‘আব্দুর্ রাহ়্মান ইব্নু খ়াল্দূন
(১৩৩২ – ১৪০৬ খ্রী)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
জন্ম ও পরিচিতিঃইব্নু খ়াল্দূন একজন মহাপুরুষ। একজন প্রজ্ঞাবান মনীষী ও শেকড়সন্ধানী ঐতিহাসিক হিসেবে দুনিয়া জুড়ে তাঁর খ্যাতি। ইতিহাসের দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের জনক। এ ছাড়া ভূগোল, সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তিনি পথিকৃতের মর্যাদায় ভূষিত। তাঁর প্রকৃত নাম ‘আব্দুর্ রাহ্মান, উপাধি ওয়ালীউদ্দিন, উপনাম আবু যায়েদ, পিতার নাম মুহাম্মদ, পিতামহের নাম খ়াল্দূন। তবে তিনি ইব্নু খ়াল্দূন নামেই অধিক পরিচিত। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে মে মোতাবেক ৭৩২ হিজরীর রমজান মাসের প্রথম দিনে তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ আরব থেকে সেভিলে হিজরত করেছিলেন। ইব্নু খ়াল্দূনের পূর্বকার কয়েক পুরুষ সেভিলে দীর্ঘকাল রাজকীয় উচ্চপদে আসীন ছিলেন।
পিতা একজন প্রখ্যাত আলেম ছিলেন। তাঁর কাছেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি। তবে সময়ের সাথে সাথে তিনি অন্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানেও পড়াশোনা করেন। অনেক বিষয় অধ্যয়ন করলেও অত্যন্ত প্রতিভাধর এই মহাপুরুষ দর্শনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি ফেজের হাবশি সুলতান আবু ইসহাক ইব্রাহিমের খাস নবিশ হন। ফলে অল্প বয়সেই তিনি দরবারি সম্মান, খেতাব এবং অর্থবিত্তের মালিক হন। আর সেই সাথে লাভ করেন অতি ঘনিষ্ঠভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ। তবে তিনি নানা কারণে এক স্থানে বেশিদিন থাকেননি বা থাকতে পারেননি। বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন রাজ্যে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। অবিরাম সফরে ইতিহাস, দর্শন, সমাজ বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভের বিরল সুযোগ লাভ করেন। তিনি ছোট-বড় অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ লিখে গেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন ‘মুক়াদ্দামা’র জন্য। এটাই তার শ্রেষ্ঠ অবদান।
ইসলামের তিনি ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ সেবক। রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে একজন বাস্তববাদী ও যুক্তিশীল পণ্ডিত বলে এশিয়া ছাড়িয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সুদূর ইউরোপের বোদ্ধা মহলে। ইউরোপের বুদ্ধিজীবীরা যখন সমাজ-রাষ্ট্রের বিবর্তন স্রেফ ঈশ্বরের লীলাখেলা মনে করতো, তখন ইব্নু খ়াল্দূন জোর দিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্র ও সভ্যতার ক্রমপরিণতি কোনো আধিভৌতিক শক্তির অধীন নয়। তা হলো সমাজের বাস্তব ক্রমগতির ফল। তাঁর একটি অনন্য কীর্তি এই যে, তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রের সংগঠিত সমাজের সার্বিক জীবনধারায় অর্থনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ইব্নু খ়াল্দূন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিক। ম্যাকিয়াভেলী, বোঁদে, ভিকো, কোঁতে ও কোরনোটের পূর্বসুরী। একদিকে মুসলিম এবং সেইসাথে পাশ্চাত্যের অধিবাসী না হওয়ায় তাঁকে এখনকার পৃথিবীতে আর উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হয় না।
ইব্নু খ়াল্দূন শেষ জীবন কাটিয়েছেন মিশরে। তৈমুর লং-এর আক্রমণের ভয়ে যখন সমগ্র মিশর কাঁপছিল, ঠিক তখন তিনি তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি কূটনৈতিক দক্ষতায় তৈমুরের আক্রমণ থেকে সিরিয়া, মিশর সহ সমগ্র পশ্চিম অংশকে রক্ষা করেন। তাঁর কথায় মুগ্ধ হয়ে তৈমুর তাঁকে তার উজিরে আযম (প্রধান মন্ত্রী)-এর পদে নিযুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তবে ইব্নু খ়াল্দূন তা সুকৌশলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর এই অবদানের জন্য মিশরীয় সুলতান তাঁকে সমগ্র দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ পদে থাকা কালেই ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ মোতাবেক ৮০৮ হিজরীর ২৫ রমযান ৭৪ বছর বয়সে মিশরের কায়রোতে ইন্তিকাল করেন। তবে আজও তিনি আমাদের মনের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলছেন।
শত্রু-মিত্র সকলেই তাঁর প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানিয়েছে তাঁর অনন্য সৃজনশীলতার জন্য। তিনি একাধিক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কতিপয় গ্রন্থ হল— (ক) কিতাবুল্ ‘ইবার ওয়া দীওয়ানুল্ মুব্তাদা ওয়াল্ খাবার ফী আইয়ামিল্ ‘আরব ওয়াল্ ‘আজাম ওয়াল্ বার্বার ওয়া মান্ ‘আসারাহুম্ মিন্ জাবিস্ সুল্তানিল্ আক্বার, (খ) আখ্বারু দাওলাতু বানিল্ আগ্লাব বে-আফ্রিকিয়্যাহ্, (গ) আত্-তা’রীফু বে-ইব্নি খালদূন ওয়া রেহ্লাতিহী গার্বান্ ওয়া শার্কান, (ঘ) শিফাউস্ সাইল লে-তাহ্যীবিল্ মাসাইল।
ধন্যবাদ
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete