Saturday 21 December 2019

এ লড়াই ভালোবাসার জন্য, ঘৃণার বিরুদ্ধে !


এ লড়াই ভালোবাসার জন্য, ঘৃণার বিরুদ্ধে !
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 
আজ আমার যা বয়স, বাবার বয়স তখন এরকমই হবে! আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ৭১-এর আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মানুষ। নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষছে আমার মায়ের ভাষা। বাঙালি ঘটিবাটি হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকার গায়ে দিয়ে দলে দলে চলে আসছে এপারে; বিভাজন রেখা পেরিয়ে ভারতে।
আমার বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। আমার আবেগের শহর, যার নাম এখনো আমাদের সাথে জুড়ে রয়েছে, দিনাজপুর; আমার বাড়ি থেকে আধ ঘণ্টার দুরুত্বে, ওই বিভাজন রেখার ওপারে; তাই আমাদের আলাপ হয় বইয়ের পাতায়। খান-বাহিনীর অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে সেই রেখা পেরিয়ে এপারে আসছে মানুষ। শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। পুরুষদের পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি আর মেয়েদের শাড়ি। তাদের সবার পরিচয়, তারা বাঙালি। ওই লুঙ্গিতে কেউ হিন্দু তো কেউ মুসলিম। না, তাদেরকে পোশাক দেখে সেদিন আলাদা করা যায়নি। কারণ, ভারতে তখনো এ বিষবাষ্প ছড়ায়নি।
এপারে তাদের জন্য সরকার ও সাধারণ মানুষ আশ্রয় ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের যন্ত্রণায় একটু ভালোবাসার প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে-সময় আমার বাবা-(কাকারা)ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা রান্না করে বাবার হাতে দিতেন। আর বাবা সেই খাবার ওই লোকেদের কাছে পৌঁছে দিতেন। পুরাতন জামাকাপড়, কাঁথা-কম্বল এবং চিড়ে-মুড়ি-গুড় সংগ্রহ করে তাদেরকে দিতেন। তবে তা ছিল ভালোবাসার একটা চারা মাত্র।
যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হল। অনেকে ফিরে গেল। কেউ কেউ এপারেই থেকে গেল। তাদের কিছুজন সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেল সম্পর্কের অজানা জগতে; জীবিকার জন্য ওই মফঃস্বল থেকে শহরতলী বা শহরে; হয়তো বা কোলকাতায় যাদবপুরে।
বাবা, মাঝে মাঝে সন্ধ্যা বেলা আমাকে সেই গল্পগুলো শোনাতেন। এক হিন্দু বৃদ্ধা কীভাবে বাবার মাথায় হাত বোলাতেন, কান্না জোড়ানো কণ্ঠে বাবাকে আশীর্বাদ করতেন। একটি ছোট্ট ফুটফুটে শিশু ছিল তাদের সাথে। বাবা আদর করে কোলে তুলে নিতেন। তার নাক টিপতেন। কাতুকুতু দিতেন আর শিশুটি খিলখিল করে হাসত। সে যে শিশু, আর শিশুরা তো বুঝতে পারে না, শিবির কী, আর ডিটেনশন ক্যাম্প কী?
বাবা মারা গেছেন আট বছর হল। সেসব গল্প আমাকে এখন আর কেউ শোনায় না। তবে বহু বছর পর, আজ তাদের দেখা পেলাম। ওই বৃদ্ধা (দাদী মা)-র নাতিনাতনিদের, ওই ফুটফুটে শিশুটির, এখন সে প্রৌঢ়, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় গলফ-ক্যাপ। তাদের দেখা পেলাম আজকের ‘নো-এনআরসি’র মিছিলে, হাজার হাজার মানুষের মুখে, মনে, অভিব্যক্তিতে। বাবার লাগানো ভালোবাসার ওই চারাটি এখন বিশাল মহীরুহ, তারই ফলফুল হাতে নিয়ে তারা এসেছেন। একে অপরকে ভালোবাসার জন্য। পরপস্পরের হাত ধরে। কেউ প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে। কেউ বন্ধুর সাথে। কেউ সহপাঠীর হাত ধরে। কেউ সহকর্মীর কাঁধে হাত রেখে।
তাদের লড়াই, তাদের আন্দোলন, তাদের মিছিল ভালোবাসার জন্য; ঘৃণার বিরুদ্ধে!
তাই আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা জিতবে!

১৯-১২-২০১৯ 
কোলকাতা-৩৯

আপনি কি এই সময়ের গডসে...!

বড্ড অসহায় লাগছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতোর। কান্নার তীব্রতা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়তআর চেপে রাখতে পারছি না।
আমার অপরাধটা কীআমি মুসলিমতিরঙ্গাকে কপালে বেঁধেছিএটা আমার অপরাধ! গঙ্গার জলে অযু করেছিএটা আমার অপরাধ! ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ মাটিতে দিনে পাঁচ টাইম সাজদাহ্‌ করি (মাথা ঠেকাই)এটা আমার অপরাধ! সংবিধানকে বুকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিএটা আমার অপরাধ! গান্ধী-আম্বেদকরের ছবি হাতেতাঁদেরই দেখানো পথে আন্দোলনে নেমেছিএটা আমার অপরাধ! আমি জামিয়াআলীগড়জেএনইউজেইউ-তে পড়ছিএটা আমার অপরাধ!
আমার অপরাধটা কীএকবার স্পষ্ট করে বলবেন!
আমার আন্দোলন দেখে আপনার মনে হতে পারেএটা কাটার বাচ্চাদের আন্দোলন। কিন্তু আমার আন্দোলনআমার অস্তিত্বের সংগ্রাম। সংবিধান রক্ষার লড়াই। ভারতের শ্রেষ্ঠত্ববহুত্ববাদ-কে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মযবুত করার প্রাণপণ প্রয়াস।
আমার লড়াইটা মোদিয়া (মিডিয়া)-র অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। আঞ্জনা-অর্ণব-সুধির-রুবিকা নামক আইটি সেলের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে। আমার আন্দোলন স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। পুলিশি পোশাকে গুণ্ডারাজের বিরুদ্ধে।
গতকাল জামিয়া ও আলীগড় ক্যাম্পাসে ঢোকা পুলিশদের উপর গডসের আত্মা ভর করায় তারা যে তাণ্ডব করেছেএসব দেখার পরেও আপনি যদি মনে করেনঠিক হয়েছে কাটার বাচ্চাদের সাথে। তাহলে আপনি আধুনিক যুগের গডসে। আপনিই প্রকৃত গান্ধী (-র বিচারধারা)-র হত্যাকারী। ঘেন্না হয় আমারআপনাকে শতসহস্র সভ্যতার লালনভূমি এই মাটির উত্তরাধিকারী ভাবতে!

১৬-১২-২০১৯
পার্কসার্কাস, কোলকাতা



তিনি যে-পথে বিপ্লব এনেছিলেন, হোক কলরব সে-পথে

যে মহামানবটির ভালোবাসা বুকে লালন করে আছিতাঁকে তায়েফের লোকেরা মেরে রক্তাক্ত করে দিলজবাবে তিনি তাদের জন্য করুণার প্রার্থনা করলেন।

যাতায়াতের সময় পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতোমাথার উপর ময়লা-আবর্জনা ছুঁড়ে দিত এক মহিলাএকদিন মাথায় ময়লা পড়ল নাপথে কাঁটা নেইছুটে গেলেন তার বাড়িখোঁজ নিতে।

যে লোকটা পিছু নিয়েছিলঅস্ত্র তুলেছিল মারার জন্য কিছুক্ষণ আগেতাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিলেন।

তাঁর এই আন্দোলনএই বিপ্লব ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক পদ্ধতিতে।

চলুনআমরাও আন্দোলন করিশান্তিপূর্ণ ভাবে। কোনো সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তিকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সতর্ক ভাবেযাতে কোনো সাধারণ মানুষের গায়ে আঁচড় অবধি না লাগে। রোগী ও সেবাযানের প্রতি যত্নশীল ও সহানুভূতিশীল হয়ে।

একবার ভেবে দেখুনযাদবপুরের ওই হাঙ্গামার দিনযেদিন কেউ একজন টেনেছিল বাবুল-জীর বাল (চুল) যার কারণে ছুটে গেছিলেন রাজ্যপালসেদিন কত কিছু ভাঙচুর করা হয়েছিলগেটের বাইরের ওই কাকুর দোকানটা অবধি তছনছ করে দিয়েছিল ওরাযদি আপনিও আন্দোলন করতে গিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেন পথঘাটতাহলে আপনার ও ওদের মধ্যে কী পার্থক্য...!

হোক কলরব, হোক আন্দোলন, তাঁর (সা) দেখানো পথে!

১৪-১২-২০১৯
কোলকাতা-৩৯



শুধু আবৃতি নয়, চেতনায় লালন করুন!

মনে পড়ছে কবিতাটানিশ্চয় মনে পড়ছেপ্রতিটা লাইন এখনো গড়গড় করে বলতে পারেন। ছোটবেলা স্কুলে কতবার আবৃতি করেছেনতাই না! আবৃতি প্রতিযোগিতায়বার্ষিক অনুষ্ঠানেউৎসবে। পুরষ্কারও পেয়েছেন। শ্রোতাদের বাহবা কুড়িয়েছেন। প্রশংসা পেয়েছেন। আবৃতির ভিডিও ইদানীং ইউটিউবে আপলোড করে লক্ষ লক্ষ ভিউলাইকশেয়ার ও কমেন্টস পাচ্ছেন।

তবে শুধু আবৃতিই করেছেন। কবিতার কথাগুলোকেকবির চেতনা ও ভাবনাকে নিজের মনের গহ্বরে লালন করতে পারেননিনিশ্চয়ই পারেননি। কণ্ঠের সুর দীর্ঘ করেকখনো স্বর চওড়া ও আওয়াজ দরাজ করে পাঠ করেছেন। কিন্তু কবির মনের গহীন থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আর্তনাদ আপনার মনকে ছুঁতে পারেনি।

যদি এই কবিতা আপনার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতকবির আহ্বানে আপনার মন বিচলিত হতোতাহলে দেশের এই দুর্দিনে আপনি অমন নির্বাক থাকতে পারতেন না। সংবিধানের মৌলিকতা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দেখেও কফি মগে চুমুক দিতে দিতে বলতেন না, ‘শালা কাটার বাচ্চারা! শান্তির ছেলেরা! ঠিক হয়েছে শালাদের...!’

আপনি অহরহ বলেন, ‘ওরা গান্ধীজীকে হত্যা করেছেবাপুকে মেরেছে’। আজ আপনার নীরবতা গান্ধীজীর আদর্শকে হত্যা করছে। ভারতের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করছে। মৌলানা আজাদের বিশ্বাসকে তছনছ করছে। এপিজে'র চেতনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেএকবারও ভেবে দেখেছেন কি?

এতকিছুর পরেও আপনি নীরব। কারণ আপনি কবিতাটা মুখস্থ করেছেনস্রেফ মুখস্থ করেছেনউপলব্ধি করতে পারেননি।
... 
হ্যাঁঠিকই ধরেছেনআপনাকেই বলছি!

১৫-১২-২০১৯
কোলকাতা-৩৯



উনি দ্বেষের বিকাশ করেছেন...!

উনি বলেছিলেন ‘দেশের বিকাশ করবেন’। উনি কথা রেখেছেন। উনি ‘দ্বেষের’ বিকাশ করেছেন। আর তার ‘সুফল’ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে-গঞ্জে।

যে বন্ধুটি একদা আমার সাথে বিস্কুট শেয়ার করেছিল। হাত ধরাধরি গ্রামের মাঠেপুকুর ধারেনদীর পাড়ে হেঁটেছিলমেঠো আলপথে সাইকেল চালিয়েছিলএখন অপেক্ষায় আছেসময়-সুযোগ পেলেই আমাকে আমার সাইকেল (নাগরিকত্ব) থেকে ফেলে দেবে।

যে মাস্টার মশাই আমাকে দেশপ্রেমের পাঠ পড়িয়েছিলেনমানবিকতা শিখিয়েছিলেনআমার প্রতি এই অমানবিক অত্যাচার ও বর্বর আক্রমণ দেখে মনে মনে পুলকিত হচ্ছেন।

যে শিক্ষিকা আমায় আদর করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শিখিয়েছিলেনরবীন্দ্র প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলেনআজ যখন আমি মানব-বন্ধনে (হিউম্যান চেইনে) দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে আন্দোলন করছিউনি তা দেখে কপালে ভাঁজ ফেলেতির্যক চাহনি দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলছেনম্লেচ্ছর মুখে রবীন্দ্রনাথ।

যে কাকিমাএকদা আমাকে তার সন্তানের পাশে বসিয়ে যত্ন করে পায়েস-ক্ষীর খাইয়েছিলেনআজ আমার দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আমার বরবাদির খুশিতে পায়েস খাওয়াচ্ছেন।

যে মেয়েটি আমার ভালো ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েবা পড়াশুনোয় আমার একাগ্রতা দেখে একদা আমার প্রতি ক্র্যাশ খেয়েছিলআজ তার মনে আমার জন্য একরাশ ঘৃণাএত বেশি ঘৃণা যেআমাকে জব্দ করতে সে এখন কুলদিপ সেঙ্গার (উন্নাও ধর্ষণ কাণ্ডের নায়ক)-কেও ভোট দিতে রাজি।

আর তাই এ কথা স্পষ্ট যেএই ক’বছরে বিকাশ হয়েছেদেশব্যাপী দ্বেষের বিকাশ হয়েছে।

বিঃ দ্রঃ জানিঅনেকে এমনও আছেনযারা এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেনসংবিধানের মৌলিকতা রক্ষা করতেবহুত্ববাদকে বাঁচাতেস্বৈরতন্ত্রকে রুখতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেনএমন সকলকেই কুর্নিশ করছিশ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছি। তবে এমন মানবিক লোকেদের সংখ্যা খুবই কম। বহু সংখ্যক লোক এখনো তীরে দাঁড়িয়ে (সংবিধানধর্মনিরপেক্ষত ও গণতন্ত্র-এর) তরী ডুবার দৃশ্য দেখতে উৎসুক।

১৬-১২-২০১৯
কোলকাতা-২৩

No comments:

Post a Comment