Wednesday 29 December 2021

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ বৃষ্টি, স্মৃতি এবং আমি


 
বৃষ্টি, স্মৃতি এবং আমি 
 
আমি তখন প্রাইমারীতে পড়ি আমাদের পুরনো বাড়িটা বেশ বড়ই ছিল তবে তিন-তিনটে পরিবার থাকার উপযুক্ত নয় তাই বাড়ি ভাগ হল উত্তর দিকের ঘরদোর আঙিনা বড় আব্বারা নিলেন আর দক্ষিণ দিকের বাকি অংশটা মেজো আব্বারা নিলেন আমরা চলে এলাম পূব দিকে যেটা মূলত বৈঠকখানা গোয়ালঘর ছিল সেখানে ছিল তিনটে খড়ের ছাউনি ওয়ালা মাটির ঘর সামনের দিকে একটা চালা টাঙ্গিয়ে আমরা থাকতে আরম্ভ করলাম একটা ঘরে আমি মা থাকি বাবা বারান্দায় আর দুই দাদা থাকে অন্য ঘরটায় আরেকটা যে ঘর ছিল পেছনের দিকে, সেটায় থাকতো আমাদের হালের গরু, গাভী ছাগলগুলো তার পেছনের চালায় মা রান্নাবান্না করতেন প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের সামনের চালায় আড্ডা বসতো বাবা-মা আমাকে গল্প শোনাতেন দুই দাদা নিজের কাজকর্ম পড়াশোনার ফাঁকে আমাকে পড়াতেন পাড়াপড়শিরা আসতো আব্বার কাছে পরামর্শ নিতে, আর বিকেল বেলা পার্শ্ববর্তী বাড়িগুলোর কাকিমা ভাবিরা মায়ের সাথে গল্প করতে বাড়িতে ওভাবেই বহু বছর থেকেছি আমরা
 
সামনের চালাটায় ছিল টিনের ছাউনি, আর বাকি ঘর চালাগুলো ছিল খড়ের খড়ের ছাউনিতে গরমের দিনে ভীষণ আরাম ঘরদোর বেশ ঠাণ্ডা থাকে তবে বর্ষাকালে বেশ ভোগায় তার উপর বছর বছর খড় পালটানোর ঝামেলা, বাড়তি খরচ একটু হাওয়া দিলে চালা নড়বড় করে দেয়াল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ভারি বর্ষা হলে চালার মাঝখান দিয়েও টিপ টিপ করে জল পড়ে আমি খুব ছোট তখন, তবুও স্পষ্ট মনে আছে আমার মাঝ রাতে বৃষ্টি নেমেছে আকাশ চিৎকার করছে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে বাবা আমাকে ডাকছেনবাবু ওঠ্‌, বিছানাটা গুটিয়ে নে দেখ্ওখানে জল পড়ছে যা বদনাটা নিয়ে আয়, ওই জায়গায় পেতে দে বাবু পূব কোণে দেখ্‌, ওখানে চালটা ফুটো হয়ে গেছে মনে হয় টিপ টিপ করে জল পড়ছে, ওখানে একটা বালতি পেতে দে যা তো তোর বড়দাকে ছাগলগুলো অন্য জায়গায় বাঁধতে বল্ ছাগলগুলো তখন থেকে চিৎকার করছে, ভিজে গেছে মনে হয় আমি ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে দেখি, মা বিছানাপত্র সব গোটাচ্ছে বাবা টর্চ মেরে মেরে দেখছে, কোথায় কোথায় জল পড়ছে দুই দাদা গোয়ালঘরে গরুছাগলগুলো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আর আমি ঘুমঘুম চোখে বাবার নির্দেশ মতো কোথাও বালতি, কোথাও বদনা, কোথাও মগ, কোথাও থালা, কোথাও হাড়ি পেতে জল অভাবের সাথে লড়ছি
 
এভাবে বহু রাত, বহু বছর, বহু বর্ষা কেটেছে আমাদের বাড়িটাও এই বছরে বহু বার তার রূপ পালটেছে খড়ের চালার জায়গায় টিনের ছাউনি হয়েছে মাটির দেয়াল ভেঙ্গে ইটের হয়েছে কিছু অংশে মাথার উপরে কংক্রিটের ছাদ হয়েছে তুলাই নদী দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক বিশে বিষ হয়ে গেছে সময় করোনার কবলে পড়ে থমকে গেছে জীবন লকডাউন নানা অসুবিধার কারণে আমি এখন গ্রামের বাড়িতেই আছি দিনের বেলা অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি কলেজের নানা কাজ করছি আর রাতগুলো মেতে উঠছে ইউরোতে গতকাল খেলাটা সবে শেষ হয়েছে, এক বন্ধু ফোন করলো তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর, একটা আর্টিকেল পড়তে আরম্ভ করলাম চমৎকার লেখা এত ভালো যে, একবার শুরু করলে শেষ না করে থাকা যায় না কখন যে রাত দুটো বেজে গেছে টেরই পাইনি হঠাৎ করে বিদ্যুতের ঝলকানি চোখে পড়লো বাইরে বৃষ্টি নেমেছে ঝমঝম করে, বেশ জোরে চারিদিক নিঝুম ল্যাপটপটা বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম বারান্দায় কার্নিশের পাশে এসে দাঁড়ালাম জলের ঝাপটা গায়ে এসে পড়ল এক পা, দুপা করে মায়ের ঘরের দিকে গেলাম আস্তে করে দরজা খুলে দেখলাম, মা ছোট ভাইঝি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে বড়দা, মেজদা কেউ জেগে নেই সবাই গভীর ঘুমের মধ্যে রয়েছে ফিরে এলাম আমার ঘরের বারান্দায় চারিদিকে শুধুই ঝমঝম-ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ এসে দরজার কাছে কার্নিশটার পাশে দাঁড়ালাম কার্নিশটা দিয়ে তখন গড়িয়ে টপটপ-টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে ঝমঝম শব্দের মধ্যেও ওই টপটপ আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি সেই সাথে অবেচেতন মনে শুনতে পাচ্ছি, কোথা থেকে যেন একটা দরাজ কণ্ঠ ভেসে আসছে, আমার খুব পরিচিত সেই কণ্ঠ, আমাকে বলছেবাবু ওঠ্‌, ওইখানে জল পড়ছে, বালতিটা পেতে দে, ওখানে মগটা, ওই জায়গায় একটা থালা বা অন্য কিছু পেতে দে
 
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম বর্ষার মতো করে চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো, আর সেই সাথে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, চোখ দুটো বন্ধ করে অস্ফুটে বললামবাবা! তুমি কি পারো না, একবার, অন্তত একবার এসে দেখে যেতে, আমার নতুন বাড়িটা কেমন হয়েছে! তোমার ইজি চেয়ারটা বারান্দার কোন্পাশে রাখবো, আমায় তা দেখিয়ে দিতে! পারবে না বাবা, একবার, শুধু একবার…!
 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
দক্ষিণ দিনাজপুর
২০/০৬/২০২১  


1 comment: