Friday 20 September 2019

ছেলে যখন বাবা সাজে আর মেয়ে সাজে মা...!

ছেলে যখন বাবা সাজে আর মেয়ে সাজে মা...!
   


সেদিন (১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) সকালে, কোলকাতা স্টেশন থেকে ফেরার পথে ছবিটা তুলেছিলাম। সঙ্গে ছিল ওবাইদ ও আমিন। হাঁটছিলাম বাম ফুট ধরে আর জি কর মেডিকেল কলেজের দিকে। হঠাতই নজর গেল। চমকে উঠলাম। মুহূর্তের জন্য এক অবচেতন আবহ ঘিরে ধরল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই ক্যামেরাবন্দী করলাম। 

সত্যিই, সবাই মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় না। কেউ কেউ আগলে রাখে। তাঁদেরকে এবং তাঁদের সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। বার্ধক্যে বাবা যখন শিশুসুলভ আচরণ করে, তখন তারা বাবা সাজে...! 

আজ যখন চারিদিকে বস্তুবাদী নেশায় সবাই বুঁদ হয়ে আছে; ক্যারিয়ারের গ্রাফ উঁচু থেকে উঁচু করতে সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ যা যা দরকার সব এপ্লাই করছে। যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কোথাও পিতা নিজ পিতৃত্বের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতে পারছে না, তো কোথাও সন্তান পিতামাতার প্রতি তাঁর দায়িত্বকর্তব্যকে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে। যার কারণে দিনদিন শহরের অলিতে গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। তবে এটাই দিনদিন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। আর বৃদ্ধাশ্রমে যে পজেটিভ কোনো দিক নেই, আমি তা বলছি না। সব কিছুতেই ভালোমন্দের মিশেল আছে। 

যাইহোক, সমাজে কিন্তু এখনো এমন চিত্র মাঝেমধ্যে দেখা দেয়। আর সত্যি করে বলতে গেলে, এও এক অদ্ভুত অনুভূতি। আমি নিজেও ব্যক্তিগত পরিসরে তা অনুভব করেছি এবং, আল্‌-হাম্‌দু লিল্লাহ এখনো অল্পবিস্তর স্বাদ পাচ্ছি। আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন বাবাকে হারাই; তবুও যেহেতু আমি তখন কোলকাতায় টিউশন পড়াতাম, তার সুবাদে বাড়ি ফেরার সময় বাবার জন্য পছন্দ মতো খাবার, মিষ্টি, ফলমূল, কখনো নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র কিনে আনতাম। আর বাবা সেসব পেয়ে শিশুর মতো করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন। বাড়ির আশপাশ দিয়ে যারাই যেতো, ডেকে ডেকে দেখাতেন, এই দেখো এই গেঞ্জিটা মাতিন আমার জন্য কোলকাতা থেকে এনেছে। কেউ বেড়াতে আসলে, মিষ্টিমিষ্টান্ন, বিসকুট, ফলমূল খেতে দিয়ে বলতো, খাও খাও ছেলে কোলকাতা থেকে আমার জন্য এনেছে। বাবার ওই আহ্লাদী স্বর এখনো আমার কানে ভাসে। মনে মনে খুব কষ্ট হয়, তখন যদি আর একটু কষ্ট করে, আরও দুটো পয়সা রোজগার করে বাবার জন্য ভালো কিছু আনতে পারতাম! 

আরও একটা মজার ব্যাপার হল, বাবা আমার প্রতিটা রেজাল্ট বহুত গর্ব করে লোকেদের শোনাতেন। সব বাবারাই যেমনটা করে আরকি। একবার ইউথ পার্লামেন্ট ডিবেটে ফার্স্ট হয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে ওই মেডেলটা যখন বাবাকে পরালাম কী খুশী! তবে খুব আফসোস হয়, বাবা আমার গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স, নেট এবং চাকরি কোনোকিছুই দেখে যেতে পারেননি। তবে আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে আমার মা এখনো বেশ সুস্থ রয়েছেন। যদিও আমার মা' খুবই সাধাসিধে মানুষ। অত কিছু বোঝে না। যেদিন আমার গ্রাজুয়েশনের রেজাল্ট বেরোল, মা'কে বললাম, আমার খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে। আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। মা'র সটান উত্তর, আল্‌-হাম্‌দু লিল্লাহ আমার ছেলে পাশ করেছে। 

মা'র এখন বেশ ভালোই বয়স। শরীরও ন্যুব্জ। আর মনটা একেবারে শিশুর মতো সরল। এই সময় মা' ও আমার সম্পর্কটা বেশ মজার। অনেকটাই এমন, যেন আমি বাবা আর মা' হচ্ছে আমার মেয়ে। কোথাও গেলে, মা'র জন্য, বাচ্চাদের জন্য যেমনটা বাবারা করেন, চকোলেট আনি, বিস্কিট আনি, মা' সেসব পেয়ে খুব খুশী হন। শিশুর মতো সারল্যে ভরা এক গাল হাসি দিয়ে ওসব আমার থেকে নেন। কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে আমার হাত ধরে হাঁটেন। নতুন কিছু দেখলে, জিজ্ঞেস করেন এটা কী, ওটা কী? শুধু একটাই কমতি, মা' আমার উপর কেন জানি, কখনো অভিমান করেন না। 

তবে এসব আমি আমার অনুমানের ভিত্তিতেই বলছি। আল্লাহ্‌ এখনো আমাকে কোনো সন্তান দেননি। তাই অভিজ্ঞতা হয়নি। যদি কোনো দিন এই বিশেষ আশীর্বাদে ধন্য হই সেদিনই আক্ষরিক অর্থে বাবা-সন্তানের এই বন্ধনটা অনুভব করতে পারবো। আর হয়তো আন্দাজ করতে পারবো, আমার মেয়ে, মানে আমার মা'র প্রতি আমার এই সোহাগ, স্নেহ, ভালোবাসা কতটা উপভোগ্য। যাই ঘটুক জীবনে, আমার এই ক্ষুদ্র অনুভূতিতে যেটুকুই বুঝতে পেরেছি তার বদৌলতে মন থেকে দু'আ করি--          
"প্রভু, আমার মা-বাবাকে করুণা করো, যেমনভাবে তাঁরা করুণা ও যত্নের সাথে আমাকে লালন-পালন করেছেন!"
[আল্‌-কুর্‌আন, সূরাতু আল্‌-ইস্‌রা ২২]   

No comments:

Post a Comment