শা‘য়েরুন্ নীল হাফিয ইব্রাহীম
(১৮৭২ – ১৯৩২ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
মিশর হতে পরাধীনতার শৃংখলকে দূরীভূত করার ক্ষেত্রে যে গুণীজনেরা মিশরবাসীদেরকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি মুহাম্মদ হাফিয ইব্রাহীম। আধুনিক মিশরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক চেতনা সঞ্চারকারী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা ও জাতীয় জাগরণের কবি ছিলেন তিনি। তিনি শুধুমাত্র একজন প্রথম শ্রেণীর কবিই ছিলেন না বরং একজন প্রথম শ্রেনীর সাহিত্যিকও ছিলেন। সাহিত্যিক আল্-মানফালুতি তাঁকে একজন প্রথম শ্রেণীর কবি ও প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক গণ্য করেছেন।
মাত্র দু’ বছরের, মতান্তরে চার বছরের সন্তান রেখে ওই জাহাজের প্রকৌশলী তাঁর পিতা ইব্রাহীম আফান্দী ফাহিমী দায়রুতেই মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মা হানিম বিন্তু আহ্মাদ আল্-বুর্সাহ্ কবিকে নিয়ে কায়রো শহরে নিজ ভাই অর্থাৎ কবির মামা মুহাম্মদ আফান্দী নিয়াজীর বাড়ীতে চলে আসেন। পিতা মিশরীয়, আর মাতা তুর্কী বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে কবির ধমনীতে রক্তের সংমিশ্রন তাঁকে জন্মগত প্রতিভাধর করে তুলেছিল। মামার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি প্রথমে আল্-মাদ্রাসাতুল্ খায়রিয়্যাহ্, মাদ্রাসাতুল্ মুব্তাদিয়ান ও আল্-মাদ্রাসাতুল্ কারীবাহ্-তে বিচ্ছিন্নভাবে প্রাথিমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর খিদিভ স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৮৮৬ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মামা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পেশাগত কারণে সরকারী নির্দেশে বদলী হলেন তানতায়, তাই কবিও তাঁর সাথে যেতে হল।
তানতা এসে তিনি আব্দুল ওয়াহাব আন্-নাজ্জারের সাথে পরিচিত হন। এবং দুঃখ দৈন্যের মাধুরী দিয়ে নিরলস কাব্য চর্চায় ব্রতী হন। পড়াশুনা ছেড়ে কবিতায় এমন মনোযোগী দেখে মামা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা দেখে কবি মামার উদ্দেশ্যে দু’ লাইন লিখে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। চিন্তাভাবনা করে ওকালতির পেশায় মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু ওকালতীর পেশায় মন না বসায় কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।
১৮৯০ সালে কুড়ি বছর বয়সে সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন। সেখান থেকে ১৮৯১ সালে সামরিক বিভাগে স্নাতক হলেন। তার তিন বছর পর তাঁকে পুলিশ বিভাগের ইনস্পেক্টর পদে বদলি করা হল। কিছু দিন পর পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে আসলে্লেনফিরে এসে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিচক্ষনতার জন্য সাফল্যের সঙ্গে সামরিক অফিসার পদে উন্নীত হলেন। এ সময় লর্ড কিচনারের সেনাপতিত্বে সুদানের উপর হামলা চালানো হয়। তখন কবিকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে সুদানে প্রেরণ করা হয়। এই দেশান্তরে কারণে ভাবুক কবির মন উতলা হয়ে ওঠে। বাধ্যতামূলক সুদানে অবস্থান তাঁর কাছে নির্বাসন মনে হয়। তাই স্বদেশের মাটি মিশরে ফিরে আসার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু তা না-মঞ্জুর হয়। সুদানে ইংরেজ অফিসারদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন যে, যে কোনো বিষয়েই ব্রিটিশ অফিসাররা মিশরীয় অফিসারদের উপর অবজ্ঞা ও ঘৃণার ভাব দেখায়। মিশরীয় অফিসাররা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কবিও সেই বিদ্রোহে ইন্ধন যোগান ও ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেন। বিদ্রোহীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। অতঃপর কবিকেও সংরক্ষিত সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করা হয়। ফলে ১৯০১ সালে সামান্য অংকের পেনশন নিয়ে তিনি মিশরে ফিরে আসেন।
মিশরে ফিরে কবি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফ্তি মুহাম্মদ ‘আবদুহুর বিপ্লবী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সাহচর্যে দেশ ও জাতীয় সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ইতিপূর্বে তিনি ১৮৯৯ সালে আবদুহুর সম্বর্ধনা সভায় প্রশংসাগাথা লিখে তাঁর সৌহার্দ্য লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে আবদুহুর মৃত্যুতে রচিত শোকগাথায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর অনুভূতি গভীর ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে।
আরবী কবিতায় আধুনিক ভাবধারা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে শুরু হয়। কবিতায় আঙ্গিক গঠন, বর্ণনা কৌশল, উপমা নির্বাচন সব কিছুতেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পরিদৃষ্ট হয়। প্রাচীনপন্থী কাসীদা, গযল ও গানের স্থলে উঠে আসে সনেট, টিউলেট, সম্পুর্ন নতুন আঙ্গিকের খন্ড কবিতা। তাছাড়া ভাবের প্রাচুর্যতা, বর্ণনার সাবলীলতা। ভাষা সহজ-সরল। বিষয়বস্তু ক্লাসিকধর্মী ও গতানুগতিক নয়। আর এ ব্যাপারে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। তাঁর এ রেনেসাঁ আধুনিক আরবী কাব্যাকাশের সর্বক্ষেত্রে সুললিত কাব্য-ঝংকার তুলেছিল।
No comments:
Post a Comment