Tuesday 17 December 2019

ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহঃ)



ইমাম ইব্‌নু তাইমিয়াহ্‌ (রাহঃ)
(১২৬৩ – ১৩২৮ খ্রি) 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
জন্ম ও পরিচয়ঃ
ইমাম ইব্‌নু তাইমিয়া (রাহ) পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য প্রতিভা, মুসলিম বিশ্বে একটি সুপরিচিত নাম, শরিয়তি-জ্ঞানের জগতে একটি প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন সমাজ-সংস্কারক, চিন্তাবিদ ও ভাষ্যকার ধর্মতত্ত্বে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে ‘শাইখুল-ইসলাম’ (ইসলামের পণ্ডিত) নামে আখ্যায়িত করা হয়। কুরআন-সুন্নাহ কেন্দ্রিক সমাজ-গঠন ও জীবন যাপনের জন্য তিনি সদা প্রয়াসী ছিলেন। অনেকের ধারণা, তাঁর এই সংস্কার আন্দোলনই পরবর্তীতে আরব ভূখণ্ডে ওহাবীউত্তর আফ্রিকাতে ‘সান্নূসী’ আন্দোলন নামে আত্মপ্রকাশ করে।    
 
তাঁর জন্ম হয় রোজ সোমবার, ২২শে জানুয়ারী ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৬৬১ হিজরীর ১০ রবিউল আউয়াল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিকটবর্তী হাররান প্রদেশে। প্রকৃত নাম আহ্‌মাদ, পিতা আব্দুল হালিম, পিতামহ আব্দুস সালাম; উপনাম আবুল আব্বাস, উপাধি তাক্বিউদ্দিন; কিন্তু তিনি ইব্‌নু তাইমিয়াহ্‌ নামে অধিক পরিচিত। তাইমিয়া তাঁর পিতামহীর নাম।
 
বিদ্যার্জনঃ
তাঁর পিতা আব্দুল হালিম ইসলাম শাস্ত্রের বিদ্যান ছিলেন। ইব্‌নু তাইমিয়া ফিক্বাহ শাস্ত্রে হাম্বালি পন্থার অনুসারী ছিলেন। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিজ পিতার কাছেই কুরআন, তাফসির (আল-কুরআনের ব্যখ্যাশাস্ত্র), হাদিস, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তারপর দামেস্কের বিখ্যাত পণ্ডিত যায়নুদ্দিন আল-মাক্বদেসি, নাজমুদ্দিন আল-আসাকারি ও যায়নাব বিনতে মাক্কি প্রমুখের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অসাধারণ মেধা, তীক্ষ্ণ স্মৃতি ও সূক্ষ্মবিচার শক্তির কারণে অল্পদিনেই তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।  
 
কর্মব্যস্ততাঃ
১২৮২ খ্রিস্টাব্দে (৬৮১ হি) তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স কুড়ি বছর। সে-সময় তিনি হাম্বালি ফিক্বহর পাঠদান আরম্ভ করেন। ধর্মতত্ত্বে তাঁর দখল ছিল অসামান্য। তিনি দামেস্কের বিখ্যাত জামে’ মসজিদে প্রতি শুক্রবারে আল-কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা) পেশ করতেন। তিনি তাঁর আলোচনায় বর্ণনাসূত্রে দুর্বল ও অসমর্থিত হাদীসগুলির তীব্র সমালোচনা করতেন। তাঁর এই অনন্য প্রতিভার কারণে ৩০ বছর বয়স অতিক্রম করার পূর্বেই তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। ফলে সরকার কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘কাযীউল্‌-কুযাত’ (প্রধান বিচারপতি) পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে শিক্ষকতায় নিয়োজিত রাখেন।
 
প্রণয়নঃ
তিনি ইসলামীশাস্ত্র জগতের নিরলস জ্ঞানতাপসদের মধ্যে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। অধ্যয়ন ও প্রণয়ন তাঁর জীবনকালের সিংহভাগকে দখল করে রয়েছে। তিনি সকল শ্রেণীর লেখকদের রচনা পড়তেন, বিভিন্ন মতাদর্শের পরিচয় লাভ করতেন, অতঃপর তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে নিজ অভিমত প্রকাশ করতেন। ইতিহাসের কতিপয় বর্ণনানুসারে তাঁর প্রণীত পুস্তকসমূহের সংখ্যা প্রায় পাঁচশত। যার অধিকাংশই কালের সুদীর্ঘ প্রবাহে কোথাও হারিয়ে গেছে। বর্তমানে শুধু তাঁর প্রণীত ৬৪টি গ্রন্থ মজুত আছে। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ সময় কারাবরণ ও অবিবাহিত জীবনযাপন তাঁর জন্য শাপে বর হয়েছিল। অনেকে মন্তব্য করেছেন, তিনি জীবনের এক তৃতীয়াংশ হাজতাবাসে যাপন করেছেন; যা তাঁর নির্বিঘ্ন অধ্যয়নের সুবর্ণ অবকাশে পরিণত হয়েছিল।
 
সংস্কারকমূলক চিন্তন ও প্রয়াসঃ  
তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় ফিক্বাহ শাস্ত্র সম্পর্কিত বহু বিষয়ে সংস্কারপন্থী মোট প্রকাশ করেছেন। পূর্ববর্তী চার ইমাম (আল্লাহ্‌ তাঁদের প্রতি করুণা বর্ষণ করুণ।)–এর মধ্য হতে কোনও একজনের মতকে অনুসরণ করাকে তাক্বলীদ বলে। তিনি এই তাক্বলীদের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যে মতটির ভিত্তি কুরআন বা বিশুদ্ধ হাদিসের উপর রয়েছে কেবল সেটিকেই মানতে হবে। এছাড়া কুরআন ও হাদিসকে যুক্তি দ্বারা বিশ্লেষণ করা এবং বিশ্লেষণে কোন সমস্যা হলে যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া- উক্ত অভিমতকে তিনি খণ্ডন করেছিলেন। সেযুগেও মুসলিমরা ধর্মপালনের প্রতি অধিক আবেগপ্রবণ হয়ে বা অধিক পুণ্যলাভের আশায় শারিয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত কর্মসমূহের মধ্যে কিছু অভিনব কৌশল বা প্রথা সংযোজন করেছিল পরিভাষায় যাকে বিদ’আত বলে, তিনি তার বিরোধিতা করে শুধুমাত্র কুরহাদিস সমর্থিত কর্ম ও কৌশল পালনে সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি তালাক্ব এবং হালালাহ (বৈধ করার কৌশল) প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী ওলামাদের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করতেন; তাই তাঁকে তাঁদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। তিনি মনে করতেন, ইজতেহাদ (কুরআন ও হাদিসকে কেন্দ্র করে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান অন্বেষণ করা)-এর দ্বার আজও উন্মক্ত রয়েছে। এধরণের বেশকিছু বিষয়ে সমকালীন পণ্ডিতদের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়। আর এর ফলাফল স্বরূপ তাঁর অর্ধেকেরও বেশি জীবন হাজতবাসে অতিবাহিত হয়।
 
বিভিন্ন চোখে ইব্‌নু তাইমিয়াঃ  
একদল ইসলামী বিদ্বান তাঁকে নাস্তিক বা কাফির বলে উল্লেখ করেছেন; তবে, অপর একদল তাঁকে শাইখুল ইসলাম বা ইসলামের ভাষ্যকর বলে আখ্যায়িত করেছেন। একদল তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে বলেছেন- ইব্‌নু তাইমিয়া যদি বলেন, এটা হাদীস; তাহলে সেটা হাদীস আর যদি বলেন- এটা হাদীস না, তাহলে সেটা হাদীস না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে, তিনি ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্বান ও ধর্ম সংস্কারক। 
 
মৃত্যুবরণঃ 
নিজ বন্দীদশাকে তিনি পূর্ণরূপে প্রণয়নের কাজে ব্যয় করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছ থেকে কাগজ ও কলমও ছিনিয়ে নেওয়া হল তিনি কয়লা দিয়ে দেওয়ালে লিখতে আরম্ভ করেন। তবে, ২০ দিনের মাথায় সোমবার মধ্যরাতে ২০শে যুলক্বাদ, ৭২৮ হিজরি মোতাবেক ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর, ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়তাঁর জানাযা চারবার পড়ান হয় তাঁর জানাযায় প্রায় দুলক্ষ পুরুষ ও ১৫ হাজার স্ত্রী লোক অংশ গ্রহণ করেছিলেনদামেস্কের সুফিয়া কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে উক্ত কবরস্থানের সবগুলো কবর ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে সিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহ নির্মিত হয়েছে; কিন্তু ইব্‌নু তাইমিয়ার কবরটি আজও রয়েছে

No comments:

Post a Comment