এবং মা, মা, মা...!
গল্পটা মা’ই একদিন আমাকে শুনিয়েছে। আমি তখন খুব ছোট। বয়স দেড় কি দু’ বছর। সারা শরীরে ঘা বেরিয়েছে। ঘায়ের কী ভয়ানক চেহারা। প্রথমে ফুসড়ির মতো ছোট। তারপর ফুলেফেঁপে ঢোল। ধীরে ধীরে পুরোটা জলে ভরে উঠছে। আশেপাশের ডাক্তার দেখিয়ে তেমন কোনো ফল মেলেনি। তখন আমাদের গ্রাম থেকে ১৩/১৪ কিলোমিটার দূরে ইকড়াকুড়ি নামের এক গ্রামে একজন খুব ভালো ডাক্তার ছিলেন। নাম কাসেম ডাক্তার। মা’বাবা দু’জনে মিলে ঠিক করলেন, সেখানেই নিয়ে যাবে। অতটা পথ পেরোতে বেশ কষ্ট পেতে হতো তখন। মাধ্যম বলতে গরুর গাড়ি বা সাইকেল। আর তা নাহলে পায়ে হেঁটে। স্নেহ ও মমত্ব একজন মা’কে এমন শক্তিশালী করে তোলে যে, মায়েরা যে-কোনো কঠিন পর্বতও ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে পাড়ে। স্বভাবতই মা’বাবা আমাকে নিয়ে ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। মাঝে টাঙ্গন নদী। নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, স্রোত বইছে বেশ জোরে। মাঝির দেখা নেই। কূলকিনারা না পেয়ে মা’ শাড়িটা খুলে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নদীতে নেমে পড়লেন। স্রোতের তীব্রতাকে খানখান করে মা’বাবা উভয়ে নদীর ওপারে পৌঁছে গেলেন। পাড়ে উঠে মা ওই চাদর ছেড়ে আবার শাড়ি পরলেন। তারপর উভয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সব বৃত্তান্ত দেখেশুনে ওষুধ লিখলেন। সাথে বলে দিলেন, বাচ্চাটার অবস্থা খুব ভালো নয়। আজকেই যে করে হোক ওষুধ এনে খাওয়াতে হবে।
ডাক্তার বাবুর কথা শোনে মা’বাবা উভয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ওষুধ আশেপাশে কোথাও পাওয়া যাবে না, ডাক্তার বাবু তা বলেই দিয়েছেন। কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র কুশমুণ্ডিতেই পাওয়া যাবে। বাধ্য হয়ে বাবা ডিসিশন নিলেন, তিনি ওষুধ আনতে কুশমুণ্ডি যাবেন। কিন্তু বাড়ি গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। ঠিক করলেন, বাবা ওখান থেকেই বেরিয়ে যাবেন। আর মা আমাকে নিয়ে ফিরবেন। কুশমুণ্ডি ওখান থেকে আরও ১২/১৩ কিলোমিটার হবে। অতঃপর বাবা যখন মা’কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একা বাড়ি ফিরতে পারবে? মা সহসা উত্তর দিলেন, তুমি আমাকে নদীটা পার করে দিয়ে আসো। বাকিটা আমি একা চলে যেতে পারবো।
বাবা মা’কে নদী পার করিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে কুশমুণ্ডির পথে রওয়ানা দিলেন। অন্যদিকে মা’ আমাকে কোলে নিয়ে একা এলোপাথাড়ি হাঁটতে আরম্ভ করলেন। মাগুরাকুড়ির খাঁ খাঁ মাঠ চারিদিকে কেউ কোথাও নেই। মাঝখানে একটা আম গাছ, তার আগে আকাশ ফাটানো রোদে কোথাও যে একটু জিরিয়ে নেবে তারও কোনো উপায় নেই। উপরন্তু রমজান মাস, মা আবার রোজা রেখেছেন। একা হাতের সংসার, বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না সব করতে হবে। নানা চিন্তা মাথায় কিলবিল করছে তখন। আর তারই জেরে হাঁটার ছন্দ কেমন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে কিছুটা পথ পেরোতেই আমাদেরই গ্রামের এক মহিলার সাথে মা’র দেখা। তারপর দু’জনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামে পৌঁছে গেলেন। আর ওদিকে বাবা হেঁটে হেঁটে কুশমুণ্ডি গেলেন। নানা ফার্মেসী ঘুরে ওষুধ নিয়ে আসলেন। মা’ ডাক্তারের বাতলে দেওয়া নুসখা মোতাবেক নানা উপায়-উপকরণ সহ ওষুধ খাওয়ালেন। এবং আল্লাহ্র অশেষ রহমত ও কৃপায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম।
আর তাই, মা’ শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজতে গেলে আমার মাথায় কেবল একটাই শব্দ ঘুরে ফিরে আসে, তা হল আত্মত্যাগ। আমি মনে করি মাতৃত্ব একটা জার্নি। আর এই জার্নির শুরু থেকে শেষ অবধি মায়েরা নানা আঙ্গিকে, নানা ভাবে নানান রকমের সেক্রিফাইস করতে থাকেন। হয়তো এসব কারণেই আমার স্রষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমার মা’বাবা অসন্তুষ্ট হলে আমিও অসন্তুষ্ট হবো। আর তাঁরা সন্তুষ্ট থাকলে আমিও সন্তুষ্ট থাকবো”।
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
বাঁশকুড়ি, দঃ দিনাজপুর
০৯-০৫-২০২১
No comments:
Post a Comment