আল্-আখ়্ত়াল গ়িয়াস বিন্ গ়াওস
(৬৪০ – ৭১০ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
জন্ম ও পরিচিতিঃ
উমাইয়া যুগের তারকারাজির মধ্যে
যাঁরা এই ধরাধামে কবিতা লেখার দ্বারা তাদের কাব্যপ্রতিভাকে বিকশিত করেছেন এবং
অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে তাঁদের কাব্য সাহিত্যকে মনোহর ফুলের মালার মত
প্রস্ফুটিত করেছিলেন কবি আখ্তাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কবি আখ্তাল
আরবের হীরা প্রদেশের বিখ্যাত তাগলিব গোত্রে দ্বিতীয় খলিফা উমার (রাঃ)–এর খিলাফত কালে ২০ হিজরী সনে
জন্ম গ্রহন করেন। কবির প্রকৃত নাম গিয়াস, উপনাম
আবু মালিক, পিতার নাম গাওস। মায়ের
নাম লায়লা। তিনি মাতা-পিতার ন্যায় জন্মগত ভাবে খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী
ছিলেন।
শৈশব কালঃ
বাল্যকালেই কবির আগামী উন্মেষময়
দিনগুলির সোনালী অম্বরে দেখা দেয় ঘনকালো মেঘ। শৈশবেই তিনি মাতৃহারা হন। কারণ তাঁর পিতা তাঁর মা লায়লাকে তালাক দিয়ে অন্য এক মহিলাকে বিবাহ করেন।
ফলে কবি মাতৃস্নেহের পরিবর্তে বিমাতার রোষানলে দগ্ধ হতে থাকেন। ক্রোধের সীমা
অতিক্রম করলে তাঁকে দাওবাল (ছোট
গাধা) বলে গালি দিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি বিমাতা। ফলে
বাল্যকালেই কবি ঝগড়াটে, রুক্ষ মেজাজের এবং বাচালে পরিণত হন।
কবি রূপে আখ্তালঃ
ব্যঙ্গ কবিতা দিয়েই তাঁর কবিত্বের সূচনা, সর্বপ্রথম
তিনি বিমাতার কুৎসা করে কবিতা
রচনা করেন। তবে তাঁর স্বীয় গোত্রীয় মুসলিম কবি কা’ব বিন জুআ’য়েল-এর বিরুদ্ধে নাক়ায়েদ় (দ্বন্দ্বমূলক) কবিতা রচনা করেন। এর ফলে আখ্তাল
এর সুনাম কবি হিসাবে সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়ে।
আখ্তাল উপাধিঃ
আরবী ভাষায় আখ়্ত়াল শব্দের অর্থ হল বাঁচাল, যে অত্যাধিক কথা
বলে, বোকার মতো কথা বলে। শিশুকালে আখতাল কারণে অকারণে
বড্ড বেশী কথা বলতেন, সেই জন্যই লোকে তাঁকে আখ়্ত়াল বলে ডাকতো। এছাড়া তিনি জ়ুস়্-স়ালীব ও জ়ুল্-গ়াবাইয়াহ্ নামেও নামেও
অ্যাখ্যায়িত হন।
কবির চরিত্রঃ
খ্রীষ্টান কবি আখ্তাল–এর ধর্মের
আচার আচরণের প্রতি নিষ্ঠার সৈথিল্য থাকলেও ধর্মের প্রতি মোটামুটি শ্রোদ্ধা ভাজন
ছিলেন। খলিফা আব্দুল মালিক আখ্তালকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য
আহ্বান জানান এবং দশ হাজার টাকা পেনশন হিসাবে দান করবেন বলে প্রস্তাব দেন। কিন্তু
কবি তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি অধিক
মদ্যপায়ী ছিলেন। আর ইসলাম ধর্মে মদ্যপান নিষিদ্ধ। বর্ণিত আছে কবি আখ্তাল মদে মত্ত হয়ে অগোছালো রেশমী
জুব্বাহ পরে ক্রশ চিহ্নের লকেট যুক্ত হিরন্য চেন গ্রীবাদেশে ঝুলিয়ে, চিরুনীবিহিন এলোমেলো দাড়ি দিয়ে মদিরা চুঁইয়ে পড়ত এমতবস্থায় শান-শাওকাতের সাথে, বিনা অনুমতিতে খলিফার দরবারে
প্রবেশ করতেন।
কুৎসা রচনায় আখ্তালঃ
আনসারদের কবি ‘আব্দুর রাহ্মান বিন্ হাসসান হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর কন্যা, ইয়াযিদের বোন রামলাহ্-এর রুপ সৌন্দর্য্য ও প্রেম প্রণয়ের বর্ণনা সম্বলিত একটি চাঞ্চল্যকর কবিতা রচনা কররেন। এ ঘটনা ইয়াযিদের নিকট বারুদে অগ্নিসংযোগের কাজ করে। ইয়াযিদ তাই আনসারদের কুৎসা বর্ণনায় কা’ব বিন
জুয়ায়েলের সাহায্য চাইলেন। কা’ব তার জবাবে বলেন, তুমি কি আমাকে ইসলাম গ্রহনের
পর পুনরায় শিরকের পথে আহ্বান করছ? যারা আল্লাহ্র
নবী (সাঃ)-কে দুঃসময়ে সমস্ত প্রকার সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন সেই আনসারগনের
বিরুদ্ধে আমি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করব? তবে আমি
তোমাকে এক খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী কবির নাম বলছি যার জিহ্বা বলদের জিহ্বার ন্যায়, সে হল আখ্তাল।
তার পর ইয়াযিদ আব্দুর রাহ্মান এবং
আনসারদের বিরুদ্ধে কুৎসা রচনার জন্য আবেদন করেন। অতঃপর আনসারদের উদ্দেশ্যে কবি আখ্তাল এক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করেন। তার একটি চরণে তীব্রভাবে কুৎসা করে তিনি বলেছেন—
ذهبت
قريش بالمكارم كلها واللئوم
تحت عمائم الأنصار
উমাইয়্যাহ্দের কবি রূপেঃ
আখতাল ছিলেন উমাইয়া খলিফাদের
অত্যন্ত প্রীয় কবি। তিনি উমাইয়া খেলাফতের দরবারি কবি ছিলেন। তাই আব্দুল
মালিক বিন মারওয়ান আখ্তালকে দিয়ে কায়েস গোত্রের
বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করিয়েছিলেন। তিনি আব্দুল মালিকের প্রশংসায় বহু কাসীদাহ্ রচনা করেছেন। ফলে আব্দুল
মালিকের করুণা লাভ করে আখ্তাল ধন-সম্পদ ও
প্রতিপত্তি উভয়ই অর্জন করেছিলন। আব্দুল মালিক তাঁকে “শা‘য়েরু বানী উমাইয়্যাহ্” (উমাইয়্যাহ্দের সভাকবি) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর কবিতার মাধ্যমে উমাইয়ারা তাঁদের
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পরলোকগমনঃ
কবি
আখ্তাল ৭০ বছর বয়সে ৯২ হিজরি মোতাবেক ৭১০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওয়ালিদ বিন্ আব্দুল
মালিকের খেলাফতের পঞ্চম বছরে ইহলোক ত্যাগ করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তিনি ফোরাত
উপকূলে খ্রিস্ট ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
কবিতার বৈশিষ্টঃ
বাল্যকাল হতে নান ঘাত-প্রতিঘাতের
মধ্য হতে বড় হওয়ার ফলে যৌবনে পদার্পন করে
একজন সুরাসক্ত খ্রীষ্টান কুৎসা রচনাকারী দীর্ঘ জিহ্বার অধিকারী, প্রমোদপ্রীয় কবি
হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তিনটি বিষয়ে কবিতা রচনায় সমকালীন
সমস্ত কবিকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ওই তিনটি বিষয় হল মাদাহ্ (প্রশংসা), হিজা (ব্যঙ্গাত্মক) ও ফাখ্রিয়্যাহ্ (গৌরবগাঁথা)। তাঁর অধিকাংশ কবিতা ছিল মদের
প্রশংসায়। মদ সম্পর্কে তিনি কাসীদাহ্ও রচনা করেছেন—
إذا
ما نريمى علئنى ثم علئنى
ثلاث دجاجات لهن هدير
কবি আখ্তালের ব্যঙ্গ কবিতা ছিল
অত্যন্ত গর্বের বিষয়। তা কোনো কুমারী পাঠ করলে লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে যেত। তিনি একটি
কবিতা রচনায় প্রায় এক বছর সময় লাগাতেন। নব্বই হতে একশত সম্বলীত চরণের কবিতা
পরিমার্জন করতে করতে ত্রিশ চরণে দাঁড়াত। কিন্তু এর পরে কবিতায় যে মানোন্নয়ন ঘটত
এবং নব জীবন লাভ করত তা চোখে পড়ার মত।
দ্বন্দমূলক কবিতাঃ
এ ছাড়াও তাঁর কাব্য রচনার একটা বিরাট অংশ জুড়ে বিরাজ করছে তার নাক়ায়েদ় (দ্বন্দ্বমূলক) কবিতা। এর মাধ্যমে এক কবি তার প্রতিপক্ষ কবির কবিতার উত্তর দিতেন
একই ছন্দ, তাল ও অন্তমিলে। কবি আখ্তাল তিনজন
কবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন মাদাহ্ বর্ণনার দিক দিয়ে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি প্রাচীন
পন্থা অবলম্বনে কাব্য সম্পাদন করতেন। কাসীদাহ্র সূচনায় তিনি
তুলনামূলক আলোচনার উপস্থাপনা ও পরে প্রশংসা ও গুনকীর্তনমূলক আলোচনা পরিবেশন
করেছেন। ইত্যবসরে স্বীয় বংশের বড়াই সংযোজন করতে ভুলেননি তিনি। যুগশ্রেষ্ঠ কবি আখ্তাল তাঁর এই অসাধারণ
কাব্য প্রতিভা এবং কৃতিত্বের জন্য পাঠকসমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে
আছেন।
Chetonar bani
ReplyDeleteহাতে মারা শুধু যথেষ্ট নয় চাই যে এবার ভাতেও মারা
ReplyDeleteবঞ্চনাতে হয়নি রে সুখ, নে কেড়ে নে হিংসা দ্বারা---- এযুগের কাজী তো ভালই লিখে!! তোমার লেখায় প্রাণ পাবে ঝিমিয়ে পড়া বিপ্লবl
বর্তমান সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং অসাধারণ...
ReplyDelete