ফাদার্স ডে-তে
আমি
বদিউর রহমান
ফেসবুক থেকে জানতে পারি গতকাল (২১-০৬-২০২০) ছিল ‘ফাদার্স ডে’। স্বভাবতই বিশ্ব জুড়ে নিজেদের পিতাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে পোষ্ট করেছেন অনেকে। যাদের পিতারা সৌভাগ্যবশত এখনো বর্তমান তাঁরা স্বভাবতই আপ্লুত। অন্যদিকে পিতৃহারা সন্তানদের পোষ্টগুলোয় কারো কারো বাবা হারানোর হাহাকার শুনতে পেয়েছি। বাবার অবর্তমানে সন্তানদের জীবন কী রকম মরুভূমি হয়ে উঠে জেনে সমবেদনা জানিয়েছি। এক একজনের পোষ্টে তাঁদের ছোটোবেলায় বাবার আঙুল ধরে হেঁটে-চলা থেকে শুরু করে তাদেরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তবে বাবারা অফিসে গিয়েছেন। অনেকের পোষ্ট থেকে পরিস্কার দেখেছি কী ছন্দময় জীবন ছিল তাদের বাবার তত্ববধানের দিনগুলিতে। অসুখে-বিসুখে আপদে-বিপদে ছোটদের একমাত্র ভরসার মানুষ ছিলেন বাবা। সেই বাবাদের অবর্তমানে সন্তানদের জীবনটা ক্রমে কেমন পাল্টে যায় – সে চিত্রগুলোও অনেক পোষ্ট-এ বেশ ফুটে উঠেছে। জানি না কবে থকে এই ফাদার্স ডে এতো সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়ে চলেছে। মাঝে মধ্যেই এ জাতীয় বিশেষ বিশেষ ‘ডে’ পালন করা এক রকম রীতি হয়ে গেছে ইদানীং। ক’দিন পূর্বে ছিল ‘মাদার্স ডে’। আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ তো এক বিশেষ মাত্রা পেয়ে গেছে। সে দিন তো একটা গোলাপের দাম একশো টাকার বেশি হয়ে যায়। শুধু তাই নয় মটরবাইক এবং গাড়িতে যুগলে লং ড্রাইভে বের হয়ে পড়েন। ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে ভাল হোটেল-রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ-ডিনার করে যে যার বাড়ি ফেরেন। শেষোক্ত দিনটার বিরোধিতায় আবার বেশ কিছু মানুষ সোচ্চার হয়ে পশ্চিমী কায়দায় পার্কে-ময়দানে লোক চক্ষুর লজ্জা উপেক্ষা করে প্রেম নিবেদন করার জোরদার বিরোধিতা করেন। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বলে কিছু ছিল না। সে রকম কিছু থাকলে আমি নিজে কী করতাম আজ হয়তো সত্যি করে বলা দুস্কর। হয়ত আমি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে এ প্রজন্মের যুগলদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ত বা সমালোচকও। কিন্তু উক্ত দিনগুলো ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন আমাদের সময়ে ছিল। আর যে গুলো এখনোও আছে। তার মধ্যে ‘চিলড্রেন্স ডে’ এবং ‘টিচার্স ডে’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সে গুলোর তাৎপর্য এবং ঐতিহাসিক পটভূমিও আছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলি হল ‘স্বাধিনতা দিবস আর ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’। এমনকি গান্ধি জয়ন্তি, নেতাজী সুভাষ-এর জন্মতিথি, রবীন্দ্র জয়ন্তি, গুরুনানক জয়ন্তী, ডঃ আম্বেদকারের জন্মদিবস। সর্বোপরি সারা বিশ্বে পালিত মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) –এর জন্ম দিবস।
ইদানিং কালে মুঠোফোনের দৌলতে আম জনতার এবং বন্ধুদের জন্মদিন জানতে পেরে সৌজন্য রক্ষা করে ‘উইশ’ করি। জন্মের ৬০-৬৫ বৎসর পর আমার কপালেও জোটে শুভেচ্ছা। ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতে হয়। আমাদের বাড়ির ঘরোয়া পরিবেশে কারুরই জন্মদিন পালন করা হোত না। আমার মেয়ের জন্মদিনটা ওঁর খালারা কলকাতার বাড়িতে বরাবর করতো। ওই ব্যাপারে সব থেকে বড় উদ্যোগী ছিল তার সর্বকনিষ্ঠ খালা মলি। আমি শিকন্ডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম – তার বিরোধিতা করে কোন লাভ হয়নি। পরে আমার মেয়ে যখন মর্ডান হাই স্কুল ফর গার্লস-এ ভর্তি হয় তখন তাদের হিবিস্কাস্ সেকশনের ৪০-৪৫ জনের মধ্যে কারও না কারও জন্মদিন লেগে থাকত। আমার মেয়ের সেগুলোতে উপস্থিত হতে সাহায্য করত সেই ছোট খালা। এভাবে জন্মদিন পালন করাটা একটা অধিকার বলে তার মনে অঙ্কুরিত হয়ে বিশ্বাসে পরিণত হয়। তার নিজের জন্মদিনে নিজেদের ক্লাসের হিবিসকাস সেকশনের বন্ধুদের পালটা নেমতন্ন করতে হয়। সব ঝক্কি পোয়াত সেই ছোট খালা। তারই মধ্যে একটু বড় করে তার জন্মদিন পালন করতে বাধ্য হয়েছিলাম জীবনে একবারই। সল্টলেকের বাড়িতে সদ্য এসেছি। ছোট শ্যালক শাহনাওয়ায সাহেব হঠাৎ প্রস্তাব দেন তাঁর ছোট ছেলে আর আমার মেয়ের জন্মদিনটা সল্টলেকের বাড়িতে করবেন। কেক থেকে শুরু করে বিরিয়ানি ইত্যাদি সমস্ত খরচ তাঁর। মুখের উপর না বলতে পারিনি। আমার মেয়ে সালমা তখন ক্লাস টু-এর ছাত্রী। সেবার তাঁর বেশ কিছু ক্লাসমেট, আমার শশুর বাড়ির সকলে এবং আমাদের আবাসনের সব কটা ফ্ল্যাটের সকলে আমাদের ফ্ল্যাটে খাওয়া-দাওয়া করেন। নেপথ্যে ছিলেন শাহনাওয়ায সাহেব – আমি ছিলাম শিখন্ডি। জন্মদিন পালনে আমার বিরূপ মনোভাবের জন্য আমার মেয়ে আমার উপর আজীবন ক্ষুন্ন ছিল। আজও কেন জানি না জন্মদিন পালন করাটা আমার অপছন্দের। তা আমার পছন্দ অপছন্দে তো পৃথিবীটা চলবে না। তাই আমাদেরই আবাসনে পুরো বাড়িটা বৈদ্যুতিক আলোয় সু-সজ্জিত করে দু’দিকের গ্যারেজে বসা এবং খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন করে দীর্ঘ পনের-শোল বৎসর ধরে তোড়ার জন্মদিন পালন করেছেন তার বাবা অধ্যাপক কিশোর রাঢ়হি। অবশ্য তিনি প্রতি সপ্তাহে তাঁর কন্যার জন্মবারটাকে পালন করে চলেছেন আজও।
আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার মেয়ের জন্মদিন নমঃ নমঃ করে করতে দিতে বাধ্য হয়েছি। তাতে সে চিরকাল ক্ষুন্ন হয়েছে। বাবা হিসাবে আমার উপর বিরূপ ধারণা পোষণ করেছে। তার ২০০৯-এ এ পৃথিবী ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরে তার জন্ম দিন পালনের প্রশ্নই ওঠেনি। এখন তার মৃত্যু দিন পালনের সময়টা আসে ঘুরে ফিরে। সে-রকম দিনে বিশেষ করে স্মরণ করি বছরে তিন দিন। মারা গিয়েছিল ১৯ রমজান আর ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৯ই সেপ্টেম্বর। তাই ওই দুটো আলাদা দিনে সে বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। আর অদ্ভূত বৈপরীত্য সত্ত্ব্যেও তার জন্মদিনেও তাঁকে হারানোর ব্যাথা ডুকরে উঠে তার মৃত্যুকেই স্মরণ করিয়ে হাহাকার করে বলে ‘নাই নাই সে পথিক নাই’। শুধু ওই তিন দিনই তাঁকে স্মরণ করি তা নয় তাঁকে স্মরণ করে চলেছি প্রতিটা মুহূর্তে প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে। তার জন্য দোওয়া করে চলেছি প্রতিদিন নামাজের মোনাজাতে, ইফতারের দোওয়ায়। সকলের ‘ফাদার্স ডে’-তে আমার দূর্বল চিত্ত চুপিসারে বলে তোমার সালমা থাকলে তোমাকেও ‘উইশ’ করত নিশ্চয়। নিজেকে বড় অসহায় লাগে। বাকরূদ্ধ হয়ে সকলের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অকারণে ঝাপসা হয়ে যায় দৃষ্টি। চিকচিক করে চোখের দুটি কোণ।
ফেসবুকে যারা ‘ফাদার্স ডে’-এর মেসেজ পোস্ট করেন সেগুলো সকল বন্ধুদের জন্যই তাঁরা করেন। কিন্তু অকারণে অতি আপ্লুত মুষ্টিমেয় কিছু সহৃদয় বন্ধু আমাকে সেরকম বার্তাগুলো মেসেঞ্জার – ওয়াট্সআপে পাঠিয়ে আমাকে ব্যাথাতুর কেন করেন আমার বোধগম্য হয় না। হয়ত বাচ্চাছেলের দলের পুকুরের ব্যাঙদের ইট দিয়ে মেরে ফেলার মতো আনন্দ উপভোগ করতে চান ব’লে। অবশ্য আমার ধারণাটা একেবারেই অমূলক হলেই শ্রেয়। তবে মানতেই হবে অনেকের রসবোধ আছে। আর আমার তো ফাদার হয়েও ফাদার হওয়া হল না। ফাদার্স ডে-তে বার্তা আশা করবো কোন্ অধিকারে! এখন তো ফাদার্স ডে-টা আমার মুখের উপর একটা চপেটাঘাত ব্যতীত আর কিছু নয়।
২২-০৬-২০২০
সল্টলেক, কোলকাতা
No comments:
Post a Comment