বাদিউয্যামান সা‘য়ীদ আন-নূরসী
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
পূর্ব তুরস্কের বিৎলিস প্রদেশের ছোট্ট
গ্রাম নুরস। ১৮৭৭ সালের এক বসন্তে সেই নুরস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাদিউয্যামান
সা‘য়ীদ আন-নূরসী। ছোট থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ধর্মতত্ত্বের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। যার দরুন পরবর্তীতে তাঁকে বাদিউয্যামান (কালের এক বিস্ময়কর প্রতিভা) উপাধি প্রদান
করা হয়। অর্থাৎ তিনি ছিলেন সে-সময়ের এক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতা বিষয়ক নামিক কামালের
পুস্তকগুলো তরুণ নুরসি র মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৮৯২ সালে তিনি হারাকাতু
তুরকিয়া আল-ফাতাত (ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্ট)-এ যোগ দেন। আর তখন থেকেই রাজনৈতিক
বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
যখন ভ্যান প্রদেশের গভর্নরের আমন্ত্রণে,
তাঁর বাসভবনে বসবাস করতে শুরু করেন, সে-সময়ে সেখানকার আর্কাইভ ও লাইব্রেরির
বইপত্রগুলো অধ্যয়ন করে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করেন। বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত- এসব বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। ১৯০৯ সালে উসমানীয় সরকার তাঁর
বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ এনে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কারণ তিনি তখন
কমিটি অফ্ ইউনিয়ন প্রোগ্রেস (Committee
of Union Progress/ CUP)– এর সাথে মিলে উদারবাদী
সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে, পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং
মুক্তি পান। অতঃপর উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষদিকে, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্যে
আন্দোলন শুরু করেন। সুলতান আবদুল হামিদকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের প্রস্তাবও
দেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, সনাতনী মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে
সাথে সুফিইজ্ম ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয় করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি
যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে খিলাফতের বিপন্ন অবস্থা দেখে
নিজেই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধের সময় তিনি দ্য
সিক্স স্টেপস (The Six
Steps) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা
করেছিলেন। তাঁর এই লেখা তুর্কি সৈনিকদের মনোবল দৃঢ় ও মজবুত করে তোলে। কিন্তু তাঁর ধর্মীয়
প্রভাবে নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্র-এ কামালবাদী সেক্যুলার আদর্শ
বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। আর তাই একটা ছোট্ট ঘটনাকে ইস্যু করে ১৯২৫ সালের
৪ঠা মার্চ একটা আইন পাশ করা হয়। আগে থেকেই তাঁকে আটক করার সুযোগ খুঁজছিল নয়া
স্বৈর-সরকার। এই আইনের মাধ্যমে ডাইরেক্টরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেকের সাথে তাঁকেও
কারাবন্দী করে ইস্তান্বুল পাঠানো হয়।
তারপর ১৯২৬ সালে ইস্পার্তায় নির্বাসনে
পাঠানো হয় তাঁকে। কিন্তু তিনি যেখানেই যেতেন সেই জায়গার মানুষগুলো তাঁর শিশ্য,
ভাব-শিশ্য ও ভক্তে পরিণত হতো। এ কারণে তাঁকে আরো দুর্গম এলাকা বারলায় নির্বাসন দেয়া হয়। কিন্তু, সরকারের এই
কৌশল হিতে বিপরীত হয়, এখানে তাঁর ছাত্র সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। এই বারলাতেই বসে তিনি
তাঁর বিখ্যাত তাফসীর (আল্-কুর্আনের ব্যখ্যা ও বিশ্লেষণ) গ্রন্থ রাসায়েলুন্
নূর রচনার দুই-তৃতীয়াংশ কাজ
সম্পন্ন করেন।
তাফসিরটির রচনা সম্পূর্ণ হলে তাঁর ছাত্ররা
নিজ হাতে এর অসংখ্য কপি তৈরি করে। এমনকি তাফসিরটির আরবির পাশাপাশি আরও অন্যান্য
ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আর ‘নূরস পোস্টাল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে পুরো তুরস্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর
তুরস্ক জুড়ে এর ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এতে কর্তৃত্ববাদী সেক্যুলার স্বৈর-সরকার
বুঝতে পারে যে, নুরসির আন্দোলনকে তাঁরা
থামিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৬০ সালের ২৩শে মার্চ নুরসি উরফা প্রদেশে
দেহ ত্যাগ করেন।
No comments:
Post a Comment