Tuesday 10 September 2019

আবুত-তাইয়িব আল‌-মুতানাব্বী


আবুত্‌-তাইয়িব আল্‌-মুতানাব্বী
( ৯১৫-৯৬৫ খ্রি / ৩০৩-৩৫৪ হি )
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

পরিচিত ও জন্ম
আব্বাসি যুগের অন্যতম প্রধান কবি আল্‌-মুতানাব্বীতিনি আরবি সাহিত্যের প্রাচীন নীতির পরিবর্তন করে এক অভিনব রীতি প্রবর্তন করেন। কাব্য ও দর্শনকে তিনিই সর্ব প্রথম একাত্ম করে তুলেন। প্রকৃত নাম আহমাদ উপনাম আবুত্‌ তাইয়িবতবে ‘আল্‌-মুতানাব্বী’ (নবিত্বের দাবীদার) নামে অধিক পরিচিত। পিতার নাম হুসাইন। ৯১৫ খিষ্টাব্দে (মোতাবেক ৩০৩ হি) কুফার কিন্দা নামক স্থানে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।

বিদ্যার্জন  
কবি জন্মেছিলেন এক হতদরিদ্র পরিবারে। তাঁর পিতা জনসাধারণের জন্য জল সরবরাহের কাজ করতেন। বাল্যকালে কবি পিতাকে জল সরবরাহের কাজে সাহায্য করতেন। দৈন্যতা হতে মুক্তি পাবার আশায় পিতা-পুত্রে সিরিয়া গমন করলেন। রাজধানী দামেস্কাসে আশ্রয় নিলেন। সেখানে পিতা নিজ পুত্রের জন্য সাধ্যমত বিদ্যার্জনের ব্যবস্থা করলেন। দৈন্য অবস্থাকে পরাজিত করে বালক মুতানাব্বি মনোনিবেশ করলেন বিদ্যা চর্চায়। ক’বছর বাদ তাঁর বুৎপত্তির কথা ছড়িয়ে পড়ল দামেস্কাসের আনাচেকানাচে।

উচ্চাভিলাষ
যৌবনকালেই নিজ কবিত্বের ছাপ ফেলেন সাহিত্য জগতে। যৌবনেই কবি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গ্রামীন ভাষা ও শৈলীতে কাব্য রচনা করে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ক্রমাগতভাবে তাঁর ভক্তদের সংখ্যা বাড়তে লাগলনিজ প্রতিভা ও অনুরাগীদের ভালোবাসা দেখে উচ্চাভিলাষী কবি খলীফা বলে দাবী করে বসলেন। মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টি চারু হয়ে গেল। খবর পেয়ে রাজ্যপাল তাঁকে বন্দী করলেন। কিন্তু কবি বন্দীশালায় রাজ্যপালের প্রশংসা করে একটি অপূর্ব কবিতা রচনা করলেন। তাঁর সেই কবিতা[1] শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্ত করে দিলেন।
কবির উচ্চাভিলাষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশছোঁয়া। তাই সিরিয়ায় কাল্‌ব গোত্রে, অন্য বর্ণনানুসারে বাদিয়াতুস্‌ সামাওয়াহ নামক স্থানে ৩২৩ হিজরিতে তিনি নবি হওয়ার দাবী করেন। কাব্যালংকারে সজ্জিত স্বরচিত কবিতাগুলিকে নিজের মু’জিযা (অলৌকিক বিষয়) ও ঐশীবানী বলে অভিহিত করেন। এবং বলেন, নবি মুহাম্মদ (সা)-ও আমার আগমনের এবং নবিত্বের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “লা নাবিউন্‌ বা’দি” (আমার পরে ‘লা’ নামের একজন নবি হবেন।) আর আকাশে আমার নাম ‘লা’।[2]  
হিমস প্রদেশের অধিপতি লু’লু’ এ বিষয়টি জানতে পেরে তাকে বন্দী করেন। পরবর্তীতে কবি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হওয়ায় তাকে মুক্ত করে দেন তিনিকবির এই মিথ্যা দাবীর কারণেই তাঁকে আল্‌-মুতানাব্বী (নবীত্বের দাবীদার) নামে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ নামেই তিনি অধিক পরিচিত।

সাইফুদ্দৌলাহ ও কাফুরের দরবারে  
কারাগার হতে মুক্তি লাভের পর কবি ইন্তাকিয়ার রাজ্যপাল আবুল আশাইর-এর মাধ্যমে আলেপ্পোর আমির সাইফুদ্দৌলাহর নিকট পৌঁছোতে সক্ষম হন সেখানে তাঁর স্নেহাশ্রয়ে নয় বছর থাকেন। শেষের দিকে কবি ও সাইফুদ্দৌলাহ্‌র মাঝে কোনো এক বিষয়ে মনমালিন্য হয়। যার কারণে কবি ৩৪৬ হিজরিতে সেখান থেকে মিশর যাত্রা করেন[3]
মিশরে পৌঁছে ইক্‌শীদ বংশীয় শাসক মালিক কাফুর-এর দরবারে আশ্রয় গ্রহন করেন। কিন্তু সেখানে আশানুরূপ সমাদর না পাওয়ায় সেখান থেকে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সেখানেও বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি; আরও কিছু জায়গায় পরিক্রমা করে অবশেষে বুয়াইদ শাসক আযদুদ্দৌলাহর নিকট আশ্রয় নেন।

পরলোকগমন
৩৫৪ হিজরিতে পারস্য হতে বাগদাদ যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল পুত্র মাহসাদ ও দাস মাফ্‌লাহ। পথিমধ্যে আস্‌-স্বাফিয়া[4] নামক স্থানে দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হন। প্রাণ বাঁচাতে পালাবার উপক্রম করেন। আর তাকে পলায়নপদ দেখে দাস মাফ্‌লাহ চিৎকার করে বলে— না, লোকেরা আপনার সম্বন্ধে বলবে, আপনি ভয়ে পালিয়ে গেছিলেন। অথচ আপনিই তো বলেছেন, “আল্‌-খায়লু ওয়াল্‌-লায়লু...” (আমাকে চেনে ঘোড়া, রাত আর বিস্তীর্ণ মরুভূমি। আমাকে চেনে তরবারি, বল্লম, কাগজ ও কলম।)[5] কবি ফিরে আসে আক্রমণ করেন এবং বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে যান।

কাব্য-বৈশিষ্ট
আরবি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয়। তাঁর অধিকংশ কাব্য তাঁর জীবনকালে সাক্ষাৎ পাওয়া রাজাদের প্রশংসা করে লেখা। কারো কারো মতে, তাঁর ৩২৬টি কবিতা তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে রচিত হয়েছে। নয় বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও রসবোধের জন্য তিনি পরিচিত। তাঁর কবিতার আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সাহস, জীবনদর্শন ও যুদ্ধের বর্ণনা। তাঁর অনেক কবিতা তৎকালীন সময়ে এবং বর্তমান আরব বিশ্বেও বিস্তৃত এবং সমাদৃত। তাঁর কবিতাকে প্রবাদতুল্য গণ্য করা হয়। তেমনই একটি বিখ্যাত উক্তি হল, "সিংহের দাঁত দেখা গেলে ভেবো না সিংহটি হাসছে।"
কবি মুতানাব্বি তাঁর মেধার কারণে সে-সময়ের অনেক নেতার সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। সেসব নেতা ও রাজাদের প্রশংসা করে কবিতা লেখেন। বিনিময়ে শাসকরাও তাঁকে অর্থ ও উপহার প্রদান করেন। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর শক্তিশালী কাব্যিক ধারা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
মুতানাব্বি ছিলেন একজন ভাবকবি তিনি কাব্য ও দর্শনের মাঝে সমন্বয় সাধন করেছেন। কবিতাকে আবু তাম্মাম ও তাঁর মতালম্বীদের বন্ধন থেকে মুক্ত করেছেন। কাব্যিক রচনাশৈলীর ক্ষেত্রে আরবীয় সনাতন পদ্ধতি পরিহার করেন। তিনি ছিলেন আরবি কাব্যে এক অভিনব পদ্ধতির অগ্রপথিক। কবিতায় ব্যাপকহারে প্রবাদের যোগ ঘটান যুদ্ধের বর্ণনায় অভিনবত্ব আনেন এবং প্রশংসা ও নিন্দা উভয় ক্ষেত্রেই নতুনত্ব প্রবর্তন করেন। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট হল ব্যাক্তিত্বের ছাপ, মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং ইচ্ছার নিখুঁত চিত্রায়ন এবং জীবনের উদ্দেশ্যাবলীর বিবরণ প্রদান। এই সকল কাব্যিক গুনাবলী তাঁকে আব্বাসি যুগের শ্রেষ্ঠ কবির আসনে আসীন করেছে।  



[1]
أ مالك رقي و من شأنه     هبات اللجين و عتق العبيد
دعوتك عند انقطاع الرجا     ء و الموت مني كحبل الوريد            
[2] আহ্‌মাদ হাসান যাইয়াত, তারিখ, পৃষ্ঠা—
"و في سنة 323 هـ ادعى النبوة في الشام، و لما سئل عن النبي ص قال: إنه بشر بمجيئي و أخبر بنبوتي فقال: لا نبيٌ بعدي، و أنا اسمي في السماء (لا)."
[3] আহ্‌মাদ হাসান যাইয়াত, তারিখ, পৃষ্ঠা—
" فضمه الأمير إليه حتى لا يفارقه في الحرب و لا في السلم، و لم يزل معه في حال حسنة حتى حدثت بينهما جفوة ففارقه إلى مصر في سنة 364 هـ."
[4] الصافية  
[5]  
لا يتحدث الناس عنك بالفرار و أنت القائل:
الخيل و الليل و البيداء تعرفني     و السيف و الرمح و القرطاس و القلم

No comments:

Post a Comment