Wednesday 20 January 2016

আরবের গায়ক কবি আল্‌-আ‘শা

আরবের গায়ক কবি ল্‌-আশা

(৫৭০ – ৬২৯ খ্রি)  

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

পরিচিতি ও জন্মঃ

প্রাক-ইসলামী যুগে আরবী কাব্য সাহিত্য চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সেযুগে রচিত গীতি কাব্যগুলো আজও বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বিপুলভাবে সমাদৃতএই আরবী সাহিত্য কাব্যাকাশে উজ্জল নক্ষত্রগুলির মধ্যে কবি আল-শা উল্লেখযোগ্য ও অন্যতমতিনি গায়ক কবি নামে অধিক পরিচিত। কবি আল-আশার প্রকৃত নাম মায়মূন পিতার নাম কায়েসউপনাম আবূ বাসীরল্‌-আশা ছিল তাঁর উপাধি। দৃষ্টিশক্তির দূর্বলতার জন্য তাঁকে এই নামে ডাকা হতো। আরবগণ তাঁকে স়ান্নাজাতুল্‌ ‘আরাব” (صناجة العرب)  অর্থাৎ আরবের চারন কবি নামে ডাকতোপিতামহের নাম জানদাল। কবির মাতা ছিলেন বিখ্যাত কবি মুসাইয়্যিবিন্‌ আলস-এর বোন। তিনি ইয়ামামা প্রদেশের দক্ষিনে অবস্থিত মানফুহা মরুদ্যানের দুরনা নামক স্থানে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।

 

প্রাথমিক জীবনঃ

তাঁর শৈশব জীবন সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি বাল্যকালে স্বীয় মামা মুসাইয়িবের এবং গোত্রের অন্যান্য কবিগণের আবৃত্তিকারক হিসেবে কাব্য জগতে প্রবেশ করেন। মুসাইয়্যেবের নিকট থেকে তিনি কাব্য রচনার জ্ঞান লাভ করেন। অতঃপর কাব্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর কবিত্বের সুখ্যাতি সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতা রচনায় নিজের দক্ষতা ও প্রতিষ্ঠা লাভের পর তিনি কাব্য রচনাকে জীবিকার্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রশংসামূলক কবিতা রচনার মাধ্যমে তিনি উপঢৌকন চাইতেন।

 

স়ান্নাজাতুল্‌ ‘আরাব রূপেঃ  

তিনি কবিতা আবৃত্তি করে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। আল্‌-‘ঊদ (العود) নামের এক বিশেষ ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইতেন ও কবিতা আবৃত্তি করতেনএকদা লোকেরা পারস্য রাজা কিস্‌রাকে তাঁর গান শুনানোর আয়োজন করেছিল। আস্‌-সান্‌জ (الصنج) যন্ত্রটি তিনিই তাঁর কবিতায় প্রথম উল্লেখ করেন। তিনি আরব উপদ্বীপের দূরদূরান্তে গমণ করে ধনীদের সামন্তদের দরবারে ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও সামন্তদের প্রশংসায় কবিতা রচনা করে উপহার ও উপঢৌকন লাভ করতেন। আল্‌-আস্‌ওয়াদ ইব্‌নুল্‌-মুনযির ও তাঁর ভ্রাতা আন্‌-নু’মান এবং আইয়াস ইব্‌নু কাবিস আত-তায়ীর প্রশংসায় কবিতা রচনা করেএছাড়া হিরা কায়েস ইব্‌নু মায়াদিকরুব আল-কিন্দী; ইয়েমেনের সালামা ফাহিশ, ‘ব্দল্‌-মাদান এবং লহুয়া ইব্‌নু আলী প্রমুখ সরদারগণের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছিলেন। আল-আশা কাজ মেলায় অংশগ্রহণ করতেন এবং বিশিষ্ট আরব শেখ ও সম্ভ্রান্ত লোকদের প্রশংসা-গীতি রচনা করতেন।

 

কর্মব্যস্ততাঃ

এ দীর্ঘ সফর কালে তিনি বিভিন্ন ধর্মালম্বী ও বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কবি আল-আশা শুধু রাজা-বাদশাহদের প্রশংসা মূলক কবিতা রচনা করেই জীবন যাপন করতেন না তিনি যুদ্ধের ময়দানেও উপস্থিত থাকতেন। স্বীয় গোত্র বানু বাক্‌রের সাথে পারস্যের (ইরান) যুদ্ধ শুরু হলে আল-আশা বীরত্বমূলক কবিতার মাধ্যমে নিজ গোত্রকে উৎসাহ দিতেন এবং ব্যাঙ্গাত্বক কবিতার মাধ্যমে পারস্যবাসীদেরকে পর্যুদস্ত করতেন। আবার কোনো আরব গোত্র পারস্যের সমর্থন করলে তিনি তাদেরকেও কবিতায় ধমক দিতেন। একবার তাঁর গোত্রের সাথে শাইবান গোত্রের ঝগড়ায় তিনি শাইবান গোত্রের ইয়াজিদ ইব্‌নু মুসহের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক কবিতা রচনা করেন। অনুরূপভাবে আল-আশা বিরোধী গোত্র ও দলের বিরুদ্ধে বহু ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করেছেন। তার রচিত ব্যাঙ্গ কবিতায় কঠোর উপহাস ও বিদ্রুপ পরিলক্ষিত হয়। কবি ল্‌কামা ও তাঁর শত্রু আমের ইব্‌নু ত্‌-তোফাইলকে তুলনা করে ল্‌কামার বিরুদ্ধে যে ব্যঙ্গ রচনা করেছিলেন সেটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা।

 

জীবনাবসানঃ

কবি আশা দীর্ঘজীবি হয়েছিলেন। শেষ দিকে তাঁর দৃষ্টি শক্তি লোপ পেয়েছিল অনেকের ধারণা, সময়েই তাঁর আশা ছদ্ম নামের উৎপত্তিকারণ আশা অর্থ কানা বা অন্ধ উটনী। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের খবর পেয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে মদীনায় যাত্রা করেছিলেন। উপঢৌকন হিসেবে তিনি মহানবীর (সাঃ) প্রশংসায় একটি কাসীদাও রচনা করেছিলেন। কাসীদাটি তাঁর উত্তম রচনাগুলির একটি। তিনি মদীনায় যাচ্ছেন শুনে কোরায়েশরা বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা তাঁকে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানায় এবং একশত লাল রংয়ের উষ্ট্রী উপহার দেয়। অতঃপর আল-আশা মাঝ পথ থেকে ফিরে যান। কিন্তু তিনি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। পথিমধ্যেই তিনি হঠাৎ তাঁর উষ্ট্রীর পিঠ থেকে পড়ে গুরুতরভাবে আহত হন এবং সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এভাবে ৬২৯ খ্রীষ্টাব্দে এই বিখ্যাত চারণ কবির জীবনাবসান ঘটে।

 

ধর্মবিশ্বাসঃ

আবু সুফিয়ানের বর্ণনা মতে আল-আশা মূর্তিপূজক ছিলেন। তাঁর কবিতাতেও ধরণের আলোচনা পাওয়া যায়। ফাদার লুইস শাইখু এবং অন্যান্য প্রাচ্য-বিশারদদের ধারণা শা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু এ ধারণা সত্য নয়। কেননা আশার কবিতা ও তাঁর জীবনের কাজকর্মে এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় না।

 

কাব্যপ্রতিভাঃ

জাহেলী যুগের কবিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশী কবিতা রচনা করেছেন। দীর্ঘ কবিতা ও বিভিন্ন শ্রেনীর যথা মাদীহ, হিজা, ফাখ্‌র, ওয়াস্‌, খাম্‌র ও গাযাল ইত্যাদি কবিতা রচনা করা কবি আল্‌-আশার বিশেষ বৈশিষ্টএ কারণে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর কবিতার মধ্যে প্রশংসামূলক কবিতাই বেশী। তিনিই প্রথম কবি যিনি কবিতার বিনিময়ে অর্থ অন্বেষন করেছেন এবং কবিতাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে গণ্য করে দেশে দেশে ঘুরেছেন।

 

কবিতার বৈশিষ্টঃ

আরবী কাব্যসমালোচকগণ ল্‌-আশাকে জাহেলী যুগের কবিদের মধ্যে প্রথম শ্রেনীর অর্থাৎ ইমরাউল কায়েসদের সমশ্রেনীর প্রতিভাধর কবি বলে মনে করেন। আবুল্‌ ফারাজ ইস্‌ফাহানী তাঁকে শ্রেষ্ঠ কবি বলে মন্তব্য করেছেন। বেদুঈন কবিতার অন্যান্য গুণ ছাড়াও আশার কবিতায় বর্ণনার লালিত্য, ভাষার গঠন-শৌকর্য আর মদের প্রশংসায় তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিকতা পাঠকের মনকে স্পর্শ করে। সম্ভবতঃ এ জন্যই তাঁর কবিতার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। যার ভয়ে কোরায়েশরা তাঁকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছতে দেয়নি। তাঁকে আরবের চারণ কবি বলা হ তিনি যার প্রশংসা করতেন সমগ্র আরবে তার সুনাম ছাড়িয়ে পড়ত। আর অতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির তিনি নিন্দা করলে সে ব্যক্তি অতি হেয় প্রতিপন্ন হয়ে যেতো ল্‌-মুল্‌হিক নামে একটি দরিদ্র ব্যক্তির আটটি মেয়ে ছিল। সে তাদের পাত্রস্থ করতে পারছিল না। লোকটি কোনো এক সময় কবি আশাকে নিমন্ত্রণ করে যত্নসহকারে খাওয়ায়। কবি তখন তার প্রশংসায় এমন কবিতা রচনা করেছিলেন যে, তা শুনে সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে ওই মেয়েগুলোর বিয়ে হতে দেরী হয়নি। উকাজ মেলায় কবিতা আবৃত্তি করে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। আস্‌য়াদ্‌ কিন্দীর প্রশংসায় রচিত তাঁর কবিতাটিকে কেউ কেউ মুআল্লাকাতে শামিল করেছেন।

 

বিষয়বস্তুঃ

তাঁর কবিতায় মরুভুমি ও উটের বর্ণনা বেশী লক্ষ্য করা যায়। তার কারণ হল, তিনি প্রায় সময় সফরে থাকতেন। সে যুগের অন্যান্য কবিদের মত তিনিও লু-হাওয়া, পানি, বৃষ্টি, উপত্যকা, অন্ধকার, দুর্গম পথ, বালি, জলাশয়, নিরাপত্তা এবং রাত্রিকালে জিনের শব্দের বর্ণনা দিয়েছেন। মদের বর্ণনা তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ঠ। তিনি কাসীদার প্রারম্ভে গযল অংশের পরেই মদের উল্লেখ করেন। মদ ও মদপানকারীদের অন্তরে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেন। যখন মদ পান করতেন মদের বর্ণনায় কবিতা রচনা করতেন। এই জন্যই বলা হয় যে, আল-আশা শ্রেষ্ঠ কবি যখন মদ পান করে কবিতা রচনা করতেন। কথিত আছে—

امرؤ القيس إذا ركب ، وزهير إذا رغب ، والنابغة إذا رهب ، والأعشى إذا طرِب

(শ্রেষ্ঠ কবি— ইম্‌রাউল কায়েস যখন আরোহণ করেন, যুহায়ের যখন উৎসাহিত করেন, নাবেগাহ্‌ যখন সতর্ক করেন, আর আ'শা যখন আপ্লূত হন।)

 

তাঁর যে কবিতাটিকে অনেকে মু’আল্লাকার অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাতে এক জায়গায় তিনি বলেছেন

ودِّع هریرةَ إنَّ الرکبَ مرتحلُ    وهل تطیقُ وداعاً أیُّها الرجلُ؟

রাসুল (সাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতাটি রচনা করেছেন তাতে বলেছেন 

ألم تـَغتـَمِض عيناكَ ليلَةَ أرمــدا          وبِتَّ كما باتَ السـَّليمُ المُسهـَّدا
وما ذاك من عِشقِ النـِّساءِ وإنـَّما           تَناسَيتَ قبلَ اليومِ خُلـَّةَ مَهـدَدا

No comments:

Post a Comment