Monday 20 November 2017

শায়েরুন নীল হাফিয ইবরাহীম


শা‘য়েরুন্‌ নীল হাফিয ব্‌রাহীম
(১৮৭২ ১৯৩২ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
জন্ম ও পরিচিতিঃ
মিশর হতে পরাধীনতার শৃংখলকে দূরীভূত করার ক্ষেত্রে যে গুণীজনেরা মিশরবাসীদেরকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি মুহাম্মদ হাফিব্‌রাহীম। আধুনিক মিশরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক চেতনা সঞ্চারকারী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা ও জাতীয় জাগরণের কবি ছিলেন তিনি। তিনি শুধুমাত্র একজন প্রথম শ্রেণীর কবিই ছিলেন না বরং একজন প্রথম শ্রেনীর সাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্যিক ল্‌-মানফালুতি তাঁকে একজন প্রথম শ্রেণীর কবি ও প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক গণ্য করেছেন।
 
জাতীয় সেবা ও দুস্থ মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ছিলে তিনি। খানিকটা বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুলের মতই তাঁর কবিতাতেও বিদ্রোহের স্বর শোনা যায়। তাঁর বিদ্রোহ ছিল ঔপনেবিশিক শাসন, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সামাজিক পুনর্গঠন, জাতীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধকরণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারের মুখোশ উম্মোচনই ছিল তাঁর কাব্যেকবিতার বিষয়বস্তু। নীলনদ অববাহিত মিশরীয় গণজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাংখা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক তাঁর কবিতায় স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। সেজন্যই তিনি প্রাচ্যে শায়েরুন্‌ নীল বা নীল নদের কবি উপাধিতে ভূষিত হন।
 
তাঁর জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মিশরের উত প্রদেশের দায়রুত শহরের নিকটে নীল নদের উপকন্ঠে নোঙ্গর করা একটি জাহাজে হয়েছিল তবে তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ রয়েছে।   
 
প্রতিপালনঃ
মাত্র দুবছরের, মতান্তরে চার বছরের সন্তান রেখে ওই জাহাজের প্রকৌশলী তাঁর পিতাব্‌রাহীমফান্দী ফাহিমী দায়রুতে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মা হানি বিন্‌তুহ্‌মাদ আল্‌-বুর্‌সাহ্‌ কবিকে নিয়ে কায়রো শহরে নিজ ভাই অর্থাৎ কবির মামা মুহাম্মদ আফান্দী নিয়াজী বাড়ীতে চলে আসেন। পিতা মিশরীয়, আর মাতা তুর্কী বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে কবির ধমনীতে রক্তের সংমিশ্রন তাঁকে জন্মগত প্রতিভাধর করে তুলেছিল। মামার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি প্রথমে আল্‌-মাদ্‌রাসাতুল্‌ খায়রিয়্যাহ্‌, মাদ্‌রাসাতুল্‌ মুব্‌তাদিয়ান ও আল্‌-মাদ্‌রাসাতুল্‌ কারীবাহ্‌-তে বিচ্ছিন্নভাবে প্রাথিমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর খিদিভ স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৮৮৬ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মামা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পেশাগত কারণে সরকারী নির্দেশে বদলী হলেন তানতায়, তাই কবিতাঁর সাথে যেতে হল।
 
আইন ব্যবসায়ঃ
তানতা এসে তিনি আব্দুল ওয়াহাব আন্‌-নাজ্জারের সাথে পরিচিত হন। এবং দুঃখ দৈন্যের মাধুরী দিয়ে নিরলস কাব্য চর্চায় ব্রতী হন। পড়াশুনা ছেড়ে কবিতায় এমন মনোযোগী দেখে মাম মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা দেখে কবি মামার উদ্দেশ্যে দু’ লাইন লিখে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। চিন্তাভাবনা করে ওকালতির পেশায় মনোনিবেশ করলেনকিন্তু ওকালতী পেশায় মন না বসায় কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন  
 
সামরিক জীবনঃ
১৮৯০ সালে কুড়ি বছর বয়সে সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন। সেখান থেকে ১৮৯১ সালে সামরিক বিভাগে স্নাতক হলেন তার তিন বছর পর তাঁকে পুলিশ বিভাগের ইনস্‌পেক্টর পদে বদলি করা হ কিছু দিন পর পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে আসলে্লেনফিরে এসে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিচক্ষনতার জন্য সাফল্যের সঙ্গে সামরিক অফিসার পদে উন্নীত হলেনএ সময় লর্ড কিচনারের সেনাপতিত্বে সুদানের উপর হামলা চালানো হয়তখন কবিকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে সুদানে প্রেরণ করা হয়। এই দেশান্তরে কারণে ভাবুক কবির মন উতলা হয়ে ঠে। বাধ্যতামূলক সুদানে অবস্থান তাঁর কাছে নির্বাসন মনে হয়। তাই স্বদেশের মাটি মিশরে ফিরে আসার জন্য আবেদন জানানকিন্তু তা না-মঞ্জুর হয়। সুদানে ইংরেজ অফিসারদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন যে, যে কোনো বিষয়েই ব্রিটিশ অফিসাররা মিশরীয় অফিসারদের উপর অবজ্ঞা ও ঘৃণার ভাব দেখায়। মিশরীয় অফিসাররা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ঠে। কবিও সেই বিদ্রোহে ইন্ধন যোগান ও ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেন। বিদ্রোহীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয়অতঃপর কবিকেও সংরক্ষিত সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত করা হয়। ফলে ১৯০১ সালে সামান্য অংকের পেনশন নিয়ে তিনি মিশরে ফিরে আসেন।
 
জনগণের কবিঃ
মিশরে ফিরে কবি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফ্‌তি মুহাম্মদ আবদুহুর বিপ্লবী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সাহচর্যে দেশ ও জাতীয় সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ইতিপূর্বে তিনি ১৮৯৯ সালে আবদুহুর সম্বর্ধনা সভায় প্রশংসাগাথা লিখে তাঁর সৌহার্দ্য লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে আবদুহুর মৃত্যুতে রচিত শোকগাথায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে মৃত্যুর অনুভূতি গভীর ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে।
 
এরই মাঝে ১৯১১ সালে শিক্ষামন্ত্রী হাশ্‌মত পাশার সহযোগীতায় মিশরের জাতীয় গ্রন্থাগার দারুল্‌ কুতুব আল্‌-মিস্‌রিয়্যাহ্‌-এর সাহিত্য বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন ১৯৩২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন
 
কাব্য প্রতিভাঃ
আরবী কবিতায় আধুনিক ভাবধারা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে শুরু হয়। কবিতায় আঙ্গিক গঠন, বর্ণনা কৌশল, উপমা নির্বাচন সব কিছুতেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পরিদৃষ্ট হয়। প্রাচীনপন্থী কাসীদা, গানের স্থলে উঠে আসে সনেট, টিউলেট, সম্পুর্ন নতুন আঙ্গিকের খন্ড কবিতা। তাছাড়া ভাবের প্রর্যতা, বর্ণনার সাবলীলতা। ভাষা সহজ-সরল বিষয়বস্তু ক্লাসিকধর্মী গতানুগতিক নয়। আর ব্যাপারে তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। তাঁর রেনেসাঁ আধুনিক আরবী কাব্যাকাশের সর্বক্ষেত্রে সুললিত কাব্য-ঝংকার তুলেছিল
 
তিনি ছিলেন গোটা আরব জাহান বিশেষ করে মিশরের জনগণের কবি। আরবী কবিতায় জাতীয়তা বোধের প্রেরণা তাঁরই প্রথম সৃষ্টি। সমাজ, জাতির আশা-আকাংখা ও সমকালীন ঘটনাবলীর অবিকল চিত্রাঙ্কনে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। পণ্ডিত ও সাহিত্যিক হুসাইন হায়কাল তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, হাফিব্‌রাহীমের কাব্যে তাঁর সমসাময়িক মিশরের জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট স্বর্ণরূপে ফুটে উঠেছেস্বদেশের প্রতি অগাধ প্রেম, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টি জনগণের সুখে-দুঃখে আশা-আকাংখায় তিনি ছিলেন মুহ্যমান তিনি ভিক্টোর হুগোর লজ এঞ্জেলস, শেক্স পিয়ারের ম্যাকবেথ ও বহু ফরাসী কবিতা আরবী কাব্যকারে অনুবাদ করেছেনএছাড়া সমর চেতনামূলক, প্রগতিশীলতামূলক নুতন আঙ্গিকে ও সাবলীলতায় গদ্য ও পদ্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদা রেখে গেছেন। 

No comments:

Post a Comment