জিব্রান খ়ালীল জিব্রান
(১৮৮৩ – ১৯৩১ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
উনিশ শতকের বিখ্যাত সাহিত্য সংগঠন আর্-রাবিত়াহ্ আল্-ক়ালামিয়্যাহ্–এর প্রাণপুরুষ ছিলেন জিব্রান। তিনি একাধারে বিখ্যাত কবি, লেখক ও চিত্রকর ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে আরবী সাহিত্যকে জগত সভায় বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, তিনি ছিলেন মাহ্জার অর্থাৎ প্রবাসী সাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারী লেবাননের বাশারী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মেষপালক পিতা সা‘আদ জুবরান একজন মদ্যপায়ী ও দুশ্চরিত্রবান ছিলেন। তাঁর মা কামিলা রাহ়্মা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারের কন্যা।
পাঁচ বছর বয়সে জুবরান গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে থেকে বাইবেল এবং আরবী ও সিরীয় ভাষার প্রাথমিক পাঠ অর্জন করেন। পাশাপাশি মায়ের নিকট সংগীত ও চিত্রাঙ্কন শেখেন। মনোরম ও অনুকূল পরিবেশে জুবরান বড় হতে থাকেন। দশ বছর বয়সে একবার পড়ে গিয়ে চোট পান, শেষ জীবন পর্যন্ত যার ভুক্ত ভোগী ছিলেন।
কর ফাকি দেওয়ার অপরাধে তাঁর পিতাকে পুলিশ গ্রেফতার করলে, ১৮৯৫ সালে তাঁর মা জুবরান সহ তিন সন্তানকে নিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন এবং বোস্টন শহরে বসবাস শুরু করেন। এখানে লেখক ১৮৯৭ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন।
মাতৃভাষা আরবীতে দক্ষতা অর্জন করতে ১৮৯৮ সালে লেবাননে ফিরে আসেন। বেইরুতের মাদ্রাসাতুল্ হিক্মাহ্ থেকে তিন বছর অধ্যয়ন কালে আরবী, ফরাসী ও বাইবেল শিক্ষা অর্জন করেন। এখানে তিনি এক নারীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু ওই যুবতী তাঁর প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সহোদরার অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন।
১৯০২ সালে বোস্টন ফিরে আসার পর থেকে কয়েক মাসের ব্যবধানে বোন, দাদা এবং মায়ের মৃত্যুতে জুবরান অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। ১৯০৮ সালে মেরী হাস্কেল নামক জনৈকা রমনীর সহযোগিতায় প্যারীস গমন করেন ও বিখ্যাত ফরাসী চিত্রশিল্পী রোডিনের কাছে চিত্রকলা শেখেন। ১৯১২ সালে নিউ ইয়র্কে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। সেখানে চিত্রাঙ্কন ও লিখনীতে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। উল্লেখ্য যে, তার প্রথম সভাপতিত্বে ১৯২০ সালে আমেরিকায় আর্-রাবিত়াহ্ আল্-ক়ালামিয়্যাহ্ নামক সাহিত্য সংগঠনের সূচনা হয়।
১৯৩১ সালের ১০ই এপ্রিল এই স্বনামধন্য সাহিত্যসাধক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার শেষ ইচ্ছা মতো ২১শে আগস্ট তার শবদেহ বেইরুতে নিয়ে এসে জন্মস্থান বাশারীতে পুনঃসমাধিস্থ করা হয়।
তিনি আরবী ও ইংরেজী উভয় ভাষাতেই বহু সৃজনশীল রচনা রেখে গেছেন। তার মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হলো— আন্-নাবী (দ্য প্রোফেট), আল্-মুসীক়ী, আল্-আর্ওয়াহ় আল্-মুতামার্রিদাহ্, আল্-আজ্নেহ়াতুল্ মুতাকাস্সিরাহ্, ইলাহাতুল্ আর্দ়, দুম্‘আতুন্ ওয়াব্তিসামাহ্, আল্-মাজ্নূন।
জুবরানের প্রতিভা যেমন বহুমুখী ছিল, তেমন তার লেখার বিষয় ও বৈশিষ্ট্যের মাঝেও বহুমুখীতা লক্ষ্য করা যায়। তাঁর নিজ জীবনের বিয়োগান্তিক পরিস্থিতি তাঁর বহু গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর রচনায় মানব জীবন, ন্যায়, সততা, ধর্ম ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। তিনি কোনো কোনো রচনায় প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার, অত্যাচার, অজ্ঞতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তার সর্বাধিক বিখ্যাত রচনা আন্-নাবীতে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মানবজীবনের বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment