Thursday 31 March 2022

আব্দুর রাহমান শুকরীঃ জীবন ও কর্ম



‘আব্দুর্রাহ়্মান শুক্রী
(১৮৮৬১৯৫৮)
 
জন্ম পরিচিতি
কবি শুক্রী ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই অক্টোবর মিসরের পোর্ট সায়িদে জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর পূর্বপুরুষগণ উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে মিশরে এসেছিলেন তাঁরা নিজেদেরকে আইয়াদ বলতেন পিতামহ আহ্মাদ শুক্রী আইয়াদ পিতা মুহাম্মদ শুক্রী আইয়াদ উভয়েই মিসরের জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন পিতা কর্মসূত্রে আলেকজান্দ্রিয়া পৌরসভার একজন পদাধিকারী ছিলেন ১৮৮১ সালের উরাবী বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন পরে বিদ্রোহ পরাস্ত হলে তাঁকেও বন্দী করা হয়  মুক্তি পেয়ে অল্প কিছু দিন তিনি কর্মহীন ছিলেন পরে পোর্ট সায়িদের প্রশাসনিক বিভাগে যুক্ত হয়ে আজীবন ওই পদে বহাল ছিলেন এখানেই কবির জন্ম কবির অগ্রজ ভাইয়েরা একে একে মারা যাওয়ায় পিতা কবিকে সবিশেষ স্নেহ করতেন
 
প্রতিপালন শিক্ষা
তিনি আশ্‌-শায়েখ মুহাম্মদ হিজাযী মক্তবে ভর্তি হন। তারপর আল্‌-জামে’ আত্‌-তাওফীকী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ১৯০০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর আলেকজান্দ্রিয়ার রাসুত্‌ তিব্‌ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯০৯ সালে আল্‌-মু‘আল্লামীন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। সে সময় তিনি ইংরেজি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ফলে সরকারী ভাবে তাঁকে ইংল্যান্ডের শেফাল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানে তিনি তিন বছর যাবৎ অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধিক পারদর্শী হয়ে ১৯১২ সালে নিজ দেশে ফিরে আসেন।
 
কর্মব্যস্ততা
ইংল্যান্ড থেকে ফিরেই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক রূপে তাঁর কর্ম জীবন আরম্ভ হয়। তিনি বিদ্যালয়ে ইতিহাস, ইংরেজি এবং অনুবাদ সাহিত্য পড়াতেন। অতঃপর তাঁকে স্কুল পরিদর্শক ও পর্যবেক্ষক করা হয়। উক্ত পদে তিনি ১৯৩৮ পর্যন্ত অতি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রায় ছাব্বিশ বছর মিশরের শিক্ষা ও সংস্কৃতি দপ্তরে চাকরি করেছেন। অতঃপর তিনি যখন “আক্‌ওয়াম বাদু” নামক একটি কবিতা লেখেন, শাসক সমাজ তাঁর উপর চটে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে দেয়। ফলে একটা সময় তিনি বাধ্য হয়ে খুব সামান্য পেনশন নিয়ে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর পেনশন এতোই সামান্য ছিল যে তা তাঁর ও তাঁর অধিনস্ত ফ্যামেলির জন্য যথেষ্ট ছিল না। সেজন্যই তিনি আজীবন বিয়ে করেননি। উল্লেখ্য যে, তিনি তাঁর সহোদরের পুরো ফ্যামেলির ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতেন।
 
মৃত্যু
তিনি আশা করেছিলেন, জনসমাজ তাঁর পাশে দাঁড়াবে। তাঁকে সাহায্য ও সমর্থন করবে। কিন্তু কেউই তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। কোনোরকম সাহায্যও করেনি। ফলে হতাশ হয়ে তিনি একদিন তাঁর অপ্রকাশিত বহু দীওয়ান ও গ্রন্থ জ্বালিয়ে দেন। মানসিক চাপের পাশাপাশি তিনি হাই ব্লাড প্রেশারে আক্রান্ত হন, যা একসময় তাঁর পক্ষাঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একাকী জীবন যাপন আরম্ভ করেন। কথা বলা ও লোকেদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করাও ছেড়ে দেন। এভাবেই ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সালে আলেকজান্দ্রিয়াতে মৃত্যু বরণ করেন।
 
সাহিত্য-সমালোচনা 
মাদ্‌রাসাতুদ্‌ দীওয়ান নামক বিখ্যাত সাহিত্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। আক্কাদ ও মাযিনীকে সাথে নিয়ে আরবি কাব্য জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেন। আরবি কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। অনেকেই মনে করেন এই সাহিত্য সংঘের মূল উদ্যোক্তা তিনি। তিনিই এর প্রাণপুরুষ। আরবি কবিতাকে জীবনমুখী করার ব্যাপারে তাঁর অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে। তাঁর কাছে, কবিতা বিনোদন নয় বরং জীবনের প্রয়োজন। কবিতা জীবনের সুখদুঃখ, ভালোমন্দ, আলোঅন্ধকারের কথা বলে। সামাজিক সমস্যা উপস্থাপন করে সমাধানের পথে আহ্বান জানায়। মনুষ্য অভিব্যক্তির নিখাদ মাধ্যম। এছাড়া তিনি মনে করতেন, কবিতার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল চিত্রায়ন, কল্পনা, অনুভূতি ও চেতনা। এবং কবিতায় যে কোনোরকমের অতিরঞ্জন ও কৃতিমতা বর্জন অপরিহার্য।
 
কাব্যকবিতা
আরবি কবিতায় কাফিয়া ও অন্তমিলের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই কবিতায় একাধিক কাফিয়া ব্যবহার করেছেন। নিজ কবিতায় তিনি সামাজিক ইস্যুগুলো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নানা অপসংস্কৃতি নিয়ে সরব হয়েছেন। শিশুশ্রম, অনাথদের অসহায়তা ও অপুষ্টি ইত্যাদি বিষয়কে কবিতায় তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি দারিদ্র্য, অজ্ঞতা এবং অরাজকতাকে নিয়ে নিজ কবিতায় শাসক সমাজকেও বিঁধেছেন। আল্‌-ইয়াতীম নামক কবিতায় তিনি বলেছেন—
وما اليُتم إلا غربة ومهانة      وأي قريب لليتيم قريب؟
(অনাথ জীবন যেন প্রবাসী জীবন, লাঞ্ছনা ও অবহেলায় ভরা। কোনও আত্মীয়ই অনাথের আত্মীয় হতে চায় না)
 
তিনি মনে করতেন, জীবনের এই সৌন্দর্য বিশ্বনেতা, সমাজ-সংস্কারক ও মনীষাদের উপহার ও উপঢৌকন তাঁদের অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিপথ নির্ণয় ও পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে মাস়ারিউন্নুজাবানামক কবিতায় তিনি লিখেছেন
إن الحياة جمالها وبهاؤها         هبة من النجباء والشهداء
(জীবনের এই সৌন্দর্য ও উৎফুল্ল শহীদ ও পণ্ডিতদের উপহার)
 
তিনি স্বাধীনচেতা ও মুক্তমনা মানুষ ছিলেন স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন ও স্বাধীন ভাবে কর্ম সম্পাদনকে প্রাধান্য দিতেন  সারাক্ষণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করতেন তিনি মনে করতেন, একজন স্বাধীন মানুষের ভুল ভ্রান্তি কোনো দাসের সঠিক কাজ ও মত অপেক্ষা শ্রেয় তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেছেন
إذا ما أصاب العبد في بعض فعله        فما الفضل إلا للذي هو آمره
وإن أخطأ الحر الأبي فإنه        لأفضل من عبد تهون مصادره
(যদি কোনো দাস কোনো ভালো কাজ করে ফেলে, তাতে তার কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং কৃতিত্ব তার যে মনিব তাকে ওই কাজের আদেশ দিয়েছে তাই কোনো স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যদি কোনো ভুল করে ফেলে, সে ওই দাস ও ভৃত্য অপেক্ষা উত্তম যে অন্যের মর্জির অধীনস্থ)
 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

No comments:

Post a Comment