Sunday 17 September 2017

আলোর সন্ধানে সালমান আল-ফারসীর সফরনামা

আলোর সন্ধানে সালমান আল-ফারসীর সফরনামা 

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


জাতিতে পারসিক সেজন্ম ইস্পাহানের জাইয়ান গ্রামে। পিতা ছিলেন সেই গ্রামেরই সর্দার এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক ধনাঢ্য ও সম্মানীয়। সে ছিল পিতার নয়নের মণি। এক পলক দৃষ্টি-অগোচর হোক, পিতা সইতেই পারতেন না। তাই, পূজিত অগ্নির তত্ত্বাবধায়ক করে প্রায় গৃহবন্দী করে রাখলেন তাঁকে; যেমনভাবে কোন বাঁদিকে ব্যস্ততা ও কাজের বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়। এতে যুবকটি অগ্নিপূজায় মনোযোগী হল; মুহূর্তের জন্যও আগুন নিভতে দিত না।       
পিতার ছিল অঢেল ভূ-সম্পত্তি। একদিন গৃহ নির্মাণে ব্যস্ত থাকায় তিনি যুবককে বললেন- ‘সোনা আমার! তুমি তো দেখছই, আমি আজ একটু ব্যস্ত। তাই তুমি আজ একটু খামারে গিয়ে কাজের দেখাশোনা করো।’
যুবকটি খামারের দিকে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে, একটি গির্জার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় শুনতে পেল কিছু অদ্ভুত শব্দগুচ্ছ। গৃহবন্দী থাকার কারণে মানুষের চাল-চরিত্র সম্পর্কে তাঁর খুব একটা ধারণা ছিল নাতাই কৌতূহলী হয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখার জন্য গির্জার ভীতরে প্রবেশ করল তাঁদের প্রার্থনা-পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে মনে ধারণা জন্মাল, এ ধর্ম তাঁর ধর্ম অপেক্ষা উত্তম। প্রার্থনা শেষে খ্রিস্টানদের জিজ্ঞাসা করল- ‘এ ধর্মের উৎপত্তি কোথায়?’ তাঁরা বলল- সিরিয়ায়। এভাবে কখন যে সূর্য অস্ত চলে গেছে, সে টের পায়নি। 
ফিরে আসল। বাড়িতে ঢোকা মাত্র পিতা প্রশ্ন করলেন- কোথায় ছিলে? তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তার কী খবর? সে বলে উঠল- আব্বা! আমি একটি গির্জার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। ভীতরে কিছু লোক প্রার্থনা করছিল। তাঁদের ধর্মাচরণ আমার খুব ভালো লেগেছে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি তাঁদের কাছেই ছিলাম।
- বাবা! ঐ ধর্মে কোন মঙ্গলই নেই। আমাদের ধর্ম তার চেয়ে অনেক ভালো।
- স্রষ্টার শপথ! কখনই নয়, ঐ ধর্ম আমাদের ধর্ম অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ।    
এসব শুনে পিতার মনে আশংকার মেঘ ঘনীভূত হতে আরম্ভ করল। পাছে সে ধর্ম-বিমুখ না হয়ে যায়, ভয়ে পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাকে গৃহেই বন্দী করে রাখলেন। অন্যদিকে যুবকটি লোক মারফৎ খ্রিস্টানদের নিকট অনুরোধ জানালো, সিরিয়াগামী কোন কাফেলার সংবাদ থাকলে জানাতে।   ভাগ্যক্রমে, কিছুদিন পর সিরিয়াগামী একটি যাত্রীদলের খবর সে তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলো। আর কৌশল করে পায়ের শিকল খুলে ফেলে লুকিয়ে সিরিয়ার পথে রওয়ানা দিল। 
সিরিয়া পৌঁছে, লোকেদেরকে সে প্রথম প্রশ্ন করল- এই ধর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি কে? লোকেরা উত্তর করল- গির্জার পাদ্রী। অতঃপর সে পাদ্রীর নিকট সব বৃত্তান্ত খুলে বলে সাহচর্যের প্রার্থনা করল, যাতে তাঁর অনুকরণে সঠিক ধর্মাচরণের দীক্ষা লাভ করতে পারে। সুযোগও হল। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই পাদ্রীর আসল রূপ তাঁর নিকট প্রকাশ পেল। সে অবাক- কীভাবে পাদ্রী ভক্তদের দানশীলতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে, আর তাঁদের দেওয়া দানের অর্থ অভাবীদের মাঝে বিলি না করে অনায়াসে সঞ্চয় করে চলেছে, নিজের জন্য! এভাবে সোনা-রূপায় পূর্ণ সাতটি কলস সঞ্চয় করে ফেলেছেআর এসব দেখে যুবকের মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে, কিছুদিন পর পাদ্রীর মৃত্যু হল। ভক্তরা যখন তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার উদ্দেশ্যে সমবেত হল, যুবকটি তাঁর অসৎ চেহারাটা সবার সামনে প্রকাশ করে দিল। আর প্রমাণ স্বরূপ দেখিয়ে দিল তাঁর সঞ্চয়কৃত কলস সাতটি। তাঁরা রেগে গিয়ে শহরেরই কোনো এক চৌমাথায় তাঁকে শূলবিদ্ধ করল। অতঃপর প্রস্তর-আঘাতে দেহটিকে ক্ষতবিক্ষত করে ক্রোধাগ্নি খানিকটা প্রশমিত করল।
কিছুক্ষণ পরেই অপর এক ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হল। সে প্রকৃত অর্থেই ছিল সৎ, ধর্ম-পরায়ণ ও পার্থিব-মোহমুক্ত। যুবক তাঁকে ভালোবেসে ফেলল। তাঁর সাহচর্যে ধর্মাচরণের কিছু নিয়মনীতিও রপ্ত করে ফেলল। এরই মধ্যে যখন সেই ধর্মযাজক মৃত্যু-শয্যায় পৌঁছে গেলন, যুবকের অনুরোধে তাঁকে ইরাকের মুসিল শহরে এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাতের উপদেশ দিলেন। কারণ, ধর্মযাজকের দৃষ্টিতে সেই কেবল প্রকৃত খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী      
তাঁর মৃত্যুর পর যুবকটি মুসিলে গেল। সেই ব্যক্তিটি সব কিছু শুনে যুবককে তাঁর নিকট অবস্থানের অনুমতি দেয়। সে প্রকৃতার্থেই ছিল সৎ। কিন্তু কিছুদিন পরে সেও মৃত্যুবরণ করল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যুবককে বলে ছিলেন- হে বৎস! আল্লাহর কসম! আমার জানা মতে নাসিবাইনের এক ব্যক্তি আমাদের ধর্মের উপর অটল আছে। তুমি তার সাথে দেখা করো নাসিবাইনে পৌঁছে যুবক সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করল। সব কিছু জানার পর তিনি তাঁকে নিজের কাছে থাকতে অনুমতি দিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তারও মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গেল। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি যুবককে বলেছিলেন- হে বৎস! আল্লাহর কসম! একজন ব্যক্তি ছাড়া আমি আর কাউকে আমাদের সঠিক পথে দেখছি না, যার কাছে তোমাকে যেতে বলব। তিনি থাকেন আম্মুরিয়্যাহ-তে অতঃপর যখন সে মারা গেল এবং তাঁকে দাফন-কাফন করা হ, তখন যুবকটি আম্মুরিয়্যাহ-র সেই ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হল।  সকল বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, তুমি আমার নিকট অবস্থান করো
আমুরিয়াহ-তে অবস্থান কালে যুবকটি কিছু উপার্জনও করেছিলএক পর্যায়ে সে কিছু গাভী ও বকরীর মালিক হয়ে গেছিল কিছু দিন পর সেই গুরুরও মৃত্যু ঘনিয়ে আসল।  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে গুরু শিশ্যকে ডেকে বললেন, হে বৎস! আমার জানা মতে এখন আর এমন কোন ব্যক্তি নেই যে আমাদের ধর্মে বিশ্বাসী। যার কাছে আমি তোমাকে যেতে অনুরোধ করবো। তবে শেষ নবী আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মে প্রেরিত হবেন। আরব ভূমিতে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। আর তিনি এমন ভূমির দিকে হিজরত করবেন যা পাথরময় হবে এবং খেজুর গাছে ভরে থাকবে। তাঁর কিছু স্পষ্ট নিদর্শন থাকবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, তবে সাদক্বাহ খাবেন না। তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যভাগে নবুঅতের (নবিত্বের) সিলমোহর থাকবে। যদি তোমার ঐ দেশে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে তবে তুমি যেয়ো।
তাঁর মৃত্যুর পর যুবকটি কিছু দিন আম্মুরিয়্যাহতে অবস্থান করলঅতঃপর সেদিক দিয়ে কালব গোত্রের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল। সে তাদের বলল, তোমরা আমাকে আরবে নিয়ে চল। বিনিময়ে আমি তোমাদের এই গাভী ও বকরীগুলো দিয়ে দেবোতারা বলল, ঠিক আছে। অতঃপর তাদের সেগুলো দিয়ে দিল আর তারা তাকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা দিল। যখন তারা তাকে নিয়ে ওয়াদী আল-কুরায় (একটি স্থানের নাম) পৌঁছল, তাঁকে দাস-হিসাবে এক ইহুদীর নিকট বিক্রয় করে দিল। ফলে সে তার নিকট অবস্থান করে খেজুর গাছ দেখাশুনা করতে লাগল। অল্প কদিন বাদেই বনী কুরায়যার এক বাসিন্দা মনিবের চাচাত ভাই মদীনা হতে মনিবের কাছে আসল। আর তাঁকে ক্রয় করে মদীনায় নিয়ে গেল। মদীনা শহর দেখা মাত্রই যুবকের মনের ক্যানভাসে অন্তিম গুরুর কথাগুলি ভেসে উঠতে লাগল। সে মদিনাকে চিনতে পারল।
যুবকটি একদিন নিজ মালিকের খেজুর গাছের মাথায় কাজ করছিল। আর মনিব সেই গাছের নীচে বসেছিল। ইত্যবসরে তাঁর এক চাচাত ভাই তার নিকট এসে বলতে লাগল, আল্লাহ বনী কায়লাহদের ধ্বংস করুন। তারা কুবাতে মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির নিকট সমবেত হয়েছে। তারা তাকে নবী বলে ধারণা করছে। একথা শুনে যুবকের শরীরে এক অদ্ভুদ রকমের কম্পন শুরু হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তাঁর মনে হল যে সে মনিবের উপর পড়ে যাব। অতঃপর খেজুর গাছ থেকে নেমে আসল এবং মনিবের চাচাত ভাইকে শুধালো, আপনি কী যেন বলছিলেন? মনিব চটে গিয়ে খুব জোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, এ ব্যাপারে তোমার কী হয়েছে? তুমি তোমার কাজে যাও।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা কিছু জমানো খেজুর নিয়ে কুবাতে রাসুল সা-র নিকট হাজির হয়ে বলল,  আমি খবর পেয়েছি, আপনি একজন সৎ মানুষ। আর আপনার সাথে আপনার দরিদ্র সঙ্গীসাথী রয়েছে। এগুলো আমার নিকট সাদকাহর জন্য ছিলআমি এগুলোর ব্যাপারে আপনাদেরকে অধিক হকদার মনে করি।
রাসূল সা তাঁর সাথীদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজে কিছুই খেলেন না। এরপর যখন রাসূল সা মদীনায় চলে আসলেন। কিছু খেজুর নিয়ে সে আবার তাঁর নিকট গেল। বলল, আপনি সেদিন সাদকাহর একটা খেজুরও খাননি। তাই এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া এনেছিরাসূল সা নিজে খেলেন এবং সাহাবীদেরও দিলেন।
নবিত্বের দুটি আলামত দেখতে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠেছিল তাঁর মন। ফলে তৃতীয়টির খোঁজে সে বাকীউল গারকাদে নবী সা-র নিকট পৌঁছাল। সেখানে তিনি এক সাহাবির জানাযায় গেছিলেন। তাঁর পরিধানে ছিল দুটি চাদর। সঙ্গীসাথীদের মঝে বসেছিলেন। যুবক সালাম দিয়ে তাঁর পিঠের দিকে ঘুরে দেখতে লাগল; যাতে গুরুর বর্ণনা মোতাবেক ঐ মোহরটি দেখতে পায়। যখন রাসূল সা তাকে দেখলেন যে, পিছনে ঘুরছে, বুঝতে পারলেন এবং পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। মোহরটি দেখে তার উপর ঝুঁকে পড়ল এবং চুমু দিয়ে কাঁদতে লাগল
এসব দেখে রাসূল সা যুবকটিকে ডাকলেন- এদিকে এসো। বলো, কী ব্যাপার তোমার...?  সে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। নবী সা সহচরদের সম্মুখে আরেকবার শোনাবার জন্য অনুরোধ করলেন।

গল্পের সেই যুবকটি বিখ্যাত সাহাবি সালমান আল-ফারসি...।


-----------------------------------------------
*তথ্যসূত্র-  মুসনাদ আহমাদ হা/২৩৭৮৮, সিলসিলা সাহীহাহ হা/৮৯৪



 Image result for আলোর সন্ধানে

No comments:

Post a Comment