Friday 11 January 2019

জামেয়াতুল্ ইমাম আল্‌-বুখারিঃ একটি আদর্শ মাদ্‌রাসা



 জামেয়াতুল ইমাম আল-বুখারি 
 একটি আদর্শ মাদ্‌রাসা     
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

নব্বইয়ের দশক সমাপ্তির দোরগোড়ায়। আমি তখন কদমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের পাশাপাশি রোজ সকালে পাঞ্জাবি-পায়জামা প’রে যেতাম গ্রামের মকতবে। সেখানে আমাদের পড়ানো হতো আরবি। সেই সাথে শেখানো হতো সামাজিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার, ইসলামী আদব-কায়দা, নামায-কালাম ইত্যাদি। কিছুদিনের মধ্যে আমূল পরিবর্তন। ডানপিটে, গেছো ছেলেটি কেমন শান্ত স্বভাবের হয়ে গেল। এই দেখে অসিমুদ্দিন ও মহুবা খাতুন বুকে পাথর বেঁধে তাঁদের ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিল বাড়ি থেকে বহু দূরে কিশানগঞ্জে, জামিয়াতুল ইমাম আল-বুখারি’তে।  

ইমাম বুখারি মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত নাম। একটি বিপ্লব একটি আদর্শ। অনুপ্রেরণার একটি মাইল ফলকতাঁরই কর্ম-পদ্ধতিকে আদর্শ ক’রে গড়ে ওঠে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলা ও বিহারের মিলন-স্থানে। কিশানগঞ্জের খাগড়ায়, একটি পিছিয়ে পড়া মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায়, জ্বলে ওঠে জ্ঞানের এক প্রদীপ জামেয়াতুল্‌ ইমাম আল্‌-বুখারি নামে 

১৯৮৮ সালের মাঝামাঝিতে বাঁশের বেড়া ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি চার কামরার একটি আঙ্গিনায় অঙ্কুরিত হয় একটি কিশলয়। চারা গাছটি রোপণ করেন আব্দুল মাতিন; আমি না, তিনি আব্দুল মাতিন সালাফি। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে নিজ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার ব্রত নিয়ে শুরু করেন এই যাত্রা। আর তাঁর রোপিত এই চারাকে দিবারাত্রি জল সিঞ্চন করেছেন তাঁর সহকর্মী ও সহযাত্রী মুযাম্মিল-ইউসুফ-মুনিরুদ্দিন প্রমুখরা। 

এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত একটি ধর্ম-শিক্ষা নিকেতন। ইসলাম ধর্মের মৌল নীতিমালাগুলিকে সামনে রেখে প্রস্তুত করা হয়েছে এক অত্যন্ত বিশদ পাঠ্যক্রম। উলুম নাক্ব্‌লিয়া (যে শাস্ত্রগুলো বর্ণনা সূত্রের উপর নির্ভরশীল) ও আক্ব্‌লিয়া (যে শাস্ত্রগুলো বোধ ও প্রজ্ঞা সমন্বিত এবং উদ্ভাবনশৈলীর উপর নির্ভরশীল)-র প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজন-মাফিক সমন্বয় গড়ে উঠেছে সেই পাঠ্যক্রমে। এই প্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলে ইসলামের মূল ভিত্তি কুরআন ও হাদিসের। কুরআনের মর্মার্থ উপলব্ধি করার জন্য তাফসির সাহিত্যের। সেই মর্মার্থকে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যখ্যা করার জন্য উসুলুত্‌ তাফসির (তাফসির শাস্ত্রের ব্যাকরণ)-এর। হাদিস শাস্ত্রের পাশাপাশি শেখানো হয় হাদিসের বর্ণনাসূত্রের সত্যতা যাচাই করার ব্যাকরণ ও পদ্ধতি অর্থাৎ মুস্তালাহুল্‌ হাদিস এবং উসুলুল্‌ জার্‌হি ওয়াত্‌ তা'দিল।

ইসলামের প্রাত্যহিক নীতিমালা ও শরিয়তের বিধিনিষেধ শেখানোর জন্য পড়ানো হয় ফিক্‌হ শাস্ত্রপাঠদান চলে ফিক্‌হ শাস্ত্রের ব্যাকরণ অর্থাৎ উসুলুল্‌ ফিক্ব্‌হের। অর্থ-সম্পদ বণ্টনের নিয়ম কানুনও শেখানো হয় ইল্‌মুল্‌ ফারায়িয-এর পাঠদানের মাধ্যমে। বহু ছোটখাটো বিষয়ে মুসলিম জাতির মাঝে যে বিভেদ ও অনৈক্য রয়েছে সে সব বিষয়ে তুলনামূলক পাঠেরও ব্যবস্থা রয়েছে, ফিক্ব্‌হ মুক্বারিন নামে। যাতে বাস্তবের উপর দাঁড়িয়ে জাতির ঐক্য গঠন সম্ভব হয়। পড়ানো হয় সিরাত সাহিত্য ও ইসলামের ইতিহাস।

দেশ ও প্রদেশের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং সময়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে শেখানো হয় বেশ কয়েকটা ভাষা। শেখানো হয় আরবি ও ইংরেজির মতো সমৃদ্ধ ও বিদেশী ভাষা। শেখানো হয় বাংলা, হিন্দি এবং উর্দুও। এমনকি ফার্সি ভাষার প্রাথমিক পাঠও প্রদান করা হয় পড়ুয়াদের। এই প্রতিষ্ঠানেই আমি আরবি, উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার প্রাথমিক পাঠ লাভ করি। সেই সাথে আরবি সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাও।    

এসবের পাশাপাশি, এই প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হয় মাধ্যমিক পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার-এর মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমকে অনুসরণ করে। পাঠ্যক্রমে একটু আধটু রদবদল ক’রে পড়ানো হয় বাংলা ও হিন্দি। পড়ানো হয় মুঘল ও সুলতানি যুগের ইতিহাস। ভূগোলের বুনিয়াদি পাঠ। বিজ্ঞান ও গণিতের সূত্রগুলিও।

গনমানসের মনন ও চিন্তনকে প্রভাবিত করে, দিশা দেয়, সহজেই মানুষকে ভালো ও মন্দের পার্থক্য উপলব্ধি করায় একটা ভালো লেখা। ঠিক তেমনই একটি ভালো প্রাঞ্জল বক্তব্যও পারে শ্রোতার ভুল ধারণাগুলি দূর করতে। এজন্যই এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ আব্দুল মাতিন সালাফি সাহেব ও তাঁর সহযাত্রীরা দু'টি পৃথক সিস্টেমের প্রচলন করেন।

ছাত্রদের লিখন-শৈলীকে তীক্ষ্ণ ও সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে 'মাক্বালা' (প্রবন্ধ ও অভিসন্দর্ভ) লেখার প্রচলন করেন। প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম যেহেতু চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল, তাই প্রতিটি বিভাগের শেষ বছরের ছাত্রদের জন্য মাক্বালা লেখা আবশ্যিক করা হয়। সেই সব বর্ষের ছাত্ররা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে, তাঁদের তত্ত্বাবধানে সারা বছর ধরে নিজের সংক্ষিপ্ত থিসিসটিকে তত্ত্ব ও তথ্যে  সমৃদ্ধ করার প্রাণপণ প্রয়াস করে। এছাড়া প্রতিটি স্তরের ছাত্রদের জন্য পৃথক পৃথক বিষয়ে প্রবন্ধ রচনার বাৎসরিক প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়।

সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় যাতে মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে, সভা-অনুষ্ঠানে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে গুছিয়ে আলোচনা করতে পারে, বিতর্ক করতে পারে তার প্রশিক্ষণও ছাত্রদের দেওয়া হয়। সকল ছাত্রকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। সেই গ্রুপগুলির নামকরণ করা হয় বিভিন্ন মনীষাদের নামে। প্রতিটি গ্রুপের ছাত্রদেরকে আবার তিনটি টিমে ভাগ করা হয়। দু' সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিয়ে তৃতীয় সপ্তাহে প্রতিটি টিমের ছাত্রদের বক্তব্য দিতে হয়, তাঁদের পছন্দ মতো কোনো বিষয়ে। এভাবে তিন সপ্তাহে তিনটি টিমেরই ছাত্ররা একবার করে বক্তব্য দেয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় 'আঞ্জুমান'আর এই আঞ্জুমান অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বৃহস্পতিবারে। এছাড়া বক্তব্য প্রদানের বাৎসরিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। প্রতিটি স্তরের ছাত্রদের জন্য আলাদা ভাবে। বিষয় তাঁদের স্তর অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। সফল ও বিজয়ীদের পুরস্কারও দেওয়া হয়।

এসবের পাশাপাশি সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটি ছাত্রদের নানা ধরণের হাতের কাজ শেখাবার এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। সেই প্রতিষ্ঠানের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন একটি আই টি আই কলেজ। যেটি বর্তমানে বিহার সরকার কর্তৃক অনুমোদিত।

তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা এই কর্মযজ্ঞ শুধু ছেলেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। এই মহৎ উদ্দেশ্যে, এই শিক্ষাব্রতে মেয়েদেরও শামিল করেন। তাঁদের জন্য এসবকিছুই পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন একটি পৃথক ক্যাম্পাসে। আর সেই ক্যাম্পাসটির  নাম দেন, 'জামেয়াতু আয়েশা আল্‌-ইসলামিয়া’

স্বাস্থ্য-সচেতনতার বিষয়টিও তাঁদের নজরে ছিলআর তাই নানা ধরণের খেলাধুলা ও শরীর চর্চার প্রতি বেশ গুরুত্ব দেওয়া হতো এবং এখনো দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে পঠনপাঠন শুরু হওয়ার আগে বসে শরীর চর্চার আসর। পিটি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে চলে ব্যায়াম-দৌড়-কসরত ইত্যাদি। বিকেলে, আসরের নামাযের পর ছেলেরা মাঠে খেলাধুলা করে। কেউ ফুটবল। কেউ ক্রিকেট। কোথাও ভলিবল, তো কোথাও ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, বুড়িছোঁয়া ইত্যাদি। নানা মরসুমে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। কখনো ফুটবলের তো কখনো ক্রিকেটের। প্রতিবছর নিয়ম করে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। একশ মিটার, দু’শ মিটার, চারশ মিটার, আঠশ মিটার, ষোল শ মিটার দৌড়, দীর্ঘ লম্ফন, উচ্চ লম্ফন, লৌহবল নিক্ষেপ, ডিসকাস, হাড়ি ভাঙা ইত্যাদি ইভেন্ট থাকে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী ছাত্ররা জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে। ২০০১ সালে, আমি তখন সেই মাদ্‌রাসার ছাত্র, আমাদের মাদ্‌রাসার টিম দুটো ইভেন্টে বেশ ভালো ফল করেছিল। জেলা স্তরের টুর্নামেন্টে কাবাডিতে রানার্স এবং ভলিবলে উইনার হয়েছিল।

পরিবেশ ও সমাজের প্রতি একজন মানুষ হিসেবে আমাদের কী দায়িত্ব ও কর্তব্য, সে-সম্পর্কেও ছাত্রদের ধারণা দেওয়া হয়। সমাজকে শান্তিপূর্ণ এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে তুলতে কী করা উচিৎ এবং কী করা উচিৎ নয় তাও শেখানো হয় ছাত্রদের। সম্প্রতি ‘স্বচ্ছ ভারত’ এর আদলে ক্যাম্পাস ও তার চারপাশকে আবর্জনা মুক্ত করার কাজে হাত লাগায় প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক সকলে। বন্যা কবলিত ও অসহায় লোকেদের পাশে দাঁড়ানোর মন্ত্র তাঁরা বকলমে শেখে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান চেয়ারম্যান মতিউর রহমানের থেকে। গত বছরের ভয়ানক বন্যার সময় সবার সাথে চেয়ারম্যান নিজেই মাথায় করে চাল-ডাল-চিনি-চিড়া পীড়িতদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

প্রায় তিরিশ বছর ধরে এভাবেই দেশ ও দশের সেবা করে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এখানকার বহু ছাত্র দেশবিদেশে বিভিন্ন পেশায় সফল ভাবে সততার সাথে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এটি যেহেতু মাদ্‌রাসা, এখানে ধর্ম ও সাহিত্যের পাঠই মূল লক্ষ্য। তাই এখান থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বের হয়নি। তবে বহু সমাজসেবী, শিক্ষাব্রতী, প্রশাসক, গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক ও শিক্ষককে তৈরি করতে সফল হয়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। 

1 comment:

  1. আমার জীবনের এক স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয় উক্ত মাদ্রাসায়৷ আলহামদ্লিল্লাহ৷

    ReplyDelete