Friday 1 April 2022

প্রশাসন নীতি সম্পর্কে উমার (রাঃ)-এর দৃষ্টিকোণ


প্রশাসন নীতি সম্পর্কে উমার (রাঃ)-এর দৃষ্টিকোণ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
উমার (রাঃ) ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে দ্বিতীয় খালীফাখালীফা অর্থ প্রতিনিধি বা অনুগামীতাঁরা ইসলামী আইন শাসন ব্যবস্থাকে অনুকরণ করে সমাজ পরিচালনা করতেন, তাই তাঁদেরকে খালীফা বলা হয়উমার (রাঃ) অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ছিলেননিজ শাসন আমলে তিনি বহু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেনবহু নতুন রীতি কৌশল উদ্ভাবনও করেছিলেনযা পরবর্তীতে মানচিত্র জুড়ে বহু শাসক, রাজনীতিবিদ ঐতিহাসিকদের অনুপ্রাণিত করেছেতাই বিভিন্ন সময়ে মুসলিম অমুসলিম বহু গুণীজনই তাঁর ব্যক্তিত্ব কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁর প্রশাসন নীতি অনুসরণের কথাও বলেছেন। তিনি শাসন ভার গ্রহণের পর জনগণকে সম্বোধন করে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন, সর্বসাধারণের সামনে তাঁর নীতি পদ্ধতির কথা তুলে ধরেছিলেনসবই হাদিস ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণীত হয়েছেএধরণেরই একটি বক্তব্য থেকে আমরা তাঁর প্রশাসন নীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাই তাঁর সেই বক্তব্যটি তাল্হা বিন্মাদান আল্‌-‘উমারী হতে বর্ণীত
 
তাল্হা বলেছেনউমার (রাঃ) আমাদের সামনে বক্তব্য দিলেনপ্রথমে তিনি মহান আল্লাহ্ প্রশংসা করলেন, তাঁর মহিমা ঘোষণা করলেনঅতঃপর নবী (সাঃ)-এর প্রতি শান্তির ধারা বর্ষণের প্রার্থনা করলেনতারপর খলীফা আবু বাক্ (রাঃ)-এর উল্লেখ করে তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেনঅতঃপর (জনগণকে সম্বোধন করে) বললেন
 
হে লোকেরা (জেনে রাখো), কোনো ব্যক্তিই তার অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এমন স্তরে পৌঁছায়নি যে আল্লাহ্ অবাধ্য হয়ে তার অধিকার আদায় করতে হবে (অর্থাৎ কারও অধিকার আদায় করতে গিয়ে আল্লাহ্ অবাধ্য হওয়া যাবে না)আর আমি মনে করি, জাতীয় কোষাগারের এই অর্থ-সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার কেবল তিনটি পদ্ধতিতে সম্ভব— () সঠিক পথে তা আদায় করা, () উপযুক্ত খাদে তা ব্যয় করা () এবং যাবতীয় অসৎ উপায় ও খাদ হতে তা রক্ষা করাআর (মনে রেখো,) আমি এবং তোমাদের এই সম্পদ ঠিক অনাথ তার অভিভাবকের মতো, প্রয়োজন না হলে আমি তার এক পয়সাও নেবো না, তবে যদি প্রয়োজন পড়ে (অর্থাৎ আমি কখনও অভাবগ্রস্থ হয়ে পড়ি) তাহলে কেবল প্রয়োজন মাফিকই নেবো (না বেশি, না কম)
 
আর হ্যাঁ, আমি (কখনও) কোনো অত্যাচারী নিপীড়ককে ছেড়ে দেবো না; তার একটা গাল মাটিতে ফেলে অপর গালের উপর আমার পা রাখবো (অর্থাৎ তাকে উচিৎ শাস্তি দেবো) যতক্ষণ না সে অনুতপ্ত হয়ে অত্যাচার নিপীড়নের পথ ত্যাগ করে এবং হক ন্যায়ের পথে ফিরে আসে
 
তোমরা জেনে রাখো, আমার উপর তোমাদের অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো আমি উল্লেখ করছি, সেই সব দায়িত্ব সম্বন্ধে তোমরাও সচেতন থেকো এবং আমার কাছে তার হিসেব নিও; সেগুলি হল— () তোমাদের যে ট্যাক্স এবং মহান আল্লাহ্যা কিছু তোমাদেরকে প্রদান করেছেন তার কর যথাযথ পরিমাণে গ্রহণ করা, () সেই আদায়কৃত কর উপযুক্ত খাদে এবং প্রাপ্য ব্যক্তিদের মাঝে ব্যয় করা () তোমাদের জন্য জীবিকা জীবিকার্জনের মাধ্যম স্থির বৃদ্ধি করাইন্শা আল্লাহ্‌ – এবং তোমাদের অভাব মোচন করা নিরাপত্তা প্রদান করা () বিপর্যয়ের মুকাবেলা করা, অনিবার্য ধ্বংসকে প্রতিহত করে তোমাদের সুরক্ষা প্রদান করা এবং রাষ্ট্রের সীমানাগুলো রক্ষা করা
 
শোনো, অদূর ভবিষ্যতে (এবং তা তোমাদের একেবারেই নিকটে চলে এসেছে) বিশ্বস্ত লোকেদের সংখ্যা কমে যাবে, পাঠক সংখ্যা বাড়লেও বোদ্ধাদের সংখ্যা হ্রাস পাবে (অর্থাৎ মানুষজন প্রচুর পড়াশোনা করবে তবে তার মর্ম আত্মস্থ করবে না) এবং (তোমাদের) আশাআকাঙ্ক্ষাও হবে আকাশছোঁয়া তখন লোকজন পরকালের জন্য কাজ করবে (অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশীলন অনুশাসন মেনে ইবাদত-উপাসনা করবে) তবে সে-সব কাজের দ্বারা তারা পার্থিব লাভ মুনাফা খুঁজে বেড়াবে, আর তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য তাদের যাবতীয় ধর্মীয় অনুশীলনকে ধ্বংস করে দেবে যেভাবে আগুন কাঠকে ধ্বংস করে দেয় শোনো, তোমাদের মধ্যে যারা সেই সময়ে জীবিত থাকবে, তারা যেন তাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর বিধিবিধান মেনে চলে এবং (যাবতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে) ধৈর্য ধারণ করে
 
তোমরা (ভালোভাবে) জেনে রাখো যে, মহান আল্লাহ্ অধিকার (তোমাদের) সবার অধিকারের উর্ধে; আর তাঁর সেই সুমহান অধিকার সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন— “তিনি (অর্থাৎ মহান আল্লাহ্‌) তোমাদেরকে এই আদেশ কখনই দেননি যে, তোমরা ফেরেশতাদের (অর্থাৎ আল্লাহ্ দূতদের) এবং তাঁর বার্তাবাহক নবী রাসূলদেরকে প্রভু প্রতিপালক রূপে গ্রহণ বিশ্বাস করো; তিনি কি তোমাদের ইসলাম গ্রহণের পর (অর্থাৎ তাঁকে প্রভু উপাস্য রূপে স্বীকার করার পর) তোমাদেরকে আবার কুফ্ (অর্থাৎ তাঁকে অস্বীকার) করার আদেশ করবেন?! [সূরাতু আলে ইম্রান, আয়াত ৮০]
 
শোনো, আমি তোমাদেরকে (যখন কোথাও কোনো দায়িত্ব দিয়ে পাঠাই তখন) শাসক রূপে পাঠাই না, না কোনো প্রতাপশালী ব্যক্তি রূপে পাঠাই; বরং আমি তোমাদেরকে জনসাধারণের জন্য পথ-প্রদর্শক পথ-পরিচায়ক রূপে পাঠাই, যাতে তোমাদের মাধ্যমে তারা সুপথের সন্ধান পায় অতএব তোমরা মুসলিমদেরকে (অর্থাৎ বিশ্বাসী সৎ লোকেদেরকে) তাদের অধিকার প্রদান করো তাদেরকে অযথা কষ্ট দিয়ে তাদেরকে লাঞ্ছিত অপমানিত করো না অতিরিক্ত অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে তাদেরকে বিপদ বিপর্যয়ে ফেলো না তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করো না (অর্থাৎ তাদের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করো না, বরং সময় মতো তাদের খোঁজখবর নিও), নয়তো তাদের মধ্যে যারা শক্তিশালী দুর্বলদের গ্রাস করে নেবে (অন্যায় ভাবে তাদের যাবতীয় অধিকার হরণ করবে এবং তাদেরকে চরম ভাবে শোষণ করবে)  অযথা কাউকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের সকলের প্রতি অবিচার করো না এবং তাদের কারোরই সাথে একগুঁয়ে নির্বোধ আচরণ করো না বরং তাদেরকে সাথে নিয়ে শক্তিশালী অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের সাথে সংগ্রাম করো; তবে যদি অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্বলতা অসহায়তা লক্ষ্য করো তাহলে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে; এটাই হল শত্রু বিরোধী পক্ষের সাথে সংগ্রাম করার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কৌশল
 
শোনো, আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি বিভিন্ন শহর অঞ্চলে শাসক পাঠিয়েছি, যাতে তাঁরা ইসলামের রীতিনীতিগুলো জনসাধারণের নিকট স্পষ্ট করে তুলে ধরেন তাদের মাঝে ন্যায্য ভাবে অর্থের বণ্টন করেন ন্যায় নিষ্ঠার সাথে তাদের মাঝে বিচার মীমাংসা করেন তবে যদি কোনো বিষয়ে মীমাংসা করা তাদের পক্ষে কঠিন দুরূহ হয়, তারা যেন তা আমার নিকট পাঠিয়ে দে [আবু ইউসুফ, কিতাবুল্খারাজ, পৃষ্ঠা ১১৭ - ১১৮]
 
[দৈনিক পূবের কলম, দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্র, ১ এপ্রিল, ২০২২-এ প্রকাশিত]



উমার (রাঃ)-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতাংশের মূল আরবি নিম্নে প্রদত্ত হল— 
 
خطبة عمر رضي الله عنه في الحُكم
 
قَالَ طَلْحَة بْنَ مَعْدَانَ الْعُمَرِيَّ:
خَطَبَنَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ، ثُمَّ صَلَّى عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَذَكَرَ أَبَا بَكْرٍ فَاسْتَغْفَرَ، ثُمَّ قَالَ: أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّهُ لَمْ يَبْلُغْ ذُو حَقٍّ فِي حَقِّهِ أَنْ يُطَاعَ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ، وَإِنِّي لا أَجِدُ هَذَا الْمَالَ يُصْلِحُهُ إِلا خِلالٌ ثَلاثٌ:أَنْ يُؤْخَذَ بِالْحَقِّ، وَيُعْطَى فِي الْحَقِّ، وَيُمْنَعَ مِنَ الْبَاطِلِ. وَإِنَّمَا أَنَا وَمَالُكُمْ كَوَلِيِّ الْيَتِيمِ إِنِ اسْتَغْنَيْتُ اسْتَعْفَفْتُ، وَإِنِ افْتَقَرْتُ أَكَلْتُ بِالْمَعْرُوفِ، وَلَسْتُ أَدَعُ أَحَدًا يَظْلِمَ أَحَدًا وَيَعْتَدِي عَلَيْهِ حَتَّى أَضَعَ خَدَّهُ عَلَى الأَرْضِ، وَأَضَعُ قَدَمِي عَلَى الْخَدِّ الآخَرِ حَتَّى يُذْعِنَ لِلْحَقِّ.
 
وَلَكُمْ عَلَيَّ أَيُّهَا النَّاسُ خِصَالٌ أَذْكُرُهَا لَكُمْ فَخُذُونِي بِهَا: لَكُمْ عَلَيَّ أَنْ لا أَجْتَبِي شَيْئًا مِنْ خَرَاجِكُمْ وَلا مِمَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ إِلا مِنْ وَجْهِهِ، وَلَكُمْ عَلَيَّ إِذَا وَقَعَ فِي يَدِي أَنْ لا يَخْرُجَ مِنِّي إِلا فِي حَقِّهِ، وَلَكُمْ عَلَيَّ أَنْ أَزِيدَ أُعْطِيَاتِكُمْ وَأَرْزَاقَكُمْ إِنْ شَاءَ اللَّهُ وَأَسُدَّ ثُغُورَكُمْ، وَلَكُمْ عَلَيَّ أَنْ لا أُلْقِيكُمْ فِي الْمَهَالِكِ، وَلا أَجَمِّرَكُمْ[1] فِي ثُغُورِكُمْ .
 
وَقَدِ اقْتَرَبَ مِنْكُمْ زَمَانٌ قَلِيلُ الأُمَنَاءِ كَثِيرُ الْقُرَّاءِ، قَلِيلُ الْفُقَهَاءِ، كَثِيرُ الأَمَلِ، يَعْمَلُ فِيهِ أَقْوَامٌ لِلآخِرَةِ يَطْلُبُونَ بِهِ دُنْيَا عَرِيضَةً تَأْكُلُ دِينَ صَاحِبِهَا كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ، أَلا كُلُّ مَنْ أَدْرَكَ ذَلِكَ مِنْكُمْ فَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ وَلْيَصْبِرْ. يَا أَيُّهَا النَّاسُ: إِنَّ اللَّهَ عَظَّمَ حَقَّهُ فَوْقَ حَقِّ خَلْقِهِ، فَقَالَ فِيمَا عَظَّمَ مِنْ حَقِّهِ: وَلا يَأْمُرَكُمْ أَنْ تَتَّخِذُوا الْمَلائِكَةَ وَالنِّبِيِّينَ أَرْبَابًا أَيَأْمُرُكُمْ بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْتُمْ مُسْلِمُونَ [سورة آل عمران آية 80].
 
أَلا وَإِنِّي لَمْ أَبْعَثْكُمْ أُمَرَاءً، وَلا جَبَّارِينَ، وَلَكِنْ بَعَثْتُكُمْ أَئِمَّةَ الْهُدَى يُهْتَدَى بِكُمْ فَأَدِرُّوا عَلَى الْمُسْلِمِينَ حُقُوقَهُمْ، وَلا تَضْرِبُوهُمْ فَتُذِلُّوهُمْ، وَلا تَحْمَدُوهُمْ فَتَفْتِنُوهُمْ، وَلا تُغْلِقُوا الأَبْوَابَ دُونَهُمْ فَيَأْكُلَ قَوِيُّهُمْ ضَعِيفَهُمْ، وَلا تَسْتَأْثِرُوا عَلَيْهِمْ فَتَظْلِمُوهُمْ، وَلا تَجْهَلُوا عَلَيْهِمْ[2]، وَقَاتِلُوا بِهِمُ الْكُفَّارَ طَاقَتَهُمْ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ بِهِمْ كَلالَةً[3] فَكُفُّوا عَنْ ذَلِكَ، فَإِنَّ ذَلِكَ أَبْلَغُ فِي جِهَادِ عَدُوِّكُمْ.

أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي أُشْهِدُكُمْ عَلَى أُمَرَاءِ الأَمْصَارِ أَنِّي لَمْ أَبْعَثْهُمْ إِلا لِيُفَقِّهُوا النَّاسَ فِي دِينِهِمْ، وَيُقَسِّمُوا عَلَيْهِمْ فَيْئَهُمْ، وَيَحْكُمُوا بَيْنَهُمْ، فَإِنْ أَشْكَلَ عَلَيْهِمْ شَيْءٌ رَفَعُوهُ إِلَيَّ.


[1] جمّر الشيءَ: جمّعه. جمّر الأمير الجيش: جمعهم في الثغور وحبسهم عن العود إلى أهليهم.
[2] جهل على أي تسافه
[3] كلالة يعني الضعف والتعب والإعياء

2 comments:

  1. স্যার আপনার লেখনীর প্রাসঙ্গিকতা দেখে মুগ্ধ হই।ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষন করেন ভিন্ন ভাবে।আপনার কলমের শ্রীবৃদ্ধির প্রার্থনা করি আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। দু'আ করবেন আমার জন্য।

      Delete