দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ পরিচিতিঃ
সাহিত্য-প্রেমিকদের নিকট আরবি সাহিত্যের উপাদানের আধিক্য সুপরিচিত। এই সাহিত্য উপদানগুলির মধ্যে দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ অন্যতম। এই সংকলনে বহু মূল্যবান আরবি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এই সংকলনটি না হলে হয়তো বহু কবিতা বিলুপ্ত হয়ে যেত। কবি আবু তাম্মাম হাবীব বিন আওস আত্-তায়ী সর্বপ্রথম দীওয়ানুল হামাসা সংকলন করেন।
দীওয়ান শব্দের অর্থ সংকলন, সঞ্চয়িতা ইত্যাদি। আর হামাসাহ্ শব্দটি হামাসা ক্রিয়াপদের মাস্দার বা বিশেষ্যপদ। এর অর্থ সাহসিকতা, তীব্রতা, উদ্দীপনা, শৌর্যবীর্য, লড়াই করা ইত্যাদি। আল্-হামাসাহ্ বা সাহসিকতা ও শৌর্যবীর্য বিষয়ক কবিতার অধিক সংকলনের কারণে উক্ত নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, এই বিশাল কাব্যসংকলনটির আল্-হামাসাহ্ নামকরণ করা হয়েছে, কারণ বাবুল্ হামাসাহ্ শিরোনামের অধ্যায়টি এই সংকলনের সব থেকে বড় অধ্যায়। অথবা এই জন্য যে, এটি এই সংকলনের প্রথম অধ্যায়। আর প্রথম অধ্যায় দ্বারা নামকরণ মধ্যযুগীয় সাহিত্যে একটি সুপরিচিত বিষয় বা রীতি।
দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ সংকলনের কাহিনীঃ
আব্বাসী যুগে যখন সাহিত্য ও কাব্যরুচি পরিবর্তিত হল, সাহিত্য প্রেমিকরা নির্বাচিত কতিপয় সাহিত্যসৃষ্টির স্বাদগ্রহণে মগ্ন হয়ে পড়ল। ফলস্বরূপ সে যুগে কতিপয় সাহিত্য সংকলনের আত্মপ্রকাশ ঘটল। তার মধ্যে দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ অন্যতম। আর এর রচনার পটভূমি হচ্ছে, কবি আবু তাম্মাম খোরাসান হতে ইরাকের দিকে যাত্রা করছিলেন। পথিমধ্যে হামাযানে আবুল্ ওয়াফা বিন সালামাহ্র নিকট অতিথিরূপে কিছু দিন অবস্থান করেন। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড তুষারপাতে অগ্রযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা দেখে আপ্যায়ক অতিথিকে বলেন, এখানে আরও কিছু দিন অবস্থানের ব্যাপারে মনস্থির করুন। এবং নিজ সঞ্চিত পুস্তক ভাণ্ডার তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করেন। আবু তাম্মাম সেই পুস্তকগুলি অধ্যায়ন করার পর পাঁচটি কাব্যসংকলন প্রস্তুত করেন। তার মধ্যে দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ অধিক বিখ্যাত। তিনি উক্ত সংকলনে প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে আব্বসী যুগ পর্যন্ত বহু কবিতা সংকলন করেছেন।
দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্র সাহিত্য-মূল্যঃ
সাহিত্য মূল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংকলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এর কিছু সাহিত্যিক মূল্য পর্যালোচনা করা হল—
(১) কাব্যের উৎস বা প্রাচীন কাব্যের রক্ষাকারীরূপেঃ নিঃসন্দেহে দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ আরবি সাহিত্যের কাব্য-সংকলনগুলির মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। এ সংকলনে ৩৯০২টি বায়েত বা পঙক্তি, ৮৭১টি মাক্তা’ বা ছোট কবিতা এবং ৮৫৪ জন কবির বাণী সংকলিত রয়েছে। আবু তাম্মামের এই সংকলনের মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। এ সংকলনটি না হলে বহু কবিতা ধরনি তল হতে বিলুপ্ত হয়ে যেত, বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করেছেন।
(২) ইতিহাসের পুস্তকরূপেঃ এই সংকলনের মারফৎ প্রাক-ইসলামী যুগ হতে আব্বাসী যুগ পর্যন্ত বহু গোত্র, কবি, বহু স্থান ও নেতা নেত্রীর সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পাঠককূলের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। এ সংকলনটি না হলে এ ধরনের বহু তথ্য সম্পর্কে পাঠককূল অজ্ঞাত থাকত।
(৩) বিস্তৃত আরবি শব্দভাণ্ডার রূপেঃ এই সংকলনে ৩৯০২টি বায়েত বা পঙক্তি রয়েছে। প্রত্যেকটি পঙক্তিতে কমপক্ষে পাঁচটি শব্দ রয়েছে। প্রাক-ইসলামী যুগ হতে আব্বাসী যুগ পর্যন্ত ব্যবহৃত এই বিপুল সংখ্যক শব্দ এই সংকলন ব্যতীত অন্য কোন পুস্তকে দেখা যায় না। এই দৃষ্টিকোন থেকে দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ সংকলনটি সত্যি প্রশংসাযোগ্য। স্পষ্ট ভাষায় এটি একটি বিস্তৃত আরবি শব্দভান্ডার।
তাই, আবু তাম্মাম হ়াবীব বিন্ আওস আত়্-ত়ায়ী কর্তৃক সংকলিত এই দীওয়ানুল্ হ়ামাসাহ্ গ্রন্থটি আরবি সাহিত্যের কাব্যজগতে একটি বিশেষতম সংকলন। সাহিত্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এ সংকলনের গুরুত্ব অপরিসিম। প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে আব্বাসী যুগ পর্যন্ত খ্যাতনামা কবিদের মূল্যবান নীতিকথা, চিন্তাচেতনামূলক ও সাহিত্যিক বৈশিষ্টসমৃদ্ধ কবিতাসমূহে পূর্ণ এই সংকলনটি। তাই অগ্রগতি ও উন্নতির এ যুগেও এই সংকলনটি বহু মাদ্রাসা, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
No comments:
Post a Comment