মৎস্য ধরিবে খাইবে সুখে
বদিউর রহমান
বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম ও শেষ’ পড়তে বিশেষ করে ভালো
লেগেছিল কারণ তাতে মাছ ধরার কথা আছে। লীনা যখন তাঁদের দিঘির ঘাটে বসে একটা ইংরাজি
বই পড়ছিল তখন তার পড়ার ব্যাঘাত ঘটে দিঘির জলের তোলপাড় শব্দ শুনে। তার পরে পরেই সে
আবিস্কার করে যে একটা লোক (বিদ্যাপতি) লুকিয়ে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে। তারই ছিপে একটা
মস্ত বড় রুই মাছ টোপ খাওয়ার পরে ছাড়া পাবার জন্য তোলপাড় করছে। অবশেষে বিদ্যাপতি
মাছটা ডাঙায় তোলে ও আবার তাঁকে জলে ছেড়ে দেয়। কারণ, প্রথমত সে মাছ খায়না। দ্বিতীয়ত
সে মাছ ধরছিল কেবল অবসর বিনোদের জন্য।
ছিপে মাছ ধরা প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা কৌতুকপূর্ণ
লেখার কথাও এখানে বলা যাক। লালদিঘিতে একজন ছিপ ফেলতে বসার সাথে সাথে তার পিছনে আর
একজন বসে সারাদিন ছিপ ফেলা দেখতে থাকল। সেদিন একটা মাছও ছিপে উঠল না। পরদিন আবার ঐ
মাছ শিকারি ছিপ নিয়ে দিঘিতে বসল সেই দর্শকও গুটিগুটি এসে সারাদিন ছিপফেলা দেখল। সে
দিনও কোন মাছ ছিপে লাগল না। সন্ধ্যার সময় শিকারি যখন সব সরঞ্জাম গোছাচ্ছেন পিছন
থেকে সেই দর্শক শিকারিকে বলল, ‘আপনার ধৈর্য আছে বটে!’ কথাটা সত্যি, ছিপ দিয়ে মাছ
ধরার প্রথম পাঠই হল অসীম ধৈর্য।
বাংলা সাহিত্যে ছিপে মাছ ধরার প্রসঙ্গ বড়ই অপ্রতুল। হয়ত
বলবেন, ‘কেন, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত’ –এ তো মাছ ধরার উল্লেখ আছে!’ তা
আছে, কিন্তু সেখানে মাছ চুরি করতে। সেখানে ইন্দ্রের দুঃসাহসিকতার কথাই মুখ্য।
শরৎবাবুর দেবদাসকে দেখেছি ছিপ কাটতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে পার্বতীর উপর অযথা প্রহার
করে ঝাল মেটাতে। কিন্তু তাকে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে দেখিনি।
যাই বলুন ছিপ দিয়ে মাছ ধরার পাগলপারা শিকারিদের কথা
বাংলা সাহিত্যে খুবই সীমিত। অবশ্য সাহিত্যের একটা বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনায় আমার
উদ্দেশ্য নয়। আমি চাই বাংলার গ্রাম গঞ্জে কিছু লোকে ছিপে মাছ ধরা নিয়ে কী রকম
আনন্দে মেতে ওঠে সেই দিকটা তুলে ধরতে।
গরমের পর বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে পশ্চিমবাংলার
গ্রামে-গঞ্জে মাছ শিকারিদের মধ্যে দেখা যায় এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য যা হয়ত অনেকের
দৃষ্টিগোচর হয়না। যারা এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন তারা এই শিকারিদের কাণ্ডকারখানা
যথেষ্ট কৌতুক অনুভব করবেন।
ছিপে মাছ ধরার মরশুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন কোলে
মার্কেটের রবীন, কাল্টু, ঊমাচরণ ইত্যাদির দোকানে বা হাতিবাগানে মাছ শিকারিদের
আনাগোনা। দেখবেন বহু শিকারী গত বছরের ব্যবহৃত সুতো ফেলে দিয়ে নতুন সুতো কিনছেন।
কারও পছন্দ ডুম্যাক্স তো কারও আবার ওম্যাক্স। কেউ পুরানো হুইলটা কোম্পানির কাছে
রেখে আসছেন ওয়েলিং করার জন্য আবার কেউবা নতুন হুইলই ফেলছেন কিনে। তারমধ্যে আবার
কারও পছন্দ ব্রেক দেওয়া হুইল যাতে নিঃশব্দে মাছ ধরা যাবে। অনেকে কেনেন
রেঙ্গুনফোড়ার ছিপ। আবার শৌখিন শিকারীর পছন্দ ফাইবার গ্লাহসের বিদেশি ছিপ যদিও
সেগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। কেউ কেনেন ঐসব দোকানের তৈরি চার-মশলা। অবশ্য অভিজ্ঞ শিকারি
তৈরি চারমশলা থেকে নিজের হাতে তৈরি চারেই মাছ ধরতে বেশি পছন্দ করেন। তারা বড়
বাজার, বৈঠকখানা বা হাতিবাগানের দোকান থেকে কাঁচা মশলা কিনে নিজের হাতে, বহু
পরিশ্রম করে চার-মশলা তৈরি করেন।
মশলা তৈরির পর শুরু হয়ে যায় কোথায় বড় মাছ পাবার আশা আছে তার
খোঁজ খবর। নানবিধ কারণে আজকাল পশ্চিমবাংলায় পুকুর বা জলাশয়ে বড় মাছ দেখা যায়না। তাই মাছ শিকারিদের হয়েছে এক সমস্যা। চার-পাচশ গ্রামের মাছকে
ছিপে ধরতে তাঁদের মটেই ইচ্ছা করে না; এটাকে তারা মনে করে জীবহত্যা। স্বভাবত তারা চায়
ছিপের মাছ অন্তত পক্ষে এমন হবে যেন সেটা টোপ খাওয়ার পর হুইল থেকে সুতো নিয়ে দৌড়ায়; তাঁকে ডাঙায় তুলতে
বেশ বেগ পেতে হয়। শিকারকে খেলিয়ে তোলাতেই আনন্দ। এই তথ্যটা সব শিকারিই
ভাল করে জানে।
আজকাল মাছ শিকারিদের বিনোদনের কথা মনে করে অনেক জায়গায় পুকুর, দিঘি বা জলাশয়ে
ছোটবড় মাছ রেখে সেখানে ছিপ ফেলার টিকিট বিক্রয় হয়। কোথাও আবার এঙ্গেলার্স
ক্লাব করে সদস্য করা হয়। সে ব্যবস্থা সুভাষ সরোবর, লালদিঘি, লিলুয়া সাহেব ট্যাঙ্ক ও সাঁতরাগাছির কয়েকটি জলাশয়ে আছে। আর আছে এক এক জায়গায় এক এক রকম নিয়ম। কোথাও পনেরো কেজির
বেশি মাছ ধরা যাবে না। অন্যথায় আর একদিনের টিকিটের মূল্য দিয়ে সমস্ত মাছ নিতে পারেন।
কলকাতার বাইরে মফঃস্সলে এ ধরনের বহু পুকুর, খাদ, দিঘি ও জলাশয় আছে যেখানে টিকিট কেটে মাছ ধরা হয়। টিকিটের দর সাধারণত ৫০ থেক ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। টিকিটের দাম নির্ভর
করে পুকুরের সুনামের উপর। একটা নামি পুকুরে যে তারিখ থেকে মাছ ধরার টিকিট দেওয়া হয়
সেখানে অনেক শিকারি আগের দিন রাত থেকে লাইন দিয়ে হাপিত্যেশ করে বসে থাকে প্রথম দিনের
টিকিট পাওয়ার আশায়। মাছ ধরার নির্দিষ্ট দিনের আগে থেকেই শিকারিরা পুকুরে আপন আপন জায়গা পরিস্কার
করে। তাঁদের বিশ্বাস চারের জায়গায় আবর্জনা থাকলে মাছের পক্ষে টোপ খুজে পেতে অসুবিধা
হবে। আবর্জনা দূর করে সন্ধ্যার পর থেকেই চার ফেলার রেষারেষি আরম্ভ হয়ে যায়। শত্রুতা করে অন্যলোক চারে কিছু বাজে জিনিস না ফেলে তারজন্য চলে প্রায় সারা রাত
ধরে পুকুর পাড়ে জেগে থাকা। যারা নিজেরা রাত
জাগতে অনিচ্ছুক তারা টাকা খরচ করে পাহারাদারের ব্যবস্থা করে। অনেক জায়গায় মাছ
ধরাকে কেন্দ্র করে পুকুর পাড়ে তৈরি হয় অস্থায়ী চা-জলখাবারের এমনকি ভাতের হোটেল। শিকারিরা ঐসব হোটেলেই
রাতে এবং দিনে খাওয়া দাওয় সেরে নেন। আজকাল পুকুর-দীঘির চারিদিকে
ইলেক্ট্রিক আলোর ব্যবস্থা হয়। শিকারিদের ঘনঘন
আসা যাওয়ার জন্য আজকাল শুধু স্কুটার মোটোর সাইকেল নয় পুকুরপাড়ে ঝাকে ঝাকে আসা যাওয়া
করে মোটর গাড়ি ঠিক যেমন হয় কোন পিকনিক স্পটে। সবকিছু মিলিয়ে, শুধু পুকুর পাড়
কেন, গোটা গ্রামটাই
মেতে ওঠে এক উৎসবের আনন্দে। এমনকি ঐ সময় গ্রামের
প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে আসে আত্মীয়স্বজন; গ্রামের অনেক মেয়ে-জামাই একবার বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি হয়ে যায় পাড়ার উৎসবে সামিল হতে। দূর দূরান্তের মাছ শিকারিদের থাকার ব্যবস্থা হয় পাড়ার ক্লাব ঘরে। শোবার জন্য পাতা থাকে যাত্রায় ব্যবহৃত শতচ্ছিন্ন শতরিঞ্চা। তারই উপর গড়াগড়ি করে শিকারি রাতটুকু কাবার করে ভোরের অপেক্ষায়।
শিকারিদের অতি আগ্রহের সুযোগ নিয়ে কিছু পুকুরওয়ালা টিকিট
বিক্রির আগে লটারির মত কুপন বিক্রি করে। কুপনে যাদের নাম
ওঠে তাদের মাছ ধরার টিকিটের জন্য মাশুল দিতে হয়। এতো গেল টিকিট
সংগ্রহ। তারপর শিকারির শুরু হয় চারমশলা ইত্যাদি সবকিছু জোগাড়জাত আপনি যত রকম জিনিস খেতে
ভালোবাসেন সে সব জিনিস মৎস্য শিকারী জোগাড় করবেই আর তার জন্য কোনরকম কার্পন্য করবে
না। সে মাছের চারমশলার জন্য ভাল গাওয়া ঘি, দেরাদুন চাল, জায়ফল, জয়ত্রী, ছোটো এলাচ, মাখন, পনির, ছানা, নারকেল, কাংলা, ইত্যাদি জোগাড় করবে যে কোনো মূল্যে। নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন জিনিস জোগাড় করার তার উদ্দ্যম লক্ষ
করলে অবাক হবেন। চার-মশলা তৈরী করতে
অক্লান্ত পরিশ্রম হয় কিন্তু ঐ কষ্টেকর কাজ করতে তার কোনো বিরক্তি দেখতে পাবেন না।
মাছ ধরার জন্য শিকারী কী না করতে পারে, না বললে বিশ্বাস
করবেন না। যত নংরা আর দুর্গন্ধ জিনিসেই হোক না কেন শিকারী সে সভাত দিয়ে ঘাঁটতে ঘৃনা করে
না। খোলপচা, আলুপচা এমনকি কেঁচো
পচা ঘাততেও শিকারী দিধা করে না। ঐ সব পচানি মৃগেল
মাছে ভাল খায় যে! আবার রুইই মাছের টোপ করার জন্য বোলতার চাক ভাঙতেও শিকারী
পিছপা হয় না।
অবশ্য ইদানিং কালে চারমশলা ও মাছ ধরার কলাকৌশল অনেক পরিবর্তন
হয়েছে। পচা দুর্গন্ধ মশলা ব্যবহার আজকাল নেই বললেই চলে। তার জায়গায় ব্যবহার
হচ্ছে সুগন্ধ মিষ্টি চার। সনাতন একাঙ্গি, তাম্বুল, বুচকি, পচাপাতা, মেথি, লতাকস্তরী, আওবেল, জটামানসী, খলভাজা, ইত্যাদির উপর এখন আর অনেক ভরসা করতে পারছেন না; তার পরিবর্তে ব্যবহার
করছেন বিভিন্ন রকমের কেমিক্যল। কেউ আবার হ্যোমিওপ্যাথি
তার পরিবর্তে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন রকমের কেমক্যাল। কেউ আবআর হ্যোমিওপ্যাথি
অষুধ ব্যবহার ভাল ফল পেয়েছেন। কারোও মতে দেরাদুন
চালের পোলাও ছাড়া আজকাল মাছ ধরা যায় না। দেশি মদের বদলে
এখন আরম্ভ হয়েছে বিলেতি মদের অহেতুক ব্যবহার। আজকাল নাকি কাৎলা
মাছগুলো ঐসব ছাড়া টোপে মুখ দিতে চায় না। হায় কপাল মাছেরও
আজাকাল সুরাতে আশক্তি জন্মেছে। শুধু চারমশলাতেই
পরিবর্তন এসেছে তা নয়, টোপের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের পরিবর্তন। আগেকার দিনে সাধারনত আটা ময়দা ছিল টোপ। পড়ে তার জায়গা
নিল পাউরুটি ও পিঁপড়ের ডিম; যার দাম সবসময়ই ইলিস মাছের থেকে বেশি। এখন অনেকে ব্যবহার করছে ছাতুর পেল্লাই সাইজের টোপ। ঐ বল্ডার তৈরী
করতে লাগে নারকেল তেল, ঘি, বিরিয়ানির মশলা, মধু, পিঁপড়ের ডিম, হাঁড়িয়া, অ্যালকোহল ইত্যাদি। সমস্ত কিছু ঠিক
ঠাক তৈরি করে, অন্নান্য প্রয়োজনীয়
জিনিশ যেমন বসার জন্য পলিথিন, ছাতা, ,মাছতলার ল্যান্ডিং। নেট ইত্যাদি গুছিয়ে
নিয়ে এবার শিকারী রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়ে দিগ্বিগয় করার মতো বুক ফুলিয়ে। সূর্যের
আলো ফোটার আগেই যখন আবছা দেখা যায় তখন থেকেই আরম্ভ হয়ে জায় হুইল থেকে সুতো খোলার
ক্যা ক্যা আওয়াজ। কপাল ভাল থাকলে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় মাছেদের টোপ খেয়ে সুতো
নিয়ে দৌড়া দৌড়ি । যদি সকাল থেকেই মাছ মাছ খেতে আরম্ভ করে তাহলে শিকারী বেশ আনন্দিত
হয়; আর যদি অসাধু পুকুরওয়ালা আগে থকেই প্রচুর পরিমানে মাছের খোরাক পুকুরে দিয়ে
থাকে তাহলে দেখা যাবে মাছের খাওয়ার মুখ নেই। আর তাহলেই শিকারির সর্বনাশ। অবশ্য
নানা কারণেই মাছ কম খেতে পারে। যেমন দিনটা যদি মেঘলা করে গুমোট হয়ে থাকে, হাওয়া
চলাচল বন্ধ থাকে, তাহলে অক্সিজেনের অভাবে মাছ জলের উপর স্তরে ভেসে বেড়ায়, মাটি
ধরতে চায় না। অনেকে মনে করে আমাবস্যা পূর্নিমার উপর নির্ভর করে মাছের খাওয়া না
খাওয়া। আবার যখন ‘পূবেল’ চলে উপর্যোপরি তিনদিন মাআছ ছিপে খাবে না। এসবের কোনো একটা
হলেই শিকারির সর্বনাশ। মাছকে টোপ ধরানো হয়ে ওঠে এক সমস্যা।
অবশ্য সব সময় ওরকম হয় না। তাহলে কেউ আর ছিপ
নিয়ে মাছ ধরত না। মাছ যে দিন টোপ খেতে আওম্ভ করে সেদিন কোনো কিছু দেখে না। সাদা টোপই দিন বা কালো টোপ, কেঁচো দিন বা বোলতা যাই দেবেন টোপটা পুকুরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে
মাছ সেটা মুখে নিয়ে দৌড়াবে।
টোপ খাওয়ার পর এক এক জাতের মাছ এক এক রকম দৌড়ায়। রুই মাছ খাওয়ার পরেই দু থেকে তিনটে লাফ দেবে যে শিকারী একটু অসাবধান হলে তা
হাতের চোটে সুতয় কেটে রক্তরক্তি হয়ে হয়ে যাবে আর নাহলে পটাস করে সুতটা যাবে ছিঁড়ে।
শিকারির অসাবধানতার জন্য কখন ছিপটাই চলে যেতে পারে পুকুরে। আর মৃগেল মাছের খাবার
ধরন একেবআরে আলাদা। খুব ধীরে ধীরে অনেকক্ষন সময় নিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে টোপ খায় মৃগেল।
বঁড়শিতে লাগার পর তার প্রতিক্রিয়াও অন্যরকম। সে এমন করে ডাঙার দিকে চলে এসে
সুতটাকে এত ঢিল করে দেয় যে শিকারী ভাবে, বঁড়শিতে মাছ লাগেনি। সেই অসাবধানতাকে আজে
লাগায় মৃগেল। হটাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে সুত ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় পাঁক
ধরে এমন বজবজানি দিয়ে চলে যাবে যে শিকারী বলতে বাধ্য হবে ‘ইস’ পাকা মৃগেল ছিল।
আজকাল শিকারিদের ঝোঁক দেখা যায় কাতলা মাছ ধরার। তার কারন একটাই যে এই মাছকে
অনায়েসে কাবু করা যায়। কাতলা মাছ করে কি টোপ নেওয়ার পরেই দে এক লম্বা দৌড়। তারপর
সে যায় থেমে। আর তখন সহজেই ধরা দেয় শিকারির হাতে। মাছটাকে যখন মাছ ধরার জালে ভরা
হয় তখন শিকারির মুখটা আনন্দে চকচক করতে থাকে।
ঐভাবে সারাদিন মাছ ধরার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার পর সন্ধায়
শুরু হয় ক্লান্ত অবসন্ন দেহ গুলকে নিয়ে বাড়িফেরা। বাড়ি যত কাছাকাছি আসে অবসাদের
সঙ্গে একটু ভয়ও হতে থাকে শিকারির। অবসাদের কথাটা কিছুটা অনুমেয়। কেননা রাতজাগা,
উত্তেজনা, রোদ-বৃষ্টির মধ্যে নিষ্পলক দৃষ্টিতে ফাতনার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থেকে,
নট নড়ন চড়ন হয়ে বসে থেকে শরীর ক্লান্ত তো হবেই বরং সারা শরীরে ব্যাথায় ভেঙ্গে
পড়ে-অবসন্ন হয়ে আসে। কিন্তু ভয় হয় অন্য কারণে- বাড়ির লোকেদের বকার; মাছ না পেলে হয় এক
দৃষ্টিকোন থেকে, আর মাছ পেলে
অন্য দিক থেকে। মাছ না পেলে বলবে ‘ঘরের কাজকর্ম ফেলে, সারাদিন পুকুরপাড়ে সময় আর
অতগুল টাকা নষ্ট করে এলে?’ অন্যদিকে মাছ নয়ে ঘরে এলে ও যে শান্তি আছে তাও কিন্তু
নয়। তখনকার ভাষনটার বয়ানটা হবে অন্যরকম। যথা ‘রাতদুপুরে এত মাছ নিয়ে ঘরে ঢুকলে, তা
অগুলোর গতি কে করবে বল তো?’
আসলে কোনো মাছ শিকারির বাড়ির লোকেরা আদৌ পছন্দ করে না
মাছ ধরা। যে শিকারি প্রতিদিন আকন্ঠ বুঁদ হয়ে পুকুর ধারে পড়ে থাকে তাকেও যেমন্ন কথা
শুনতে হয়, তেমনি যে ভদ্রলোক কালে ভদ্রে মাছ ধরতে যান তাকেও বাড়িতে নানা রকম কথা
শুনতে হয়। বহু স্ত্রী তাদের স্বামীদের মাছ শিকার ছেড়ে মদ খাওয়ার কথাও বলে থাকে।
আবার অনেকে স্বামীদের মাছ শিকারের জঘন্য নেশা ছাড়ানোর জন্য লুকিয়ে ফুকফাক করতেও
পিছপা হয় না। কিন্তু শিকারির উপর কোনো কিছুই প্রভাব বিস্তার কর না। সে থাকে তার নেশায় মাশগুল হয়ে।
কোনো আদেশ-উপদেশ, কোনো ভয়-ভীতি কোনো কিছুরই পরোয়া করে না। সে নিজে মাছ ধরার নেশায়
বুঁদ হয়ে থাকে।
মাছ শিকারি নিজেও তো নানা ধরনের সংস্কার বিশ্বাস। তারাও
তাবিজ কবচের সাহায্য নিতে ছাড়ে না-সেগুল অবশ্য বেশি মাছ পাওয়ার জন্য। কোনো কবচ আছে
যেটা ছিপে বাঁধতে হয়, কোনোটা আবার শিকারির কমরে। আবার এমন ইট পোড়া আছে যা ছুড়ে
দিতে হয় চারের জায়গায়। কেই তুকতাতে বিশ্বাসী তো কেউ গ্রহ রানীতে। মৎস্য রাশির
লোকের হাতে মাছ ওঠে টপাটপ। শিকারির ঐ রাশি না হলে খোঁজ পড়ে ঐ রাশির মানুষের। তাঁকে
সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরতে পারলে তো খুবেই ভালো তা সম্ভব না হলে অন্তত মাছ ধরতে যাওয়ার
সময় ছিপটা তার হাতে স্পর্শ করালেও কাজ হবে।
মাছ ধরা নিয়ে তুকতাদের মধ্যে শিহরিত করার মতো যা শুনেছি
তা হল ছিপে যদি একটা বিশেষ দড়ি বাধতে পারেন তাহলে মাছ ধরে শেষ করতে পারবেন না। কি
সেই দড়ি সেটা বলেই দিই। যদি কোনো বিধবা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে আর সেই দড়ি
সবার অলক্ষে সরিয়ে নিয়ে ছিপে বাঁধতে পারেন তাহলে দেখবেন ভেলকি। একজন শিকারি ঐ
তত্ত্বটা পাওয়ার পর তক্কে তক্কে অপেক্ষা করছিল ঐ রকম কোনো অপঘাত মৃত্যুর। কিন্তু
‘ফলিডল’ জাতীয় চাষে ব্যবহার করার বিষ সহজলভ্য হওয়্র পর থেকে আত্মহননের আদিমপন্থা
আর বিশেষ কেউ পছন্দ করে না।। তাই বহুদিন খোঁজ খবর করারা পর একটা গলার দড়িতে আত্মহত্যার খবর এসে পৌছাল ঐ মাছ শিকারির আনন্দ দেখে কে!
সাইকেল চড়ে তড়িঘড়ি অকুস্থলে পৌঁছে দেখে যে সেখানে লোকে লোকারন্য। তার মাঝে আবারর
পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। দারোগা সাহেব যখন হুকুম করলেন ঝুলন্ত লাশ নামিয়ে দিড়িটা
শুদ্ধ নিয়ে চলো থানায়। পোস্টমর্টামের জন্য ওখানে লেখা জোখার কাজটা করতে হবে, তখন ঐ
শিকারি ভীষন হতাশ হয়ে। একটা গাছের তলায় বসে বিড়ি ধরায় চিন্তা করতে থাকে কী উদ্দামে
ঐ দড়ির অন্তত একটা টুকরো পাওয়া যায়। বিড়ির টানে বুদ্ধির দরজা খোলে। পকেটে হাত দিয়ে
গুনে নেয় পঞ্চাশ টাকা। কর্মরত একজন সিপাইয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে
বলে ঐ দড়িটা দেওয়ার কথা। তাতে কাজ হয় না দেখে সিপাইকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে তার হাতে
টাকাটা গুঁজে দিয়ে বিনীতভাবে বলে যে ঐ দড়ির সামান্য একটা আঁশ পেলে তার মরাপন্ন
ছেলের ‘দৈব’ ওষুধ হবে, তাতে ছেলেটা প্রাণে রক্ষা পাবে। সিপাইয়ের দয়ার শরীর। সে তখন
সকলের চোখ এড়িয়ে ঐ দড়ির একটা টুকরো ম্যানেজ করে ঐ মাছ শিকারিকে পায় কে!
উর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরে এসেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে সে ছিপ নিয়ে বসে পড়ে। এক মুহূর্তে সেই
দড়ি ছিপে বাধার পর থকেই শিকারী এক ওদ্ভুত উত্তেজনায় ছটফট করেতে থকে। রাত্রে আলো বন্ধকরে শুয়ে পড়ার পর পরেই শিকারী শুনতে পায়
নারী কন্ঠে তার ছিপ যেন বলছে ‘চল, মাছ ধরবি চল।‘ বার বার ঐ কথা শুনতে শুনতে শিকারী রাত দুপুরে ছিপ নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে। বিহলের মত যেতে যেতে হটাৎ এক জায়গায় শোনে ‘এই পুকুরে ছিপ ফ্যাল।’
মন্ত্র মুগ্ধের মতো সেই আদেশ মেনে শিকারী ছিপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায়
পুকুরে বড় বড় মাছের তোলপাড়। ছিপ আবার বলে “একটু জলে নামে মাছ ধরনা”। কিন্তু শিকারীর
একটু জ্ঞান ছিল যে ঐ ছিপ দিয়ে মাছ ধরার
সময় কোনো রকম জল স্পর্শ করা যাবে না; অন্যথা তার প্রান যাবে। এভাবে মৃত্যু তাকে
প্রতিরাতেই হাতছানি দিতে থাকে। সূর্য অঠআর পর সঃএ যঅখন বাড়ি ফেরে তার চেহেরা দেখে
বাড়ির লোকেরা ভয় পেয়ে যায়। মাথার চুল উশকোখুশকো চোখ দুটো আগুনের আংরার মতো লাল।,
বাড়িতে পৌছানো মাত্র ধপাস করে সেই যে পড়ে তাকে তোলে কার সাধ্য। কখন উদাস হয়ে
ভালোবাসা চোখে ফ্যালফ্যালা করে চেয়ে থাকে। কিন্তু সন্ধার পর থেকেই ছিপটার প্রতি
আকর্ষন বাড়তে থাকে। তারপর চলে একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। রাতের পর রাত দিনের পর দিন।
শেষে বাড়ির লোকেরা বহু পূজো আচ্চা দিয়ে ঐ দড়ির প্রভাব থেকে শিকারিকে রক্ষা করে।
কিন্তু শিকারি মাছ ধরার নেশা থেকে এখন মোহমুক্ত হয়নি।
এই নেশা যার একবার ধরেছে তার এই রাহু থেকে মুক্তি পাওয়ার
কোনো আশা নেই। মদ, হেরোইন, আফিম, গাঁজার নেশা মাছ ধরারা নেশার কাছে তুচ্ছ। মাছ
ধরার মধ্যে আছে অদ্ভুত আকর্ষন, টান, অদ্ভুত এক শিহরণ। ফাতনা নড়ার সাথে সাথে
শিকারির বুকের মধ্যে শুরু হয় অস্থির কম্পন। সেই মুহুর্তটা ক্ষনিকের জন্য হলেও তার
সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় নেই। তাই শিকারির পক্ষে ছিপ ফেলার আকর্ষন প্রত্যাক্ষান
করা একেবারেই অসম্ভব। সেই আকর্ষনকে উপেক্ষা করতে পারে না ডাক্তার-মোক্তার,
উকিল-ব্যারিষ্টার, মাস্টার-অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার-মেকানিক, সাধারন সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী, চাষী এমনকি
কর্মহীন বেকার যুবক। মাছ শিকারিদের নিখাদ আনন্দে কোনো বৈশম্য নেই। নেই কোনো
অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, গোত্র-বর্নের কোনো কিছুর বৈষম্য । ওখানে সবাই
সমান-ওখানে সবাই মৎস্যশিকারি।
No comments:
Post a Comment