Monday 13 July 2020

রাশীদ সালীম আল-খূরীঃ মায়ের কোলে



মায়ের কোলে  
রাশীদ সালীম আল্‌-খ়ূরী, লেবানন
 
মনে আছে তোমার, কত নিষ্ঠুর ছিলেন মুসা’র প্রভু
কত আনন্দ পেতেন তিনি রক্তপাতে!
মনে পড়ে, কীভাবে পরিবর্তন ঘটল তাঁর
কীভাবে তিনি হলেন দয়াদ্র, হলেন উদার
হলেন স্নেহপ্রবন আমাদের প্রতি, এত বেশি
যে আমাদের ব্যথায় তিনিও এখন ব্যথিত হন! 
কিন্তু, কীভাবে এতটা বদলে গেলেন তিনি?  
কীভাবে ঘটল তাঁর এই পরিবর্তন?
সে কথা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়;
লেখা আছে, বহু কাল আগে কোনো এক শহরে
লোকেরা একদিন কুড়িয়ে পেল একটি শিলালিপি;
যেটি ছিল কিছু অদ্ভুত ও অস্পষ্ট রেখায় ভর্তি 
প্রচুর ঘাম ঝরালো শহরের পণ্ডিত ও বিদ্বানেরা
তবে তার ভাব ও ভাষা উদ্ধার করতে পারল না তাঁরা।
অবশেষে একদিন উন্মোচিত হল তার রহস্য
একদল কবি স্পষ্ট করলেন তার উদ্দেশ্য; 
কারণ কবিতার স্পন্দন ও মর্ম কথা
কবিরা ছাড়া আর কে ভালো বোঝে, বলো!

লেখা ছিল তাতে, বহু কাল আগে
যীশুর আবির্ভাবেরও বহু আগে, প্রাচ্যের বুকে
মৃত্যু হয়েছিল এক প্রতিভাবান কবির
যে কবি নষ্ট করেছিল তার সারাটা জীবন পাপের সন্ধানে
বৈধ করে নিয়েছিল নিজের জন্য এমন সব কাজ ও কথা
আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে যেগুলো ছিল হারাম, ছিল কবিরা গোনাহ্‌
অতঃপর হাবিয়ার নিকষ কালো আগুণের ভেতর 
ফেরেশতারা যখন তাকে নিক্ষেপ করবে ভেবে প্রস্তুত
যে-সব অসৎ কর্ম সে পূর্বে করেছে তার শাস্তিস্বরূপ
ঠিক তখনই ঘোষনা করলেন ঈশ্বর তার ক্ষমার কথা  
মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহারের দরুন ক্ষমা করে দিলেন তাকে
ফলে নাজাত পেল সে হাবিয়ার লেলিহান অগ্নিশিখা থেকে
অতঃপর পুরস্কৃত করলেন তাকে, ঠিক যেমন ভাবে
পুরস্কৃত করা হয় কোনো সৎ-বিশ্বাসী মানুষকে
যেমনটা লেখা আছে সকল আসমানি কেতাবে;
তারপর ঘুমিয়ে পড়ল সেই কবি নবী ইব্‌রাহীমের কোলে
ভোরের একটু আগে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার
ঘুম থেকে উঠেই শুরু করে দিল চিৎকার
অভিযোগ করতে লাগল ঈশ্বরের নিকট নানা বিষয়ে
সঙ্গে জুড়ে দিল কান্নাকাটি, আর তার কান্নায়
ভারি হয়ে গেল স্বর্গের আকাশ
মাতমের বিষাদে আচ্ছন্ন হল সব কিছু
সঙ্গে সঙ্গে তাকে অভয় দিলেন ঈশ্বর
স্নেহের পরশ ও অফুরন্ত ভালোবাসায়
ভরিয়ে দিলেন তার মন, আনন্দ দিলেন তাকে
কোলে তুলে নিলেন যেভাবে মা নেয় নিজ সন্তানকে
তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন তার কপালে;
নবী দাউদের কণ্ঠ ছিল সুমধুর, তিনি ছিলেন আজ্ঞাবহ
তাই তাঁকে ডেকে গান গাইতে বললেন কবির জন্য
তাঁর গান শুনে পিতৃকোলেই ঘুমিয়ে পড়ল কবি;
অল্প কিছুক্ষণ পর যখন ঘুম ভাঙল তার
আবারও শুরু করল কান্নাকাটি
তা দেখে রেগে গেলেন স্বর্গবাসীরা
রেগে গেলেন ঈশ্বরও, বিরক্তির স্বরে বললেন—
আর কতদিন সহ্য করব আমি অমন অবাধ্যকে
যে ‘কাওসার’ পান করে বলে ‘গরল পান করছি’
যে পৃথিবীর বুকে অভিযোগ করত অন্যায়ের
কোনো রকমের অন্যায় ছাড়াই, আর এখন
এখানেও, স্বর্গেও সে অভিযোগ করছে অন্যায়ের;
কবিরা ইদানীং প্রায়শই লঙ্ঘন করছে তাদের সীমানা
তাদের সৃষ্টি যেন অর্থহীন, যেন অবাঞ্ছিত তারা।
অতঃপর কবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ঈশ্বর—
কেন কাঁদছো তুমি, কে আঘাত করেছে তোমায়?
কীসের এত অভিযোগ তোমার?
তুমি কি আমার ক্ষমার কথা ভেবে কাঁদছো?
নাকি, তোমাকে যে উত্তম প্রতিদান দিয়েছি তার জন্য?
এ কথা শুনে চিৎকার করে উঠল কবি, বলল—
প্রভু ক্ষমা করো আমায়, তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার
তুমি ক্ষমা না করলে কে ক্ষমা করবে আর!
তাই তোমার নিকট আমার একটাই অনুরোধ
প্রভু, তুমি পাঠিয়ে দাও আমায় সেই কোলে
যে-কোল আমার কাছে অধিক প্রিয়
যে-কোল এই স্বর্গের চেয়েও বেশী দামী
যে কোলে দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থেকেছি আমি
ঘুমিয়ে থেকেছি সুখে শান্তিতে
স্নেহ-ভালোবাসার আঁচলে মুড়ে।
প্রভু, তুমি কি কখনো মাথা রাখোনি অমন বুকে
যে বুক উপচে পড়ে মাতৃস্নেহে?!
প্রভু, আমি থাকতে চাই না এই স্বর্গে
আমায় মুক্তি দাও তুমি এই স্বর্গ থেকে
মুক্তি দাও এর সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি থেকে
আমি ফিরে যেতে চাই ওই কোলে
সেখানেই আমার প্রকৃত সুখ
সেই কোলেই বড় হয়ে উঠেছি আমি
স্নেহের পরশ মেখে, সেই কোলেই
ঘুমিয়ে পড়েছি বারবার তাঁর কণ্ঠে এই গান শুনে—
“ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো
খাট নেই পালং নেই আসন পেতে বসো।”

প্রভু শুনলেন তার কথা নীরবে, মগ্ন হয়ে
ওই মাটির কবির সব কথা, তারপর ভাবতে লাগলেন—
এটা কী করে সম্ভব, কী করে এমনটা হতে পারে
আমি যা জানি না একজন কবি কী করে তা জানতে পারে
কোনো পাপী কী করে ভূলোকে অমন সুখ পেতে পারে
যে সুখ কোথাও নেই, না আছে পৃথিবীতে
না আছে আমার এই সুবিশাল স্বর্গে?!
একদিন আমি নিজেই উন্মোচন করবো এর রহস্য
তার জন্য যদি প্রাণ দিতে হয় আমাকে, দেবো!

রাতের অবসানে, পূব আকাশে সবে
ছড়িয়ে পড়েছে ঊষার আভা
আকাশের কোলে হাসছে সুব্‌হ সাদেক
এমন সময়, মরিয়মের কোল আলো করে
দিগন্তে আলো ছড়িয়ে
জন্ম নিল এক শিশু
জন্ম নিলেন যীশু!


রাশীদ সালীম আল্‌-খ়ূরী (১৮৮৭ – ১৯৮৪)। একজন আরব খ্রিস্টান ও বিখ্যাত প্রবাসী কবি। “আশ্‌-শা’য়েরুল্‌ ক়ারাবী” (পল্লীকবি) নামে খ্যাত। জন্ম লেবাননের বার্‌বারায়। দীর্ঘ ৪৫ বছর ব্রাজিলে বসবাস করেছেন। বিখ্যাত “আর্‌-রাবেত়া” সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন তিন বছর। ১৯৫৮ সালে অন্যতম সাহিত্য সংগঠন “আল্‌-‘উস়্‌বাতুল্‌ আন্দালুসিয়্যা”-র  সভাপতি নির্বাচিত হন। মা’কে নিয়ে লেখা বিশ্বব্যাপী শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির একটি হল তাঁর এই “হিদ়্‌নুল্‌ উম্মি” কবিতাটি। ১৯২৫ সালে কবিতাটি রচনা করার পর বিশ্বের সকল মা’দেরকে উৎসর্গ করে নিজ মা’কে বলেছিলেন, ইব্‌তাহিজি ইয়া উম্মাহ্‌, লাক়াদ কাতাব্‌তু কাস়ীদাতান্‌ খ়ালেদাতান্‌ আহ্‌দাইতুহা ইলাইকি, ওয়া লাম্‌ ইয়াক্‌তুব্‌ নাযীরাহা শা’য়েরুন্‌ ফিল্‌ ‘আলামি” (মা তুমি জেনে খুশী হবে যে, আমি এক খানা অমর কবিতা রচনা করেছি। আমি সেই কবিতাটি তোমাকে উৎসর্গ করছি। আমার ধারণা, পৃথিবীর আর কোনো কবি অমন ধরণের বা অমন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কবিতা লেখেননি)।

তাঁর এই রচনা সত্যিই বিরল। মা ও মাতৃত্বকে ব্যখ্যা করতে তিনি তাঁর খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ট্রিনিটি বা ত্রিতত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এক অকল্পনীয় উপমার মাধ্যমে মা ও মাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি এই কবিতায় বলেছেন, বহু কাল আগে প্রাচ্যে এক কবির মৃত্যু হয়। পিতামাতার সেবা করার সুবাদে স্বর্গে ঠাই হয় তাঁর। কিন্তু স্বর্গসুখে তাঁর মন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তিনি পৃথিবীতে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তাঁর এই বাসনা কেন, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। কবি উত্তরে বলেন, পৃথিবীতে ফিরে গেলে আমি আমার মা’কে পাবো, তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার পরশ পাবো। তাঁর উত্তর শুনে অবাক হলেন ঈশ্বর। অতঃপর মা, মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসা, তাঁর আদর-যত্ন উপলব্ধি করতে যীশু রূপে জন্ম নিলেন মা মরিয়মের কোলে।

অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম



حضن الأم
رشيد سليم الخوري
أتذكر كيف كان إله موسى                      الها قاسيا يلتذ بالدم؟
إذا فإليك كيف غدا مسيحا                       حنونا ان تألمنا تألم
** ** **
روى الراوون أن عثروا بمصر            على درج غريب الخط مبهم
فحاول فهمه العلماء لكن                    بدا لجماعة العلماء طلسم
إلى أن حله الشعراء شعرا                 ومن بالشعر كالشعراء يفهم
وذلك أنه من قبل عيسى                توفي شاعر في الشرق ملهم
أضاع العمر في طلب المعاصي             يحلل ما كتاب الله حرم
فكاد الى اللظى يلقى،جزاء                 لما من سئ الأعمال قدم
ولكن بره الابوين غطى                   مساوئه فخلص من جهنم
وجازاه الاله جزاء عبد                    تقي حسبما في الكتب علم
فنام بحضن ابراهيم لكن                    قبيل الفجر شاعرنا تبرم
وقام لربه يشكو ويبكي                    بكاء صير الفردوس مأتم
فهدأ روعه وحنا عليه                     وطيب قلبه بحنانه الجم
ووسده يديه وركبتيه                     ومال عليه بالتقبيل والضم
وقال لعبده داود رنم                        لهذا البلبل الباكي فرنم
فنام بحضنه الأبوي حينا                وعاد يساقط العبرات عندم
الى ان ضج اهل الخلدغيظا         وصاح الله من غضب الى كم
أطيق تذمرا من عبد سوء                   يجرع كوثرا فيقول علقم
تظلم في الثرى من غير ظلم           وحتى في النعيم معي تظلم
أرى الشعراء جازوا الحد إني              أكاد لخلقي الشعراء أندم
علام بكاك ياهذا وماذا                  دهاك فلا تني تشكو تكلم
أصفحي عنك قد أبكاك أم ما       جزيت به من الأحسان أم.. أم
فصاح:العفو يا مولاي من لي       سواك ومن سوى الرحمن يرحم
أتيتك راجيا نقلي لحضن                   أحب الي من هذا واكرم
لحضن طالما قد نمت فيه              قرير العين بين الضم والشم
أما القيت رأسك فوق صدر                حنون خافق بمحبة الأم؟
فدعني من نعيم الخلد أني            نعيمي بين ذاك الصدر والفم
تربتني كعادتها برفق                     وتنشد نم حبيبي بالهنا نم
** ** **
فأصغى سيد الأكوان لطفا               لشكوى شاعر الغبراء واهتم
وقال لنفسه هذا محال                    أيعلم شاعر ما لست أعلم
أينعم خاطئ في الأرض قبلي        بما انا لست في الفردوس أنعم
لأكتشفن هذا السر يوما                  ولو كلفت ان أشقى وأعدم
** ** **
وكانت ليلة وإذا صبي                  صغير نائم في حضن مريم


No comments:

Post a Comment