অভূতপূর্ব এক
অনুভূতি
বদিউর রহমান
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিটায়ার করার পর সময়টা মহাসমুদ্র মনে হতে লাগল। পঠন-পাঠনের
কর্মব্যস্ত জীবনে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটত। হঠাৎ করে সেই জগৎ থেকে
অবসর নিয়ে কীভাবে সময় কাটাব সেই চিন্তায় ছিলাম। কপালগুণে এবং এক বিশিষ্ট অধ্যাপকের
চেষ্টায় আরও পাঁচ বৎসর পড়ানোর সুযোগ পাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন
পরিবেশে নতুন নতুন প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পড়া আর পড়ানো নিয়ে বেশ ছিলাম।
সব তালগোল পাকালো ২০২০-এ করোনা। শুরু হল অনলাইনে পড়ানো। এ যেন দুধের সাধ ঘোলে মেটানো।
তাই’ই সই। কিন্তু অনতিবিলম্বে বইয়ের অক্ষরগুলো একটু একটু আবছা
অচেনা লাগে কেন?
ইদানিং বিশেষত খবরের কাগজের ছোট অক্ষরগুলো বেশ আবছা লাগা
শুরু হল। বুঝলাম বিধি বাম। সামনের বাড়ির চারতলার মাষ্টার মশাইয়ের কথা মনে পড়লো।
আমার বারান্দা থেকে প্রায়ই ওনাকে দেখি তাঁর বারান্দায় হাতের দুটো আঙুল একবার তাঁর
কাছে আনছেন আবার একবার হাতের আঙুল গুলো দূরে রেখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকছেন। আমার
বুঝে নিতে দেরী হয়নি যে উনি নিজের দৃষ্টি শক্তির পরীক্ষা করছেন। কোন কোন দিন তিনি
সেখান থেকে আমাকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে বলেছেন “আপনি তো রহমান সাহেব?
ঠিক দেখেছি তো”? তিনি নিজের থেকেই বলেন ছানি পড়েছে তাই ভিশনটা পরীক্ষা করি। তাঁকে অনেকবার অপারেশন করতে বলেছি। উত্তরে
বলেছেন “আমি নিজে হেমিওপ্যাথির বই পড়ে ওষুধ খাচ্ছি। তাই আমার
বিশ্বাস অপারেশন লাগবে না”। বলেছি যতই ওষুধ
খান ছানির অপারেশন করাতেই হবে। উনিও বলে যান “পাঁচ-ছ’
বছর তো হল। এখনও দেখতে পাচ্ছি”। মনে মনে ভাবি “আপনার যা ইচ্ছা হয় তাই করুন”।
আমার একবার ওনাকে নিয়ে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হয়। একদিন লেডীব্রেবোর্নে এক ফার্সী
অধ্যাপিকার প্রোমোশনের জন্য সি. এ. এস. ছিল। তার জন্য আমাকে নির্দিষ্ট দিনে এবং
নির্দিষ্ট সময়ে ডাকা হয়েছিল। বাড়ি থেকে বের হতে আমার একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল।
ভাবছিলাম দেরী হলে প্রিন্সিপাল (গোপা দত্ত) হয়ত বিরক্ত হবেন। হন্তদন্ত হয়ে মেইন
রাস্তার দিকে ট্যাক্সি ধরার জন্য এগোচ্ছি। পিছনে দেখি ছোট্ট অল্টো গাড়িটায় মাস্টার
মশাই হর্ন দিচ্ছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “রহমান সাহেব কোথায় চললেন”? বললাম “লেডীব্রেবোর্ন কলেজ”। বললেন উঠে আসুন আমি ওদিক দিয়ে গিয়ে আমার পুরানো স্কুল
বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে যাব। ওনার গাড়িতে উঠলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা
লাল সিগ্ন্যাল। মাস্টার মশাই সেটা উপেক্ষা করে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললেন। চমকে উঠে
ওনাকে বললাম “রেড সিগন্যাল রয়েছে” বললেন “ও”। তিনি দাঁড়িয়ে
গেলেন। নিক্কোপার্কের সিগন্যালেও একই কাণ্ড করছিলেন। আমি বলতে তিনি আবার গাড়ি দাঁড়
করিয়ে বললেন “দেখেছেন রহমান সাহেব! আপনি আছেন বলে আমার কত সুবিধা হচ্ছে”! এদিকে আমি খুবই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। ওনাকে বললাম “চোখটা অপারেশন করাচ্ছেন না কেন”? ওনার সেই এক কথা “বই পড়ে নিজে নিজে হেমিওপ্যাথি খাচ্ছি। পরীক্ষা করে দেখিই না”! দুরু দুরু বক্ষে কাঠ হয়ে গাড়িতে বসে রইলাম। পার্কসার্কাস
চার নম্বর ব্রীজে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ভাবি ক্যাটার্যাক্ট অপারেশনে এত ভয়! এবার
মনে হচ্ছে আমার ওই অপারেশনের পালা পড়ল। খবরের কাগজের লেখাগুলো যেন প্রতিদিন ছোট
হয়ে আসছে। সম্পাদকীয় কলমের অক্ষরগুলো অপেক্ষাকৃত একটু বড়। যেগুলো পড়তে অসুবিধা হয় না। কিন্তু বাকী খবরগুলোয় বেশ অসুবিধা হয়। আসলে আমি কাগজের আগা পাস্তালা সবই
পড়ি। পুস্তক পরিচয়,
কলকাতার কড়চা, রবিবাসরীয়র ছোটগল্পগুলো, ধারাবাহিক
উপন্যাস ইত্যাদি সবই পড়ি। বলতে পারেন কাগজের দাম উসুল করে নিই। কিন্তু ইদানিং বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি
না। বাধ্য হয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ভাগ্না ডা. ইমতিয়াজের স্মরণাপন্ন হই। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে হাসতে হাসতে তিনি বললেন “মামা রোজার পর ক্যাটারাক্ট অপারেশন করিয়ে নিন”।
দু’হাজার বাইশের ৩রা মে ঈদ হল। তারপর ক’দিন ওই অপারেশন থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যতদিন
যায় দেখিতে না পাই অবস্থা হতে থাকে। দোলাভাই (ডা. ই আহমেদ)-এর ছাত্র ডা. অজয় পালের কাছে ভাগ্নে আমাকে পাঠাল। তিনি চোখ দেখার পর অপারেশন
করতে দু’টো টেষ্ট করাতে বললেন। ব্লাড সুগার আর ইসিজি। এবার সকলে আমাকে অভয় দিতে শুরু
করল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি নার্ভাস হতে থাকি। আমাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব নিল মলি
(কনিষ্ঠ শালিকা),
ওবাইদুর ও আব্দুল মাতিনের (দুই কৃতি ছাত্র) সাহায্যে
ডাক্তার বাবুর কথামত টেষ্টগুলো করাই। অপারেশনের আগের দিন থেকেই চোখে ড্রপ দেওয়া
শুরু করল মলি। অপারেশনের দিন অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে অপারেশনের দু’ঘন্টা আগে থেকে দু’টো ড্রপ দশ মিনিট
অন্তর দেওয়া শুরু করল। বলির পাঁঠাকে বলি দেওয়ার পূর্বে যেমন গা ধুইয়ে দেওয়া হয়
(আমাদের কোরবানীর পশুকেও তাই’ই করা হয়) আমাকেও
তারই মধ্যে স্নান করিয়ে নার্সিংহোম ধরে নিয়ে যাওয়া হল। কষাই যেমন পশুর দড়িটা ধরে
নেয় আমার ফাইলটা মলির হাত থেকে নিয়ে ডাক্তার বাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট রাজাধরবাবু
তাঁর মত করে চোখে কী সব ড্রপ দিতে থাকলেন। কিছুক্ষন পর উপরের তলায় ওটির পাশে একটা
বড় হলঘরে তিনি আমাকে এক সিস্টারের হাতে ছেড়ে দিলেন। দেখি সেখানে আট দশটা বেডে রোগীরা
নট নড়নচড়ন ওটির ড্রেস পরে
শুয়ে আছেন। ওটির ড্রেস পরিয়ে আমাকেও একটা বেডে শোয়ানো হল। সিস্টাররা বি.পি ও
পালসরেট লিখে নিলেন। আমার কী কী অপারেশন হয়েছে আমি কী কী ওষুধ খাই সব জেনে নিয়ে খসখস করে লিখে নিলেন। আমার
ইনহেলারটা সঙ্গে ছিল। ওটা ক’বার নিতে হয় জেনে নেওয়ার পর চলল চোখে ড্রপ দেওয়া ও চোখের
উপর বিটাডিন দিয়ে পরিস্কার করা।
বেডে শুয়ে আছি। সিস্টার এক-একবার চোখে ড্রপ দেওয়ার পর বলছেন ‘ঘুমানোর চেষ্টা করুন’। অন্ততঃ পক্ষে চোখ দু’টো বন্ধ রাখুন।
ওই অবস্থায় এক-একটা মুহুর্ত এক-একটা ঘন্টা বলে মনে হচ্ছিল। সঙ্গে মোবাইলও রাখতে দেয়নি। তাই
কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ করার উপায় নেই। বড়ই একা হয়ে মরার মত পড়েছিলাম আর অপারেশনের
কখন ডাক আসবে তার জন্য দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছিলাম। নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা
দিচ্ছি... ভয় পাওয়ার কী আছে! অথচ ভয়ের চোটে যত দোয়া দরুদ জানি পড়ে যাচ্ছিলাম।
দৃষ্টিশক্তি যে কত মূল্যবান তখন সম্যক উপলব্ধি করি। হঠাৎ শুনলাম একজন জিজ্ঞাসা
করছেন “বদিউর রহমান”টা কে?
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। বললাম “আমি বদিউর রহমান”। উনি বললেন কংগ্রেস এগজিবিশন রোডে এই নামে একজন আরবীর শিক্ষক
থাকতেন তাঁকে চেনেন?
বললাম “আমিই সেই অধম”। এবার তিনি আমার
বেডের কাছে এসে বললেন চোখটা খুলে আমাকে দেখুন তো। আমি ডাক্তার ভৌমিক। ওই বাড়িতে গিয়ে
আপনার কাছে আমার সার্টিফিকেটগুলোর আরবী অনুবাদ করিয়েছিলাম। তার কিছুদিন পরে
দিল্লীতে হামদার্দনগরে আপনার বাসায় সস্ত্রিক গিয়ে আরও কিছু কাগজ অনুবাদ
করিয়েছিলাম। তারপর আপনি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমাদেরকে অটোতে বসিয়ে দিয়েছিলেন।
ডাক্তার নিজাম লিবিয়া থেকে আপনার দিল্লীর ঠিকানা দিয়েছিল। আর ডাক্তার নিজাম তো লিবিয়া যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন আপনার কাছে দিল্লীতে ছিল।
ডাক্তার নিজামকে মনে পড়ল। দীর্ঘদিন লিবিয়ায় চাকরী করে কলকাতা ফেরৎ আসার এক
বৎসরেরে মধ্যে তিনি মারা যান। তিনি আমার দোলাভাই ই আহমেদের কংগ্রেস এগজিবিশন রোডের বাসায় গিয়ে আমার জন্য তার ঠিকানা
দিয়ে গিয়েছিলেন। দেখা করা আর হয়ে ওঠেনি। ইতিমধ্যে তিনি গত হন। ওনাদের
মধ্যে সবচেয়ে পরোপকারী ডাক্তারী ছাত্র ছিল জয়ন্ত মৌলিক। শীল ম্যানশন হোস্টেলে থাকত।
ডাক্তার ভৌমিকের কাছ থেকে জয়ন্তর কথা জানতে চাইলে উনি বলেন “মাস তিনেক আগে সেও চলে গেছে”। তার গত হওয়ার কথা শুনে খুব কষ্ট পেলাম। আমি জানতাম ও
আরজিকরে রয়েছে। ডাক্তার ভৌমিক বললেন “নিজাম,
জয়ন্ত আর আমি শীল ম্যানসনের একই রুমে থাকতাম”। মেডিক্যাল কলেজের
ওই ব্যাচে মাহফুজুর রহমান খন্দকার ও হোস্নেআরাও ছিল। ডাক্তার ভৌমিক বললেন ওদেরকে
চেনেন?
বললাম “ঘটনাচক্রে তারা
আমার আত্মীয়”। খন্দকার অত্যন্ত
মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিল। কারমাইকেল হোস্টেলের দোতলায় পূর্ব দিকের সিড়ির পাশের
রুমে থাকত। ওই রুমের চারজনই ছিলেন ডাক্তারী পড়ুয়া। খন্দকারের বিছানার অর্ধেক জুড়ে
থাকত বই-খাতা। শোয়ার জন্য ছিল সামান্য একটু খালি জায়গা। ফাইনাল এম. বি. বি. এস.
পরীক্ষায় মেডিসিনে প্রথম হন। ডাক্তার ভৌমিকের কাছে শুনলাম একজন কড়াপরীক্ষক ডা. অশোক চৌধুরী
খন্দকারকে বিভিন্ন প্রশ্ন বাণে জর্জরিত করে শেষে বলেন যে, “যদি অ্যাফিবুলেশন কী বলতে পার আর দেখাতে পার তাহলে তোমাকে
একশোয় ১০০ দেব”। খন্দকার
অবলীলাক্রমে সেটি দেখিয়ে দেয়।
ডাক্তার ভৌমিকের কথা শুনতে শুনতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের মধ্যে আমার
অপারেশন হবে। ডাক্তার বাবু বললেন হার্টের ডাক্তার হিসাবে আমি প্রত্যেক চোখ অপারেশনে
রোগীর হার্টের সমস্যা সম্পর্কে জেনে, অপারেশন যোগ্য করে আমি স্বয়ং ওটিতে থাকি। বললেন “ঠিক আছে রিল্যাক্সড থাকুন। ওটিতে দেখা হবে। পরে আরও কথা হবে”।
আমি বেডে শুয়ে অবাক হয়ে ভাবি প্রায় বিয়াল্লিশ বৎসর আগের কথা ডাক্তার ভৌমিক কী
করে মনে রেখেছেন! ওর প্রখর স্মৃতিশক্তি দেখে আমি শুধু অবাক নই হতবাক। ওটিতে ঢোকার
পর ডাক্তার ভৌমিক সেখানে উপস্থিত সকলের জন্য বললেন যে “লিবিয়া যাওয়ার আগে রহমান সাহেব কে দিয়ে দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর
পূর্বে আমার সার্টিফিকেটগুলো আরবী অনুবাদ করিয়েছিলাম। উনি একজন সজ্জন গুণী মানুষ”। আমার অপারেশনের
ডাক্তার স্বনামধন্য অজয় পাল বললেন “উনি আমার প্রত্যক্ষ স্যার সদ্য প্রয়াত ডা. ই আহমেদের আত্মীয়। ইনিও অধ্যাপক মানুষ। তাই ইনি আমারও স্যার”। আমি ওনার
মহানুভবতায় অবাক ও আপ্লুত।
অপারেশন টেবিলে শুতে শুতে ক্ষীণ স্বরে বলতে চেষ্টা করলাম “অত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসার যোগ্য ব্যক্তি আমি নই। আমি অতীব
সাধারণ এক শিক্ষক। তাই ধার করে বলি “এই মণিহার আমায় নাহি সাজে”। উভয় ডাক্তারবাবুর বিনয় ও মার্জিত ব্যবহার থেকে ওটির টেবিলেও
এক অভূতপূর্ব শিক্ষা পেয়ে সমৃদ্ধ হলাম। ভুলেই গেলাম আমার অপারেশন হচ্ছে।
দিনটি বৃহস্পতিবার, তারিখটি ২৬/০৫/২০২২। দিনটি আমার জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে
থাকবে। আর মনে রাখব মলিকে, যে আমার জন্য বেশ কয়েকদিন প্রাণপাত করে সেবা করল। তার অমূল্য সময় দিয়ে আমাকে
সাহায্য করল। বলতে পারেন অন্ধের ষষ্টি হয়ে আজীবন কৃতজ্ঞতা শৃঙ্খলে আবদ্ধ করল।
১৪/০৬/২০২২
সল্টলেক, কোলকাতা
স্যার !
ReplyDeleteআমি আপনার লেখাগুলো পড়ি আর মুগ্ধ হই। দোয়ার আবেদন রইলো।