কাঁদুনে
নাজিব মাহ়্ফ়ুজ়, মিশর
প্রজারা তাঁর অতীতের সকল অপকর্ম
ক্ষমা করে দিয়েছে। তবুও সম্রাট শাহরিয়ার অনুতপ্ত হয়ে নিজ সিংহাসন ত্যাগ করলেন। নিজ স্ত্রি-সন্তানদের ত্যাগ করলেন। অর্থসম্পদ, ক্ষমতা,
পদমর্যাদা সব কিছুই ত্যাগ করে রাতের বেলা আলখেল্লা গায়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর সামনে তখন তিনটা পথ খোলা ছিল। সিন্দাবাদের মত ঘুরে বেড়ানো, নগরের অভিজ্ঞ শায়খ আল্-বাল্খির
বাড়িতে যাওয়া অথবা সময় নিয়ে সবকিছু আরও একবার ভেবে দেখা। কী করবে বা তাঁর কী করা
উচিৎ, ভাবতে ভাবতে সে নদীর কিনারে এসে পৌঁছলো। পরিষ্কার আকাশ, আকাশে অর্ধাকৃতির চাঁদ জ্বলজ্বল
করছে। আর চাঁদের নীচে বসে বিলাপ করছে একদল মানুষ। কিন্তু এত রাতে কারা বিলাপ করছে? কৌতূহলী হয়ে সন্তর্পণে সে তাদের দিকে সামনে এগিয়ে এল।
খেজুর গাছের নীচে গম্বুজাকৃতির
একটা পাথর। হঠাৎ তাদের দলনেতা ওই পাথরে ঘুষি মারলো। কিন্তু তাতে কান্না থামলো না; তারা পুনরায় বিলাপ শুরু করল। শাহরিয়ারের কৌতূহলী
চোখ তাদের চিনতে ভুল করল না। তারা হলো তারই রাজ্যের সুলায়মান আল্-জায়নী, ফাজল বিন খাকান, সামি শুকরি, খালিল ফারিস,
হাসান আল্-আত্তার ও জালিল আল্-বাজ্জাজ। সারা রাত তারা কান্নাকাটি করতে
থাকলো। তবে ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই তারা কান্না থামিয়ে শহরে
ফেরার তোড়জোড় শুরু করলো এবং ফিরে যাওয়ার আগে আগামীকাল আবার আসবে বলে সকলেই
প্রতিজ্ঞা করলো।
তারা চলে যাবার পর শাহরিয়ার
পাথরটার চারদিক ঘুরে ঘুরে ভালো করে দেখল। তাতে পাথরের গায়ে একটা অমসৃণ জায়গা দেখতে
পেল। গত রাতে যেভাবে তাদের দলনেতা ঘুষি মেরেছিল সেভাবেই ঠিক ওই জায়গাতেই সেও পরপর
কয়েকটা ঘুষি মারল। তাতে কিছুই হলো না। কিন্তু ফিরে আসার সময় পাথরের ভেতর থেকে
উৎসারিত একটা শব্দ শুনতে পেল! শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখল, পাথরের নীচের অংশ খুলে গেছে। সেখান দিয়ে একটি আলোক রশ্মি বের হচ্ছে। সাথে একটা
মিষ্টি ঘ্রাণ। শাহরিয়ার পাথরটার ভেতরে মাথা
ঢুকাল। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, খুব সুন্দর একটা পরিবেশ! সে
এবার পুরোপুরি ভেতরে ঢুকে গেল। অমনি দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল! তারপর শুরু হলো তাঁর
জীবনের একটা নতুন অধ্যায়।
ভেতরে ঢুকে একটা বারান্দা পেলো।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে বাগানের ফুল দেখতে পেলো। হরেক রকমের ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটু এধার-ওধার নজর ঘোরাতেই
বারান্দার শেষ মাথায় একটা দরজা দেখতে পেল। তার মনে হলো কয়েক মিনিট হাঁটলে সে দরজার কাছে
পৌঁছে যাবে। কিন্তু অনেক্ষণ হাঁটার পরও দরজার কাছে পৌঁছতে পারল না। যেন সে এখনো একই
জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মনে হল, সারা জীবন হাঁটলেও ওই পথ শেষ হবে না। তবুও সে
হাঁটতে থাকলো। আর হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার সামনে একটা বাথটাব পড়ল। যার পাশে একটা পরিষ্কার আয়না
ছিল। সেখানে অদৃশ্যলোক থেকে সে একটা কণ্ঠ শুনতে পেল, “শাহরিয়ার, আজ তোমার যা মন চায়, তাই করো”।
সে জামা খুলে বাথটাবে ডুব দিল। পানি থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক
নতুন রূপে আবিষ্কার করল। মসৃণ ত্বক, সুঠাম দেহ এবং কালো চুল; যেন এক তরুণ। মনে মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র
প্রশংসা করল। তারপর তার শরীরে দামেস্কের রেশমি জামা, খোরাসানের পাগড়ি ও মিশরের জুতো
দেখে আরো বেশি অবাক হলো।
নতুন জামা পরে সে পুনরায় দরজার
দিকে হাঁটতে লাগল। মাঝ পথে এক সুন্দরী তরুণীর সাথে তার দেখা হল। ওই তরুণী তাকে জিজ্ঞেস করলো— কে তুমি?
—আমি শাহরিয়ার।
অতঃপর তরুণী যখন তাকে দরজার
সামনে নিয়ে গেল দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে কিছু বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনা গেল।
ফুলের আদলে তৈরি প্রাসাদ দেখে শাহরিয়ারের চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। এই প্রাসাদের তুলনায় তার প্রাসাদ জীর্ণ কুটির। মহারানীর মুক্তোখচিত সিংহাসনের
সামনে গিয়ে একজন তরুণী বলল— এ-ই আপনার প্রতিশ্রুত নতুন বর!
মহারানী তাকে দেখে একটু মুচকি
হাসল। সেই হাসিতে শাহরিয়ারের বুক কেঁপে উঠল। তারপর মাটিতে নুইয়ে মহারানীকে শ্রদ্ধা
জানিয়ে বলল— মহারানী, আমি আপনার সেবা দাস ছাড়া অন্য কিছু নই।
—না, আপনি এই সিংহাসন এবং আমার
ভালোবাসার অংশীদার। মহারানী বলল।
—একটা কথা। আমার দীর্ঘ জীবনের অতীত আছে। যা পার করে এখন আমি
বুড়ো হয়ে গেছি।
—বুঝতে পারছি না, আপনি কোন বিষয়ে কথা বলছেন?
—প্রর্থনা করি আমাদের এ বন্ধন অটুট থাকুক।
তারপর চল্লিশ দিন যাবৎ সানাই
বাজল। শহরের সবাই বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করল। প্রেম, ভালোবাসা, নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে শাহরিয়ারের নতুন জীবন। তার ধারণা, এই উদ্যানের
রহস্য বের করতে তার হাজার বছর লেগে যাবে।
একদিন শাহরিয়ার রানীর সাথে
বাগনে হাঁটছিল। মাঝ পথে দেখল, স্বর্ণালি একটি দরজার সামনে লেখা রয়েছে, “ভেতরে
প্রবেশ নিষিদ্ধ”। রহস্য থেকে উত্তরণের জন্য সে রানীকে প্রশ্ন করল— সতর্কবাণীটা কেন ঝুলানো হয়েছে?
—আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বসবাস করি। ক্ষমার অযোগ্য কোনো
অপরাধ আমাদের দিয়ে যেন না হয়। তাই এ সতর্কবাণী।
—এটা আপনার রাজকীয় নির্দেশ নয় তো?
—আমি চাই আমাদের এ ভালোবাসা দীর্ঘজীবি হোক।
একদিন শাহরিয়ার রানীকে জড়িয়ে
ধরে বলল— অনেক দিন তো হলো আমাদের কি কোনো সন্তান হবে না?
রানী অবাক কণ্ঠে বলল— আমাদের বিয়ের বয়স মাত্র একশ
বছর।
—কী, একশ বছর! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল
শাহরিয়ার।
—এর চেয়ে বেশি হবে না প্রিয়তম!
—আমার মনে হচ্ছে, এই তো কয়েকটা দিন পার করে এলাম!
—বুঝতে পারছি! তোমার মাথা থেকে এখনো অতীত যায়নি।
—তবু অন্য সকলের চেয়ে সুখে আছি।
—যখন তুমি তোমার অতীত ভুলে যাবে, তখন তুমি প্রকৃত সুখ অনুভব
করবে। বুঝতে পারলে প্রিয়তম।
রানীর কথায় শাহরিয়ার একটু হাসল।
অতঃপর রানী চুম্বনে চুম্বনে তার গাল ভরিয়ে দিল। কিন্তু দরজার কৌতূহলটা শাহরিয়ারের
মন থেকে গেল না। দিন যত বাড়ছে তার কৌতূহলও তত বাড়ছে।
একদিন দরজার নিকট কোনো প্রহরী
না দেখে দরজার পাশে লাগানো চাবি দিয়ে সে দরজাটা খুলে ফেলল। খুলতেই ভেতর থেকে একটা
ঘ্রাণ নির্গত হল। ওই ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে সে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগল।
মাঝপথে বিশাল আকৃতির এক দানবের সাথে তার দেখা হল। দানবটা তাকে হাতের মুঠোয় তুলে
নিল; যেন সে একটা ক্ষুদে পাখি। বাঁচার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু তার নাগাল থেকে কোনোমতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না। অবশেষে চিৎকার করে কেঁদে
উঠল, বলল— তোমার খোদার দোহাই লাগে, আমাকে যেতে দাও।
দানবটা তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলল। শাহরিয়ার সঙ্গা হারিয়ে পড়ে রইল।
রাতে মরুভূমির উষ্ণ হাওয়া, অর্ধাকৃতির চাঁদ আর কিছু মানুষের বিড়বিড় শব্দ শুনে শাহরিয়ার স্বগক্তি করল, এ আমি কোথায়? অবশেষে সে বুঝতে পারল, তার শরীর
বুড়ো হয়ে গেছে এবং প্রচণ্ড দুর্বল। কোনোমতে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদুনে লোকগুলোর সারির
শেষ মাথায় গিয়ে বসল। অতঃপর অর্ধাকৃতির চাঁদের নীচে বসে সকলে অশ্রুপাত করতে আরম্ভ
করলো। ভোর হওয়ার আগে যথারীতি সকলেই প্রস্থান করল। কিন্তু শাহরিয়ার
উঠল না। সে তখনও অবিরাম কেঁদে চলছে। তা দেখে নগরের পুলিশ প্রধান এসে তাকে জিজ্ঞেস
করল— আপনি কাঁদছেন কেন?
—এটা জেনে তোমার লাভ নেই।
—দায়িত্ব হিসেবে যা করার আমি তাই করছি।
—কিন্তু আমার কান্নার আওয়াজে তো কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে না!
—বুঝতে পারলাম।
—হারানো অতীত সকলকেই কাঁদায়। বুঝলেন?
—আপনার কি এখন কোনো থাকার জায়গা নেই?
—ন।
—ওখানে সবুজ দ্বীপের কাছে একটি খেজুরের বন আছে। আপনি চাইলে ওখানে
থাকতে পারেন।
—মন্দ নয়।
—একজন অভিজ্ঞ লোক বলেছেন, যার সকল দুয়ার বন্ধ তার জন্য
স্বপ্নের দুয়ার খোলা। আর মানুষকে তো স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, যার যেমন ইচ্ছা ঘুরে
বেড়াতে পারে। পৃথিবীতে অর্জনের কিছু নেই। আবার বিসর্জনেরও কিছু নেই।
পুলিশ প্রধান তার কথা শেষ করে শহর অভিমুখে হাঁটতে আরম্ভ
করলো।
[আল্-বাক্কাঊন, লাইয়ালিউ আল্ফ় লায়লা ২৯০ – ২৯৮]
Shukran
ReplyDelete