Wednesday 2 March 2016

আমর বিন‌ বাহর আল-জাহিযঃ এক বিস্ময়কর প্রতিভা


‘আম্‌র বিন্‌ বাহ়্র আল্‌-জাহিয
(৭৭৬ – ৮৬৮/৮৬৯ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 
পরিচিতি ও জন্মঃ
আব্বাসীয় যুগের স্বর্ণময় অধ্যায়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আল্‌-জাহিযের প্রকৃত নাম ‘আম্‌র, উপনাম আবু উস্‌মান। পিতার নাম বাহার, পিতামহের নাম মাহ্‌বুব। তাঁর জন্ম সন নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। আল-ফাখূরীর মতে ১৫৯ হিজরি মোতাবেক ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দেকার্ল ব্রকেলম্যানের মতে ১৫০ হিজরি মোতাবেক ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং আল্‌-জাহিয  বলেন, আমি জন্মগ্রহণ করি ১৫০ হিজরি সনের প্রথমভাগে। অবশ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, আল্‌-জাহিয ১৬০ হিজরি মোতাবেক ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে বসরায় জন্ম গ্রহণ করেন।
 
শৈশব ও শিক্ষার্জনঃ
শৈশবেই পিতা ইন্তেকাল করলে তাঁর মা-ই তাঁকে লালিত-পালিত করেন। পিতৃহীন পরিবারে ছিল করুন দারিদ্র্য। ফলে শৈশবেই বস্‌রার সীহান নদীর তীরে কখনো মাছ, কখনো রুটি, আবার মাঝে মাঝে তরমুজ বিক্রি করে পরিবারের অর্থকষ্ট লাঘবে সহায়তা করেন। জীবন সংগ্রামে লড়াইয়ের ফাঁকে ফাঁকে তিনি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তৎকালীন সময়ে কুফা ও বসরা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল। বিশেষতঃ আরবী ব্যাকরণের দিক দিয়ে উক্ত প্রদেশদ্বয় ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। সেখানকার মসজিদে জ্ঞানী-গুণী, সাহিত্যিক, বৈয়াকরণিক ও ভাষাবিজ্ঞানীদের সমাবেশ ঘটতো। আল্‌-জাহিয  ওই সমস্থ সমাবেশে উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের সংস্পর্শে এসে তাঁদের নিকট থেকে লেখাপড়া শিখতেন । নিজ প্রখর ধী-শক্তি দ্বারা জ্ঞান আহরণে আত্মনিয়োগ করতেনতিনি আল্‌-মির্‌বাদ নামক স্থানে আরব বাগ্মীদের নিকট হতে অলংকার বিদ্যা ও বাক্য বিন্যাসের কলা-কৌশল আয়ত্ব করতে সক্ষম হন।
 
যৌবনের প্রারম্ভে তিনি বাগদাদ নগরীতে গমন করেন। সেখানে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব  ভাষাবিজ্ঞানীদের যেমন আসমায়ী, আবু উবায়দা, ইবনে আল-মুসান্না, আবু জায়েদ আনসারী প্রমুখের নিকট থেকে ভাষা বিদ্যা ও ভাষা বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। তিনি আবুল হাসান আখফাশ-এর নিকট ব্যাকরণ শেখেন। সালেহ ইব্‌নু জুনাহ আল্‌-লাখমী, ইবরাহীম ইব্‌নু সায়্যার ল্‌-বাল্‌খী, আবু ইস্‌হাক আন্‌-নায্‌যাম প্রমুখের নিকট ধর্মতত্ব, তর্কশাস্ত্র শিক্ষা করেনআল্‌-জাহিয  যে সকল মুহাদ্দেসগণের নিকট ইলমে হাদীস অধ্যায়ন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ, ইয়াজীদ ইব্‌নু হারূন, হাজ্জাজ ইব্‌নু মুহাম্মদ বিশেষ ভাবে প্রসিদ্ধ। এছাড়াও কবিতা, কাব্য সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ে তিনি ইব্‌নু ওয়াহাব, ইব্‌নু যায়্যাত, খাল্‌ফ আল্‌-আহ্‌মার প্রমুখের নিকট শিক্ষা লাভ করেন এভাবে তিনি আরবী ভাষায় দক্ষতা লাভের সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি সভ্যতার ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জন করেন।
 
তিনি জ্ঞান পিপাসু ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। অধ্যায়নের প্রতি তাঁর ঝোঁক এত প্রবল ছিল যে, এ বয়সেই তিনি পুস্তক বিক্রেতাদের দোকান ভাড়া করে নতুন-পুরাতন বইপুস্তক পড়াশুনার নিমিত্তে সেখানে রাত যাপন করতেন। এভাবে জ্ঞানের অনেক সূক্ষ্ম বিষয় তাঁর নখদর্পন হয়েছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক রহস্য উদঘাটন করে আরবী সাহিত্যে অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। আল্‌-জাহিয  শুধু নিজ দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীই নয়, বরং নিজ দেশের প্রতিনিধি হবারও যোগ্যতা অর্জন করেন।
 
কর্মব্যস্ততাঃ
আল্‌-জাহিয  জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সফল ভাবে বিচরণের মাধ্যমে অর্জিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পুস্তক রচনায় মনোনিবেশ করেন। হিজরী তৃতীয় শতকে সমসাময়িক লেখকদের মাঝে তাঁর প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়েতৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক খলীফা আল্‌-মামুন আল্‌-জাহিয প্রনীত কিতাব আল্‌-ইমামাত পাঠ করে বিষ্ময়াভিভুত হয়ে তাঁকে দীওয়ান আল-রাসাইল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন। তিনি সেখানে মাত্র তিন দিন অবস্থান করেই পদত্যাগের মাধ্যমে দরবার ত্যাগ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকের দরবারে ও বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের নিকট যাত্রা করেন । আল্‌-জাহিয খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ ও ওয়াসিক বিল্লাহ্‌-এর উজীর মুহাম্মদ ইব্‌নু আব্দুল মালিক ওরফে ইব্‌নুয্‌ যাইয়াতের সাথে কিছুকাল ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেন। তিনি দামেশ্‌ক ও ইনতাকিয়াহ্‌ ভ্রমণ করেন। ৮৪৭ সনে খলিফা মুতাওয়াক্কিল ইব্‌নুয্‌ যায়্যাতকে বরখাস্ত করলে আল্‌-জাহিযকেও বন্দী করা হয়। অতঃপর বন্দী অবস্থায় তিনি কাজী আহ্‌মাদ ইব্‌নু আবু দূয়াদ-এর দরবারে নীত হলে প্রজ্ঞা ও বাকচাতূর্যের গুণে কাযীর করুণা লাভে সক্ষম হন এবং কাযীর পুত্র আবু আল-ওয়ালীদ-এর সময় পর্যন্ত তার দরবারে কাটান। এরপর তিনি খলিফা মুতাওয়াক্কিল-এর অপর উজীর আল-ফাতাহ ইব্‌নু খাকান-এর সাহচর্য লাভে সমর্থ হন। এছাড়া তিনি মন্ত্রণালয়ের দফতরে কিছু দিন ইবরাহীম ইব্‌নুল্‌- আব্বাস আল-সুলীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এক সময় খলীফা মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ তাঁর জ্ঞানের গভীরতার কথা শুনে তাঁকে তাঁর পুত্রের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের আমন্ত্রন জানান । কিন্তু কুৎসিত কদাকার চেহারা ও বক্রচক্ষু হওয়ার কারণে দশ হাজার দিরহাম প্রদান করে তাঁকে ফিরিয়ে দেন। তিনি কোনো সরকারী পদ গ্রহণ করেননি এবং কারো অধীনে নিয়মিত চাকুরী তো নয়ই। তিনি নিজ গ্রন্থসমূহ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের নামে উৎসর্গ করে অর্থোপার্জন করতেন। কিছুদিন তিনি সরকারী ভাতাও লাভ করেন। তিনি সমসাময়িক অন্যান্যদের ন্যায় সুবিধাবাদী ও দরবারী ছিলেন না।
 
মৃত্যুঃ
শেষ জীবনে আল্‌-জাহিয  পক্ষাঘাত গ্রস্থ হন। তিনি বসরাতে নিজ গৃহে অসুস্থ অবস্থায় জীবন কাটাতে থাকেন। পক্ষাঘাতের পাশাপাশি তিনি আল-নিকরিস রোগেও আক্রান্ত হন। দীর্ঘ দশ বছর এভাবে রোগ ভোগের পর আল্‌-জাহিয ২৫৫ হিজরি সনের মুহার্‌রাম মাসে মোতাবেক ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর, মতান্তরে ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারী মাসে বসরায় পরলোক গমন করেন। কথিত আছে, তাঁর উপর পুস্তকের স্তুপ পতিত হবার ফলে তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এ বর্ণনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়না। খলীফা হারুন আল-রশীদ-এর মা খায়যুরানের সমাধিস্থলে আল্‌-জাহিযকে সমাহিত করা হয়।
 
আল-জাহিয মুতাযেলী মতালম্বী ছিলেন।  মতবাদের উপর তিনি এত অধিক রেসালা ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত এ মতবাদকে আল-জাহেযীয়া মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা হতো। এ মতবাদে ৩০টি সমালোচনামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। আবু মান্‌সুর আব্দুল কাহির আল-বাগদাদী তাঁর আল-ফারকু বায়নাল্‌ ফিরাক গ্রন্থে এবং আব্দুল কারীম আল্‌-সাহরাস্তানী তাঁর আল্‌-মিলাল ওয়া আন্‌-নিহাল গ্রন্থে আল-জাহিযের প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। আল-জাহিযের শারিরীক গঠন সুশ্রী না থাকলেও তিনি খুবই শান্ত-শিষ্ট, উৎফূল্য, মিষ্টভাষি ও কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। তিনি খুব দাতা ছিলেন। তিনি বন্ধু মহলে খুবই প্রিয় ও সমাদৃত ছিলেন।
 
সাহিত্য কীর্তিঃ
আরবী সাহিত্যে বিশেষশৈল্পিক গদ্যে আল্‌-জাহিযের অবদান অসামান্যআহমদ হাসান যাইয়াত তাঁকে আরবের নাবেগা ও প্রাচ্যের ভলটেয়ার বলে অভিহিত করেছেন। বিষয় বস্তু সংখ্যায় সব দিক দিয়েই আল্‌-জাহিয ছিলেন যুগের পথিকৃত ও নেতৃস্থানীয়। ইব্‌নুল্ জাওযী তাঁরগ্রন্থ সংখ্যা ৩৬০টি বলে উল্লেখ করেছেন। ইয়াকুত আল্‌-হামাভী মুজামুল উদাবা গ্রন্থে ১২৮টি ও ইব্‌নু হাজার স্‌কালানী লিসানুল মীযান গ্রন্থে ১৭০-এর কিছু অধিক বলে দাবী করেছেন। তার মধ্যে ৩০ খানা গ্রন্থ এখনো পৃথিবীর বুকে নিরঙ্কুশভাবে বিদ্যমান আছে। বাকী গ্রন্থগুলোর মধ্যে ৫০ খানি আংশিক ভাবে পাওয়া যায়। অবশিষ্ট গুলির কোনো হদীস মেলে না। তাঁর রচিত অগনীত গ্রন্থের মধ্যে কিতাবুল্‌ ইমামাত, কিতাবুল্‌ হায়াওয়ান, কিতাবুল্‌ বায়ান ওয়াত্‌ তাব্‌য়ীন, কিতাবুল্‌ বুখালা, রিাসালাতু ফী বায়ানি মাযাহিবিশ্‌ শী’আহ্‌, হুজ্জাতুন্‌ নবুয়াহ্‌ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

No comments:

Post a Comment