিয়র। ছেলেটি কাব্যচর্চা করতো। মাঝেমধ্যেই দু’একটা কবিতা শোনাতো আমাকে। দু-একবার তার কবিতা শোনার পর কিছু একটা মন্তব্য করেছিলাম। তাতে তার প্রত্যয় জন্মায় যে আমি একজন সমঝদার শ্রোতা। একদিন হস্টেলের কয়েকজন মিলে হিন্দ সিনেমায় বিকেলের শো’ দেখতে যাচ্ছি এমন সময় সেই কবি আমাকে দেখতে পেয়ে ‘রহমানদা’ বলে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে দাঁড়ালাম। আমার সঙ্গীসাথীরাও অপেক্ষা করতে লাগল। কবি অনুরোধ করল তার সদ্য লেখাটা শুনতে হবে। বললাম আগামিকাল শুনব। সে নাছোড় বান্দা। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে সকলে মিলে ছবি দেখতে বেরিয়েছি। ফিরে এসে কবিতা শুনব। কিন্তু তার অনুনয়-বিনয়ে বাধ্য হয়ে অন্য সকলকে সিনেমা হলে চলে যেতে বললাম। কবি প্রতি বারের মত একটা রেষ্টুরেন্টে চা খাওয়াতে খাওয়াতে অমাকে তার কবিতা শুনিয়ে, ঐ কবিতা সম্পর্কে আমার মন্তব্য শুনে তারপর আমাকে ছাড়ল। ওদিকে তখন এক রিল ছবি হয়ে গেছে।
তখন ঠিক উপলব্ধি করতে পারিনি লেখার পর শ্রোতার জন্য কেন সে অমন আকুলি-বিকুলি করছে। যারা সাহিত্য চর্চার ধৃষ্টতা করেন তাদেরকে প্রায়শঃই শ্রোতার জন্য ঐ রকম ছটফট করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদার অবস্থাও তথৈবচ ছিল। বাড়ীর ছোটরাও সন্তর্পনে তাঁর সান্নিধ্য এড়িয়ে চলত তাঁর লেখা শোনার আতঙ্কে। শ্রোতা যে একেবারে জুটতো না তা নয়। আগ্রহ ভরে শ্রোতা হিসাবে দেখা যেত শ্রীকণ্ঠবাবু, অক্ষরচন্দ্র চৌধুরীকে। তাঁর আর একজন শ্রোতা সম্পর্কে অবশ্য রহস্যভেদ হলে জানা যায় যে তিনি শ্রোতা হওয়ার আবদারে বড়দাদার কাছ থেকে নিত্য টাকা ধার করতেন – যা পরিশোধ করেছেন বলে আজও জানা যায়নি। ইদানিং সাহিত্য অনুরাগে ভাঁটা পড়ায় শ্রোতার আকাল। তাই লেখালেখির ঐ জ্বালা নতশিরে মেনে নিয়েই লিখতে হয়। তার কারণ লেখা হ’ল একধরণের ব্যারাম। মৃগি রোগের মত যে কোন সময় ঐ রোগ মাথা চাড়া দিতে পারে। তখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে লেখা বেরিয়ে আসবে যেমনটি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-তে কবিবরের হয়েছিল। তাঁর নাকি ওই ব্যারামটা নিত্য দেখা দিত। বোলপুরের অনেক আদিবাসী কাকভোরে বহুবার দেখেছেন এক সাধুকে দৌড়ে তাঁর মাটির বাড়িতে ঢুকে পড়ে টেবিল-চেয়ারে বসে কী সব লিখে যেতে।
কবি সাহিত্যিকদের সেই আবেগ দুর্বার। তা রোখে কার সাধ্যবাধা পেলে সেই আবেগ বিভিন্ন ধারায় খরস্রোতা নদী হয়ে বয়ে যাবেই যাবে। তাঁর কলম থামানো যাবে না। লেখা বেরিয়ে আসবেই। যারা প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক তাঁদের পাঠক, শ্রোতার অভাব হয়না। কিন্তু ইদানিং আমার শ্রোতার ভাঁটা পড়েছে। একদিন ছিল যখন আমার প্রথম শ্রোতা ছিল আমার মেয়েসে মন দিয়ে শুনতো। মন্তব্য করতো। কখনো আরও মার্জিত করতে বা বাকশৈলীর পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে বলতো। আমি তার সমালোচনা মন দিয়ে শুনে অনেক পরিবর্তনও করতাম। কিন্তু সে এখন নেই বলে লেখালেখির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা শ্রোতার কেমন হয় তা অনেক সময় জানতে পারি না। আমার স্ত্রী আমার লেখা কোনো কালেই শোনেননি। যখনই বলি, দু-মিনিট শোনার পরেই বলে ওঠেন ‘গ্যাসের উপর দুধ বসানো আছে, আসছি’। বলে সেই যে উধাও হন তাঁর আর দেখা মেলে না। আসলে সাহিত্য চর্চায় তাঁর রুচি কম। সেদিক থেকে আমার শাশুড়ি বরং সাহিত্য-রসিক। সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক এবং শারদীয়া সংখ্যা নিবিষ্ট চিত্তে তাকে পড়তে দেখেছি বহুদিন। তিনি একবার বলে বসলেন “বাবা, শুনেছি তুমি নাকি লেখালেখি কর? তা একটু শোনাও তো দেখি।” অতীব আনন্দিত হয়ে একটা রম্যরচনা ও আর একটা ছোটগল্প শোনালাম। ছোটগল্পের মুখ্য চরিত্রকে মেরে ফেলার জন্য উনি দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন ‘সবে একটু শান্তিতে জীবন কাটাতে আরম্ভ করেছিলেন। তাকে অত নিষ্ঠুরভাবে শেষ না করে দিলেও পারতে।’ শ্রোতার মধ্যে আমার মেয়েও উপস্থিত ছিল। তার মন্তব্য ‘গল্পটার Climax টা তো ওখানেই। ওই করুণ সুরটার রেশ পাঠকের হৃদয় ছুঁতে সহায়ক। তাই শেষটা ঠিকই আছে।’ তারপর অতি বিনয়ের সঙ্গে শাশুড়িকে বলি দু-চারটে কবিতাও লিখেছি। উনি ঔৎসুক্য দেখালে ছন্দ ও অন্তমিলহীন দুটো কবিতা শুনালাম। যৎসামান্য তারিফ করলেন। একটা কবিতা সরিয়ে রাখছিলাম। জিজ্ঞেস করলে বললাম “ওটা থাক, ওটা প্রেম সর্বস্ব।” উনি বললেন, “তা হোক, শোনাও তুমি।” সাহস পেয়ে কবিতাটা শোনাতে থাকি। মাঝে মধ্যে আড় চোখে শ্রোতার মুখ লক্ষ্য করি। দেখি তিনি গম্ভীর থেকে অতি গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন। কবিতাটা শেষ করতেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন “বাবা তোমার মনের কোটরে কি সে রকম কেউ এখনও বাসা বেঁধে আছে?” আমি উপলব্ধি করতে পারি এক মায়ের উৎকণ্ঠার – জামাই কি কোন পরকিয়া শৃঙ্খলে আবদ্ধ! তাহলে মেয়ের ভবিষ্যৎ! মা হয়ে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। অবশ্য সে যাত্রাটা বাঁচিয়েছিল আমার ছোট শ্যালিকা। তার অভয় দেওয়াতে শাশুড়ি একটু নিশ্চিন্ত হন।
ওই কবিতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চা-চক্রেও শুনিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সে দিন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক স্বপন প্রামাণিক (পরবর্তী কালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন) উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বক্রোক্তিটা ছিল এ রকম “রহমান এই বৃদ্ধ বয়সে এসব কী লিখছে!” মন্তব্য শুনেছি বিভিন্ন। কখন সরস কখন তির্যক। একটা রম্যরচনা “ছাতাকাহিনী” চা-চক্রে শুনিয়ে আর এক অধ্যাপকের উক্তি “কোথা থেকে ঝাড়লেন।” আর একবার তিনি এক কবিতা শুনে খুবই যথার্থ মন্তব্য করেছিলেন “কী সব লেখেন! সবটাইতো বোধগম্যের বাইরে।” তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন তখনকার চলতি একটা সিনেমার গান ‘কোলাবরি’-এর মত চটকদার কিছু লেখা লিখতে। সেই কবিতাটায় আরবি-ফার্সি শব্দের বাহুল্যের কারণে এবং টীকাহীন অবস্থায় একটু দুর্বোধ্য হয়ে গিয়েছিল। আমার লেখালেখির কারণে অন্য এক বন্ধু (যিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলেজে প্রোফেসর হয়ে চলে যান) মন্তব্য করেন, “কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ভাগ্য রহমানদার লেখা শুনতে হচ্ছে।” তা তোমরা যে যা বলো ভাই আমি লিখে চলে যাই। আর লিখব নাই বা কেন? আমাকে চা-চক্রে শোনাবার জন্য কর্ম-কর্তা অধ্যাপক বন্ধুরাইতো হঠাৎ করে হুকুম করেন – ‘পরশু চা-চক্র, লেখা আনবেন’। বড় প্রকাশকরা যেমন যশস্বী কবি-সাহিত্যিকদের পূজো-সংখ্যার জন্য লেখার অগ্রীম বায়না করেন; আমার সঙ্গে বায়না হয় না সত্য কিন্তু হাতেগরমে লেখা শোনাোর হুকুম জারি হয়। যারা হুকুম চালান তাঁদের বদান্যতা এবং সহমর্মিতা আমাকে তাড়িত করে কিছু একটা লিখে শোনাতে। এক কথায় বাধ্য হয়েই আমার লেখা। বক্রোক্তিতে নিষ্ক্রিয় হওয়ার ভয়ভীতি ব্যাতিরেকেই লিখি। চা-চক্রে আদেশ হ’লে ঠাকুমা-র ঝুলি থুড়ি আমার চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করে আমার সাধ্যনুযায়ী লেখা শোনাই। কয়েকজন অধ্যাপক শোনেন। আর বিশিষ্টজনেরা উদাস হয়ে থাকেন। কেউ মন্তব্য করেন— ‘কাঁচা লেখা’। আবার কেউ বলেন ‘নকলনবিশ’ ইত্যাদি। আমার লেখার একটাই উদ্দেশ্য তা হ’ল চায়ের আড্ডায় একটুকু মজলিশি পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমি লিখে চলি, তা লিখলে কী হবে! শোনাবো কাকে! দু একবার এমনও হয়েছে, অর্ডার মাফিক লেখা লিখলাম। চা-চক্রে যথাসময়ে হাজিরও হলাম। আঘাতে জর্জরিত খেলোয়াড়ের মত সাইড-ট্র্যাকে বসে রইলাম। বার বার তিনবার চা-চক্রে গুরুগম্ভীর বক্তব্য পেশ করা হ’ল। তারপর আমার মতো নগন্য মানুষের লেখা শোনার আর কারও ধৈর্য থাকল না। তবুও চা-চক্রের উদ্যোক্তারা আমার দুর্বলতা বুঝে প্রতিবারই আমায় লেখা নিয়ে হাজির থাকতে বলেন। তাঁরা সম্যক জানেন যে আমার লেখা শোনা হবে বললে এ অধম নিশ্চিত হাজির থাকবে। তাদের অনুমানটি কয়েকবার নিষ্ঠুরভাবে সত্য প্রমাণিত হল। লেখা শোনানোর সুযোগ না পেয়ে আশাহত হয়েও প্রতিবারই ভেবেছি ‘আসছে বারে (আবার) হবে’।
আমি কিন্তু ওয়াকিবহাল ‘ধন্য আশা কুহকিনীর’ সত্যতা সম্বন্ধে। তা সত্ত্বেও আমার প্রত্যয় আমি লিখব। শ্রোতা না পাই ল্যাম্প পোষ্ট তো আছে! তাকে শোনাবো। হয়তো একদিন এমন আসবে যখন বাড়ি ফিরে কবিগুরুর পুরষ্কার কবিতার শেষ অংশ অনুযায়ী আমার একমাত্র পরম প্রিয় স্ত্রীকে বলতে পারব—
দেখ কী এনেছি বালা
নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন
তোমার কণ্ঠে দেবার মতন
রাজকন্ঠের (থুড়ি চা-চক্রের) মালা
দেখ কী এনেছি বালা !

০২-০৫-২০১৩


6 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো.। গল্পের ছলে স্যার এর ক্লাস গুলো মিস করছি।

    ReplyDelete
  2. সত্যিই খুব সুন্দর এবং অসাধারন । স্যার এর জীবনে ঘটিত প্রত্যেকটা গল্পই খুব ভালো লাগে।

    ReplyDelete
  3. Durdanto.............likhtey thakoon

    ReplyDelete
  4. অনেক দিন পর আবার আপনার লেখা পড়লাম এবং শোনালাম। শ্রোতার অভিব্যক্তিতে বোঝা গেল সেও আমার মতো লেখাটি উপভোগ করেছেন।

    ReplyDelete