খ়ালীল মুত়্রান
(১৮৭২ – ১৯৪৯ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
জন্ম ও
পরিচয়ঃ
আরবী
সাহিত্য কানন যে সমস্ত সাহিত্যিকদের আগমনে সুশোভিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন
স্মরনীয় ব্যক্তিত্ব হলেন খলীল মুতরান। শা‘য়েরুল্ কুত্রাইন খলীল মুতরান ছিলেন আধুনিক আরবী কাব্যজগতের প্রাণপুরুষ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ১লা জুলাই লেবাননের বা’লবাক শহরে
জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল মুতরান ছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী এবং
গন্যমান্য ব্যবসায়ী। তাঁর ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মাতা ছিলেন কবি-প্রতিভার অধিকারিণী, যে প্রতিভা সঞ্চারিত হয়েছিল মুরতানের মধ্যেও।
বাল্যকাল
ও শিক্ষাঃ
যাহ্লা
শহরের আল্-কুল্লিয়্যাতুশ্ শার্কিয়্যাহ্ নামক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক
শিক্ষার্জনের পর বেইরুতের একটি বিশপ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে আরবী ভাষার
পাশাপাশি ফরাসীতেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সেখানে অধ্যায়ন অবস্থাতেই তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফুরন ঘটে। যার ফল স্বরূপ স্বদেশবাসীর উপর উসমানী শাসকদের
অত্যাচারের প্রতিবাদে “মা’রাকাতু আয়ানা” শীর্ষক কবিতা রচনা করলে তা
শাসক দলের কুনজরে পড়ে। সরকার তাকে বিদ্রোহী, অস্থিরতা সৃষ্টিকারী রূপে চিহ্নিত
করে। পরবর্তীতে স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষা শুরু করলেও তা সম্পূর্ণ করতে না পারায় বলা হয়, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
বিদেশগমনঃ
সরকারী
গোয়েন্দাদের কুদৃষ্টি এবং আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ১৮৯০ সালে তিনি প্যারিস যাত্রা
করেন। সেখানে তিনি ফরাসী সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। সেখানেও একটি তুর্কী সরকার বিরোধী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে
তুর্কী সরকারের দূতাবাস তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। ফলে প্যারিস ত্যাগ করে লাতিন
আমেরিকা যাবার মনস্থ করেও পরে মিশরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মতো ১৮৯২ সালে
মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখে যাত্রা করেন।
কর্মজীবনঃ
তিনি জীবনে নানা ধরণের পেশার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।
যেমন— (ক) সাংবাদিকতা, মিশরে পৌঁছেই সেখানকার দৈনিক আল্-আহ্রাম পত্রিকার সম্পাদক সেলিম তাক্লার মৃত্যুতে একটি শোকগাথা রচনা করলে তা সেলিমের ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।। তিনি ১৮৯৩ সালে কবিকে উক্ত পত্রিকার সাংবাদিক
নিযুক্ত করেন। কবি আল্-আহ্রাম-এর পাশাপাশি আল্-লিওয়া এবং আল্-মুবাদ পত্রিকাতেও লেখালেখি করেছেন।
(খ) সম্পাদনা, আল্-আহরামে সাংবাদিকতার কিছুকাল পর সম্পাদক পদে উন্নীত হন।
এছাড়া ১৯০০ সালে তিনি নিজে একটি পাক্ষিক প্রকাশ করেন আল্-মাজাল্লাতুল্ মিস্রিয়্যাহ্ নামে। ১৯০২ সালে শায়খ ইউসুফের সঙ্গে মিলিত হয়ে উভয়ে যৌথ উদ্যোগে এই পাক্ষিককে দৈনিক আল্-জাওয়ায়িবুল্ মিস্রিয়্যাহ্-তে
রূপান্তরিত করেন।
এছাড়াও
১৯১২ সালে তিনি কৃষিসংঘের সহকারী সচিব নিযুক্ত হন। মাঝে কিছুদিন ব্যবাসায় মনোনিবেশ করেন। আবার
১৯৩২ সালে কবি শাওকীর মৃত্যুর পর অ্যাপোলোর সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সালে জাতীয় নাট্যদলের
সভাপতি হন।
পরলোকগমনঃ
স্বভাব কবি
মুতরান বহু সাহিত্য সেবার পর ১৯৪৯ সালের ১লা জুলাই ৭৭ বছর বয়সে কায়রোতে মৃত্যু বরণ করেন।
কাব্য-বৈশিষ্টঃ
তিনি
ছিলেন সহজাত কবি প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কবিতায় ঐতিহ্য ও
আধুনিকতার সমন্বয় লক্ষ
করা যায়। তাঁর অনুভূতি বোধ ছিল সূক্ষ্ম। প্রখর বিশ্লেষণ ক্ষমতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট। অত্যন্ত স্বচ্ছ কাব্যশৈলীর অধিকারী ছিলেন। তাঁর যে কোনো কবিতার বিষয়বস্তু বিক্ষিপ্ত না হয়ে একক বিষয় কেন্দ্রিক ছিল। পাশাপাশি
পাশ্চাত্য তথা ফরাসী কবিদের সাহচর্যে তিনি ফরাসী রোমান্টিকতায় প্রভাবিত হন, যা তার
বিভিন্ন প্রেমমূলক কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়। তিনি নিজেই বলেন, “আমার কবিতার তিন চতুর্থাংশই হল প্রেমের কবিতা”। তিনিই সর্বপ্রথম আশ্-শে‘রুল্ কাসাসী বা কাহিনী নির্ভর কবিতার প্রবর্তন করেন। আর এ ধরণের কবিতার অধিকাংশ
উপজীব্য তিনি ইতিহাস এবং বাস্তব জীবন থেকে গ্রহণ করেন।
সাহিত্য
সম্পদঃ
তাঁর অসংখ্য
সাহিত্যকীর্তি আরবী সাহিত্য ভাণ্ডারের উজ্জ্বল রত্ন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— (১) দীওয়ানুল খলীল (চার খণ্ডে সমাপ্ত তাঁর কাব্য সংকলন)। (২) আল্-মুজায্ ফী ‘ইল্মিল্ ইক্তেসাদ,
মির্আতুল্ আইয়াম ফী মুলাখ্খাসিত্ তারীখিল্ ‘আম– এ দু’টি তাঁর ফারসী থেকে আরবীতে অনুদিত গ্রন্থ। (৩) ইলাশ্ শাবাব– যুবকদের প্রতি উপদেশমূলক কাব্যসংকলন। (৪) শেকস্পীয়রের বিখ্যাত নাটকের আরবী অনুবাদ, যথা—ওথেলো, মার্চেন্ট অব ভেনিস, ম্যাকবেথ,
হ্যামলেট, ইত্যাদি।
সম্মানপ্রাপ্তিঃ
জীবনে তাঁর
কাব্যকবিতা, প্রতিভা ও ব্যুৎপত্তির জন্য তিনি নানা ধরণের সম্মান ও সম্বর্ধনা লাভ
করেছিলেন। যেমন, (১) ১৯১৩ সালে মিশর বিশ্ববিদ্যালয় ( বর্তমানে যেটি কায়রো
বিশ্ববিদ্যালয়) তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনা দেয়। (২) ১৯৪৭ সালে অপেরা হাউসে তাঁর সম্মানে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে তাঁকে শা‘য়েরুল্ কুত্রাইন ও শা‘য়েরুল্ আক্তার আল্-‘আরাবিয়্যাহ্ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তাঁর উৎকৃষ্ট মানের একাধিক কবিতা রয়েছে, যা আজও
পাঠককুল ও কাব্যমোদীদের মোহিত করে তোলে। তাঁর একটি অপূর্ব কবিতা হল আল্-মাসা (সন্ধ্যা)।
সেই কবিতায় তিনি বলেছেন—
داء ألم فخلت فيه شفائ من صبوتي، فتضاعفت برحائ
ياللضعيفين! إستبد بي وما فى الظلم مثل تحكم الضعفاء
No comments:
Post a Comment