Tuesday 5 October 2021

আন-নাহদা আল-আরাবিয়্যাহঃ আরব রেনেসাঁ



আন্‌-নাহ্দ়া আল্‌-‘আরাবিয়্যাহঃ আরব রেনেসাঁ
 
উনিশ শতকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও গতিশীল অর্থনীতি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলো। ফলে এই শতকে ইউরোপের সাংস্কৃতিক বিস্তার নতুন এক ধরণের আধিপত্যের সূচনা করে। পৃথিবীর অনগ্রসর অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ইউরোপের সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে এ অঞ্চলের সমাজে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।
 
আরব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেও এমন সংস্কারের প্রয়োজন ছিলকারণ পশ্চিম ইউরোপের সাথে আরব বিশ্বের শুধু আধিপত্য বিস্তারের সম্পর্ক ছিল না। ক্রুসেড সহ অন্যান্য ঐতিহাসিক কারণেও এ অঞ্চলে সম্ভাব্য পশ্চিমা আগ্রাসনের ভীতি তৈরি হয়েছিলএছাড়া আঠারো শতকে নেপোলিয়নের মিশর আক্রমণ ও উনিশ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যে গৃহীত তানজিমাত’-এর কারণে আরব বিশ্বে আন্‌-নাহ্দ়ানামে নবজাগরণ আন্দোলন শুরু হয়।
 
আন্‌-নাহ্দ়া'অর্থ রেনেসাঁএই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল একই রকম উনিশ শতকের শেষ ভাগ ও বিশ শতকের প্রথম ভাগে এর উদ্দেশ্য ছিল স্থবির আরব বিশ্বের জনগণের চেতনায় আধুনিকতা নিয়ে আসা এবং বিজ্ঞানমুখী সমাজ গড়ে তোলা  এই আন্দোলনের কথা আসলে প্রথম যাঁর কথা মনে আসে, তিনি রেফ়াআহ্‌ রাফ়েআত়্-ত়াহ্‌ত়াবী।  ১৮২৬ সালে মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলীর সরকারের সহায়তায় ফ্রান্সে বিজ্ঞান ও শিক্ষানীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে আসেন। তিনি প্যারিস মিলিটারি একাডেমির মিশরীয় বংশের ক্যাডেটদের ইমাম হিসেবেও কাজ করতেন। ফরাসি ভাষা শিখে তিনি এ ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসিক বইপত্র আরবিতে অনুবাদ করা শুরু করেন। ১৮৩০ সালে রাজা দশম চার্লসের বিরুদ্ধে ঘটিত তথাকথিত জুলাই বিপ্লবপ্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিলো। এসব ঘটনার বিবরণ ও মতামত তিনি মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলীর কাছে সাবধানে রিপোর্ট আকারে পাঠাতেন। প্রথম দিকে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ পূর্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল্‌-হারের দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলফ্রান্সে পড়াশোনা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতার ফলে তিনি নারী শিক্ষা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।
 
রেফ়াআহ্‌ রাফ়েআত়্-ত়াহ্‌ত়াবী  ফ্রান্সে পাঁচ বছর কাটিয়ে ১৮৩১ সালে মিশরে ফিরে আসেন। ১৮৩৪ সালে তাঁর লেখা বই তাখলিস আল্‌-ইবরিজ ফি-তাল্খিসি বারিজপ্রকাশিত হয়। এই বইতে তিনি ফ্রান্স ও পশ্চিমা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বেশ প্রশংসা করেন। মজার ঘটনা হচ্ছে, বইটি পদ্যাকারে লেখা হয়েছিলো। তিনি লিখেছেন, আরব বিশ্বের উচিত নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ঠিক রেখে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রগতির দিকটি গ্রহণ করা। তাঁর এই মত পরে আন্‌-নাহ্দ়ার অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল 
 
আন্‌-নাহ্দ়ার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ছিলেন বুত্রুসল্‌-বুস্তানি। ১৮১৯ সালে তিনি বৈরুতে এক লেবানী ম্যারোনাইট খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আমেরিকান মিশনারিদের দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাদের প্রভাবেই তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট মতে দীক্ষিত হন। স্থানীয় প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চে তিনি পুরোহিত হিসেবে কাজ করতেন। প্রোটেস্ট্যান্ট স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় বাইবেল আরবিতে অনুবাদ করায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। প্রথম দিকে আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হলেও পরে তিনি তাদের থেকে আলাদা স্বাধীন মতে আস্থা রাখতেন
 
ল্‌-বুস্তানি ১৮৬৩ সালে আল্‌-মাদ্রাসা আল্‌-ওয়াতানিয়া নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এই স্কুল সেক্যুলার নীতিতে পরিচালিত হতো। স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক আধুনিক চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন। আন্‌-নাহ্দ়ার পরবর্তী বহু চিন্তাবিদ এই স্কুলে ছাত্রজীবন কাটিয়েছেন। তিনি অনেক স্কুল পাঠ্যবই ও অভিধান প্রকাশ করেছিলেন। এসব বই আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তির দিক বিস্তারিত হতে সাহায্য করেছিলতিনি নাফির সুরাইয়ানামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। এই ম্যাগাজিন আরব বিশ্বে একটি শিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনস্ক অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভবে ভূমিকা রেখেছিলো।
 
ল্‌-বুস্তানির লেখালেখি ও চিন্তাধারা আধুনিক আরবি সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিকের বিকাশে সহায়তা করেছিলো। আমেরিকান মিশনারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেও তিনি দৃঢ় সেক্যুলার ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, আধুনিক সিরীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে আল্‌-বুস্তানি একজন অগ্রগণ্য চিন্তাবিদ ছিলেন।
 
আন্‌-নাহ্দ়ার আরেকজন প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন জামালুদ্দীন আফগানি। তিনি আরব বিশ্বের মুসলিম সমাজের তৎকালীন বদ্ধতার কঠোর সমালোচনা করতেন। তিনি মনে করতেন, ইসলামকে প্রথাগত সমাজের মানুষ এক ছোট নিগড়ে বন্দী করে ফেলেছে। মুসলিম সমাজের জাগরণ ও উন্নতির জন্য এই বদ্ধতার বাইরে এসে এই ধর্মের যুগোপযোগী নতুন ও কার্যকর ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনি ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের নীতি ও আরব বিশ্বের শাসকদের স্বৈরাচারী আচরণের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
 
জামালুদ্দীন আফগানির চিন্তাধারা অনেক ব্যক্তিকে আলোড়িত করেছিলো। তার মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন মোহাম্মদ আবদুহু। জামালুদ্দীন আফগানির মতো তিনিও মুসলিম সমাজের বদ্ধতার সমালোচনা করতেন। তাঁর মতে, আরব ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম সমাজ ইসলামের প্রাথমিক ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ধারণা থেকে বহুদূর চলে এসেছে। ফলে এ সমাজ ইসলামের মতো মানবকল্যাণের ধর্মের অনুসারী হয়েও এর সত্যিকার মূল বাণী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে চাইলে বিদ্যমান অনড় প্রথার বাইরে এসে নবী (সাঃ) ও তাঁর প্রথম চার খলীফার সরল ও মানবকল্যাণের নীতি সময়োপযোগী করে গ্রহণ করতে হবে।
 
আন্‌-নাহ্দ়া আরবি সাহিত্যের জগতে বেশ উল্লেখযোগ্য আলোড়ন এনেছিলউনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে আরবি সাহিত্যে ক্ল্যাসিক্যাল বর্ণনায় আধুনিক বিষয় ও ভাবের বর্ণনা দেওয়া হতো১৮৬৫ সালে সিরীয় লেখক ফ্রান্সিস ফাতাল্লাহ মারাশ গাবাতুল্ হক্নামে একটি রূপকধর্মী আরবি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। আরেক সিরীয় লেখক কুস্তাকি আল্‌-হিমসি আধুনিক আরবি সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রাখেন। তাঁকে আধুনিক আরবি সমালোচনা সাহিত্যের জনক বলা হয়। তাঁর লেখা মানহাল ওয়ারাদ আল্‌-ইন্তিকাআরবি সমালোচনা সাহিত্যের বাইবেল হিসেবে গণ্য হয়।
 
মারিয়ানা বিনতে নাসরাল্লাহ মারাশ আরব সাহিত্য জগতের প্রথম নারী। তিনি তারিখু সিরিয়ানামে সিরিয়ার ইতিহাস রচনা করেছিলেন। ১৯১৪ সালে মিশরের অধিবাসী মোহাম্মদ হুসাইন হায়কলের লেখা জানাপ্রকাশিত হয়। এই বই প্রথম আরবি উপন্যাস হিসেবে সমাদর পেয়ে থাকে। আধুনিক কবিদের মধ্যে মিশরের আহমাদ শাওকি তাঁর কাব্যগ্রন্থ শ্‌-শাওকিয়াত’-এর মাধ্যমে নতুন ধারা তৈরি করেন। মিশরের অন্যতম কবি হাফেজ ইব্রাহীম তাঁর শাকারতু জামিলকাব্যগ্রন্থে ইউরোপের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের তীব্র বিরোধিতা করেন।
 
আন্‌-নাহ্দ়া আরব জগতে প্রকাশনা ও গণমাধ্যমেও ব্যাপক পরিবর্তন আনে। উল্লেখ্য, ১৮২১ সালে প্রথম আধুনিক মিশরীয় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে মিশরীয় পত্রিকা আল্‌-আহরাম প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পত্রিকা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে প্রচুর সাহায্য করেছিলবৈরুতে প্রায় ১৫টি পত্রিকা ও ৪০টি সাময়িকী প্রকাশিত হতো।
 
আরবি ভাষা এই জাগরণের ফলে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলইউরোপীয় সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের বইপত্র আরবিতে অনুবাদের কারণে নতুন নতুন শব্দ ও পরিভাষার আগমন এই প্রাচীন ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করে তুলছিলো। আগে ইউরোপের বৈজ্ঞানিক শব্দভাণ্ডারের প্রচুর শব্দ আরবি থেকে ইউরোপে গিয়েছিলআধুনিক স্ট্যান্ডার্ড আরবি এ সময়ই আলোর মুখ দেখে, যা বর্তমানে আরব বিশ্বের শিক্ষা ও গণমাধ্যমের ভাষা। আধুনিক আরবি এনসাইক্লোপেডিয়া এ সময়ই জন্ম নেয়। এই এনসাইক্লোপেডিয়া ক্লাসিক আরবি ও আধুনিক ইউরোপীয় বর্ণনা পদ্ধতির সমন্বয়ে রচিত হয়েছিলো। প্রথম আধুনিক আরবি ডিকশনারি মাতনুল্‌-লুগাহ্এ সময়ই রচিত হয়
 
আন্‌-নাহ্দ়া বা নবজাগরণ আরব সমাজগুলোর অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংঘটিত হয়েছিলমধ্যযুগে ইউরোপ যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, তখন আরব ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেই জ্ঞানের আলো জ্বলছিলআধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন অনেকাংশে আরব জগতের কাছে ঋণী। মূলত মুসলিম জগতের কাছ থেকেই ইউরোপ নিজেদের হারানো জ্ঞানের জগত আবার উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছিলফলে ইউরোপে সংঘটিত হয় রেনেসাঁ নামের পুনর্জাগরণ। সে হিসেবে আন্‌-নাহ্দ়া বা নবজাগরণকে ইউরোপের রেনেসাঁর একধরনের আরব সংস্করণ বলা চলে। এর সফলতার পরিধি কত তা বলা সহজ নয়। কিন্তু উনিশ ও বিশ শতকের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


No comments:

Post a Comment