Wednesday 15 July 2020

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ তোরা ম্লেচ্ছ...!



তোরা ম্লেচ্ছ...!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

টু-ন্যাশন থিয়োরির কাছে হেরে গেলো কিছু বাঙালীর নিঃস্বার্থ আন্দোলন। ফলস্বরূপ ‘অখণ্ড বাংলা’র স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যার পরনায় দ্বিখণ্ডিত হল “আমার সোনার বাংলা”এবং সেই প্রেক্ষিতেই, লর্ড কার্জনের কলমের আঘাতে দু’ টুকরো হয়ে গেলো দিনাজপুরভারতে যুক্ত হল পশ্চিম দিনাজপুর (পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে পশ্চিম দিনাজপুরও ভেঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ দু’টো জেলায় পরিণত হয়েছে)আর মূল দিনাজপুর শহর থেকে গেলো পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশে। স্বভাবতই আমাদের ভাগ্যে জুটল শুধু নামটুকু। চলতি কথা অনুযায়ী রাজপাটের সবকিছুই থেকে গেছে ওপার বাংলায়। এপারে শুধু আদালতের কিছু ভাঙাচোরা নিদর্শন, যা সময়ের প্রবাহে বিলীন হয়ে গেছে, রয়ে গেছে শুধু নামটা— ফাঁসিদহ।

দিনারাজ রাজার দৌলতে আমাদের এই এলাকায় যে অতীতে কোনো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার কিছু প্রমাণও মেলে। কখনো পুকুর খনন করতে গিয়ে পাওয়া যায় বেশ কিম্‌তি মূর্তি, তো কখনো পুরনো যুগের মুদ্রা। কোথাও আবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের চওড়া ও চৌকো ইটপাথর। এছাড়া এখনো লোকমুখে ছড়িয়ে আছে অনেক গল্পপুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে একাধিক পুকুরপুষ্করিণী। হয়তো এই প্রান্তিক এলাকায় আজকের মতো সে-যুগেও কৃষিই মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল

আমাদের এই এলাকায় যেহেতু কৃষিই মানুষের প্রধান জীবিকা। তাই অগ্রহায়ণের হালকা শীতের আমেজ সাথে নিয়ে আসে চওড়া হাসি চাষির মুখে। ঘরে আসে নতুন ধান। এবং এই নতুন ধান উপলক্ষে একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটা রান্না ঘরে। কার্তিকের খনখন করা হাঁড়িপাতিলগুলো অগ্রহায়ণের সন্ধ্যায় সেজে ওঠে হেঁশেলের মেঝেতে। আস্তে আস্তে সেই আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জের আকাশে বাতাসে। কলকল রব তোলে নবান্ন। এলাকার হিন্দু-মুসলিম সবার বাড়িতে সেই উৎসব। তবে রূপে গন্ধে একটু ভিন্ন। সামর্থ্য ও শরিয়ৎ অনুযায়ী আয়োজন করে প্রত্যেকে। মজার ব্যাপার হল হিন্দু-মুসলিম পরস্পরকে নেমন্তন্ন করে এবং অতিথির রুচি অনুযায়ী মেনু তৈরি হয়। যদিও ইদানীং তা প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ঘটনাটা আমার কৈশোর বেলার। স্কুল কেটে আমবাগানে আম কুড়োনো বা নদীতে মাছ ধরার সেই চঞ্চল বয়সের। কোনো এক অগ্রহায়ণে নবান্ন উপলক্ষে একদিন আমাদেরকে এক বন্ধু নেমন্তন্ন করল। আর তাই সময়মতো আমরা ক’জন বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যা গড়িয়ে তখনো অন্ধকার ঘন হয়নি, গিয়ে হাজির হলাম তার বাড়িতে। বাড়ির ভেতরে উঠনে মাদুর পেতে সে আমাদেরকে বসতে দিল। কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর আমাদেরকে খেতে দেওয়া হল। কলাপাতায় করে খই-মুড়ি এবং ক্ষীর। তারপর মাছ ভাত। আমরা যেহেতু মুসলমান, কাটা-মাংস খাই না, তাই আমাদের জন্য বিশেষ ভাবে মাছের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর কলাপাতায় দেওয়া হয়েছিল কারণ তখন আমাদের দিকে কলা পাতা ও শালপাতায় অতিথিদের খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। খেয়েদেয়ে গল্পগুজব সেরে আমরা যখন বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখনই তার পিতামহী এক ঘটি জল সাথে গোবর ও মাটি নিয়ে সেখানে হাজির। আমাদের বসার জায়গাটা তিনি সেসব দিয়ে লেপে দিলেন।

দাদির (ঠাকুমার) ওই আচরণ সেদিন আমাদের চোখে কেমন খটকেছিল। কিন্তু, ওর খারাপ লাগবে ভেবে আমরা জিজ্ঞেস করিনি, না সেদিন আর না তারপরে অন্য কোনোদিন। আমাদের দেখা হতো, গল্পও হতো, তবে তার মধ্যে একটা আড়ষ্টতা লক্ষ্য করতাম। কয়েক সপ্তাহ বাদে, একদিন টিফিনের সময় সে নিজেই আমাদেরকে ডাকল। চোখ নীচু করে সব আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলতে লাগলো— তোরা চলে আসার পর সে-দিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি ওদের বাড়ি যাই, ওর মা আমাদের দু’জনকে বিছানায় বসিয়ে আম-কলা কত কী খাওয়ায়, কোনো কোনো দিন ভাতও খাওয়ায়, কই ওর মা’ তো বিছানার চাদর চ্যাঞ্জ করে না, আর না মেঝেটা জল দিয়ে ধোয়, তাহলে তুমি সেদিন কেন অমন করলে, কেনই বা তুমি ওদের সাথে মিশতে বারণ করো, ওদের ঘটিতে জল খেতে নিষেধ করো, ওদের বাড়ি যেতে দিতে চাও না, কেন?

লক্ষ্য করলাম ওর চোখের কোণ চিকচিক করছে। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিজেকে একটু সহজ করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। এরই মাঝে আমি বলে উঠলাম— ছাড় না, ঠাকুমা বয়স্ক মানুষ!

সদা হাসিখুশি ছেলেটা সেদিন কেমন সিরিয়াস হয়ে গেছিল, খোপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল— ভাই, কিছু মনে করিস না, প্লীজ!...  

আমার মনে হল কিছু একটা সে বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। হয়তো ঠাকুমা তাকে এমন কিছু বলেছে যা আমাদের সামনে বলতে সে কুণ্ঠা বোধ করছে। তাই আমি জোর করলাম— ঠাকুমা আবারও আমাদের সাথে মিশতে বারণ করেছে, তাই তো? আরও কিছু বলেছে? কী বলেছে, বল!
আমার জোরাজুরিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কান্না চেপে কোনোরকমে বলল— ঠাকুমা বলেছে, তোরা নাকি ম্লেচ্ছ...    

“ম্লেচ্ছ” শব্দটা তার মুখ থেকে বেরিয়ে শ্রবণ পথ ধরে সোজা আমার মনের তারগুলোতে গিয়ে ধাক্কা মারল। বিড়বিড় করে আরও কিছু বলছিল সে, তা কানে ঢুকল না। আপনা থেকেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলোমাথাটাও কেমন নুইয়ে পড়ল। এক অদ্ভুত নীরবতা চেপে ধরল আমাদের সবাইকে। মিনিট পাঁচেক হবে, তার পর আস্তে আস্তে মাথা তুললাম। দেখলাম, আমার সহপাঠী ক্লান্ত পায়ে ক্লাস রুমের দিকে হেঁটে চলেছে। এবং হাঁটতে হাঁটতে জামার কাফ দিয়ে অশ্রুর ফল্গুধারায় বাঁধ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

বাঁশকুড়ি, দঃ দিনাজপুর
০৭ মে ২০২০

No comments:

Post a Comment