Tuesday 17 December 2019

মিখাইল নুআইমাহ


মিখ়াইল নুআইমাহ্‌
(১৮৮৯ – ১৯৮৮ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
জন্ম ও পরিচয়ঃ
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে সব শিক্ষাবিদ ও সুসাহিত্যিক আরবী ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকীকরণ ও বিশ্বসাহিত্যে তার পরিচয় তুলে ধরার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক মিখ়াইল নুআইমাহ্ও ছিলেন অন্যতমতিনি ১৮৮৯ সালে বাস্‌কান্‌তাতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম মিখ়াইল নুআইমাহ্‌ বাল্যকালে তিনি পিতামাতার পরম আদরস্নেহে লালিত পালিত হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং খুবই বিনয়ী ও নম্র প্রকৃতির ছিলেন। মেধা ও চরিত্রগুণে মা-বাবার মন জয় করতে পেরেছিলেন। ফলে পুরো পরিবারের পরম আদরের পাত্র ছিলেন
 
শিক্ষার্জনঃ
জন্মস্থানেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। অতঃপর ১৮৯৯ সালে রুসিয়া মাদ্‌রাসায় ভর্তি হন। এই মাদ্‌রাসাটি অর্থোডক্স বংশধরদের খিদমত করার জন্য সে দেশে তৈরি হয়েছিল। অতঃপর তিনি ১৯০২ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য ফিলিস্তিনের নাসেরাহ্‌-তে যান। সেখানে দীর্ঘ ছয় বছর অতিবাহিত করেন। চতুর্থ বছরের পাঠ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ হতে বৃত্তি লাভ করেনঅতঃপর ১৯০৬ সালে বোলতাফার আর্‌-রূহীতে চলে যান। সেখানে রাশিয়া সাহিত্য অধ্যয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং টলস্টয়ের রচনাসমূহ অধ্যয়নে মনোসংযোগ করেন। কিন্তু ১৯১১ সালে তিনি রাশিয়ার প্রতি বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে লেবাননে ফিরে আসেন। অতঃপর এ বছরে তিনি নিজ ভাইয়ের সাথে ওয়াশিংটনে সফর করেন। এবং সেখানে ইংরেজী সাহিত্য পড়া শুরু করেন, যা তাঁকে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পাঠে সহযোগিতা করেছিল।
 
উচ্চশিক্ষা ও কর্মব্যস্ততাঃ
মিখ়াইল নুআইমাহ্‌ ১৯১১ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর লেবানন থেকে ফিরে আসেন এবং আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। কিছুদিন সেনাবাহিনীতে চাকুরী করার পর ফ্রান্স যাত্রা করেন। অতপরঃ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ফ্রান্সের ইতিহাস ও সাহিত্য অধ্যায়ন করেন। ক’বছর বাদে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে তিনি প্রত্যাবর্তন করে  সেখানে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ আরম্ভ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি ওয়াসিংটন বিশ্বাবদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে ডক্টরেট লাভ করেন।
 
ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি জিব্‌রান খালীল জিব্‌রানের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। জিব্‌রানের ইয়াসূ’ ইব্‌নু ইন্‌সান গ্রন্থে সংকলিত মিখ়াইল নুআইমাহ্‌র অনেকগুলো চিঠি তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। ১৯২০ সালে তিনি আর্‌-রাবেতাহ্‌ আল্‌-কালামিয়্যাহ্‌ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। ১৯৩১ সালে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালীল জিব্‌রানের মৃত্যুর পর লেবাননে ফিরে আসেন।
 
চিন্তাধারাঃ
এরপর মিখ়াইল নুআইমাহ্‌ নিজ কাজে গভীর ভাবে মনোযোগী হয়ে পড়েন। চিন্তাচেতনার জগতে ডুবে যেতে লাগলেন। খানিকটা নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়লেন। কোলাহলপূর্ণ জনসমাজ থেকে দুরে থাকতে আরম্ভ করলেন। চিন্তাভাবনা দ্বারা উম্মুক্ত ও উদ্ভাসিত অবস্থার মূল এবং অস্তিত্বের রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা করতে লাগলেনআর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক কাজের মাধ্যমে চুপিচুপি নিজ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন
 
পাশ্চাত্য কাব্যকবিতা ও সাহিত্যের প্রভাব বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের যে সব কবিদের উপর প্রকট মিখ়াইল নুআইমাহ্‌ও তার ব্যতিক্রম নন। এই প্রভাব তাঁর চেতনার রাজ্যে যুগান্তকারী ক্রিয়া করে এবং তারই প্রতিফলন বিধৃত হয়েছে তাঁর সমগ্র শিল্পকর্মে। কবি ধ্যানস্থ, আত্মস্থ এবং সর্বোপরি বিদ্রোহী। বিবর্তন-প্রয়াসী কবির কাব্য-গ্রন্থ দীওয়ানগুলি সেই ধারারই জ্বলন্ত স্বাক্ষর। অত্যাচারিতশোষিত সমাজ জীবনের ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে কবির প্রশ্ন আমরা কোথায় আছি, কোথায়? কোথায়? আত্মীয়স্বজন নেই আমাদের; নেই প্রতিবেশী। কবির বিদ্রোহ ক্লেদাক্ত সমাজ জীবনের বিরুদ্ধে। কবির সমস্থ যন্ত্রনা দলিত-মথিত হয়ে এমন কাব্য-কুসুমের জন্ম দিয়েছে যার ঘ্রাণ সমগ্র বিশ্বের হাওয়ায় স্পন্দিত। কবিতার ধ্বংসস্তুপের উপর নব পদ্ধতির প্রাসাদ রচনার তিনি প্রয়াসী। এই শিল্প চেতনাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে নব রুপায়ণের লক্ষ্যে। কবি অতি মাত্রায় পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবিতআর এর একমাত্র কারণ হল এই যে লেবানে জন্মগ্রহণ করলেও কবির দীর্ঘজীবন কেটেছে রাশিয়া এবং আমেরিকায়।
 
সৃজনশীল ব্যাক্তিত্বঃ
আইন বিধানের শিক্ষক হওয়ার জন্য তিনি অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা ও চিন্তা শক্তির দ্বারা আরবী সাহিত্যের আধুনিকীকরণ করেছেন। তিনি অসংখ্য সাহিত্য রচনা করে আরবী সাহিত্যের জগৎকে নতুন রুপ দিয়েছেনআরবী সাহিত্যের আধুনিকীকরণ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেতিনি ২৫টিরও বেশী গ্রন্থ বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যেমন— যাদুল্‌ মা‘আদ, আল্‌—য়াদির, আল্‌-আওসান, সাওতুল্‌ ‘আলাম, আন্‌-নূর ওয়াদ্‌ দাইহূর, ফী মাহাব্‌বির্‌ রীহ, দারূব, আব্‌‘আদু মিন মোস্কো ওয়া মিন্‌ ওয়াশিন্‌তান, আল্‌-মারাহিল। এছাড়া তিনি অনেক গল্প কাহিনী লিখেছেন যেমন— হাওয়ামিশ, আবূ বাত্‌তাহ্‌, কানা মা কানা, ইয়া ইব্‌না আদাম, আল্‌-ইয়াওমুল্‌ আখীর, মির্‌দাদ, লেকা, মুজাক্‌কারাতুল্‌ আর্‌কাশ, আকাবির। তিনি বহু নাটক রচনা করেছেন যেমন— আইয়ুব, আল্‌-ওয়ারাকাতুল্‌ আখীরাহ্‌, আল্‌-আবাউ ওয়াল্‌ বানূন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করে আরবী সাহিত্যের জগতে এক নতুন দিগন্তের সুচনা করেন। প্রবন্ধ, গল্প, কাহিনী, নাটক, রম্য রচনা, দৃষ্টান্ত মুলক কবিতা, চিঠিপত্র, পূর্বের ইতিহাস ঐতিহ্য, বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচনা করে স্বীয় অবদান অক্ষুন্ন রেখেছেন
 
মৃত্যুঃ
প্রায় এক শ’ বছরের দীর্ঘ জীবনে নানা বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে, আরবি সাহিত্য ও আরব সমাজকে নানা আঙ্গিকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করে ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে আশ্‌-শাখ্‌রূব গ্রামে ইহলোক ত্যাগ করেন।

No comments:

Post a Comment