Sunday 6 January 2019

বুলান্দ আল্‌-হায়দারিঃ বামধারার এক প্রগতিশীল কবি

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

“আরও একটা শীত আসবে/ আর আমি, এখানেই পড়ে থাকব/ একাকী, প্রেমহীন, স্বপ্নবিহীন/ চারপাশে কোথাও থাকবে না কেউ/ কোনো নারীও না; তারপর—/ একদিন মৃত্যু হবে আমার/ হৃদয়ের তাপমাত্রাহীনতায়/ এখানে, এই উনুনের পাশে!” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে বাগদাদের কোনো এক মহল্লায় বসে একথাগুলো লিখেছিলেন হায়দারি। সে-সময়েই, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর এই চতুর্দশকেই আরবি কবিতায় আধুনিকতার শুরু। এ সময়ে হাজার বছরের নিরূপিত ছন্দের ধাঁচ ভেঙে মুক্ত ছন্দে লিখতে আরম্ভ করেন ইলিয়াস আবু শাবাকাহ্‌ (১৯০৩-১৯৪৭), নাযিক আল্‌-মালাইকা (১৯২৩-২০০৭), বাদ্‌র শাকির আস্‌-সাইয়াব (১৯২৬-১৯৬৪), আব্দুল ওয়াহাব আল্‌-বায়াতি (১৯২৬-১৯৯৯), নিযার ক্বাব্বানি (১৯২৩-১৯৯৮) প্রমুখরা। এই হারাকাতুশ্‌ শে’রিল্‌ হুর্‌রি (ফ্রি-ভার্স মুভমেন্ট)-তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যে-সকল কবি, আল্‌-হায়দারি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বুলান্দ আক্‌রাম আল্‌-হায়দারি। ১৯২৬-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর উত্তর ইরাকের এক সম্ভ্রান্ত কুর্দি পরিবারে তাঁর জন্ম। দশ বছর বয়সে পরিবারের সাথে চলে আসেন বাগদাদে। বাগদাদের অলি-গলিতেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরকাল। তিনি তখন খুব ছোট, ইরাক শাসন করছে ব্রিটিশ-সমর্থিত হাশিমি রাজবংশ, কুর্দিদের জন্য তাঁদের পার্লামেন্টে বরাদ্দ দু’টো সিট, তার একটিতে হায়দারির মামা দাউদ আল্‌-হায়দারি হাশিমি মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। হয়তো এ কারণেই শৈশবেই তাঁর মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল রাজনৈতিক সচেতনতার বীজ।
সমসাময়িক অন্যান্য তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের মতোই হায়দারিও যৌবনেই কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। উনিশ শতকের চারের দশকে হায়দারি যখন তরুণ কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন মান্‌সুরিয়ার সাহিত্যমঠগুলি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পদচারণায় থিকথিক করছিল। বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের মতোই আরব লেখকদেরকেও ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ অপেক্ষা সেক্যুলার ও বামধারার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা অধিক আকর্ষণ করেছিল। হয়তো এজন্যেই, ১৯৫৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুবাদে ১৯৬৮ সালে যখন সাদ্দামের বা’স পার্টি ক্ষমতায় আসল, হায়দারি তখন এই নব্য জাতীয়তাবাদী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এ কারণেই ইরাক-প্রশাসন তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশও দেয়। কিন্তু এক অদৃশ্য ইশারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পাঁচ মিনিট আগে তাঁকে প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়।
এ ঘটনার কিছুদিন পরেই হায়দারি চলে যান লেবানন। শুরু হয় তাঁর এক অনন্ত প্রবাসজীবন। লেবাননে তিনি প্রায় পনেরো বছর (১৯৬৩-১৯৭৭) ছিলেন। এ সময়ে সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘আল্‌-উলুম’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছেন নিজ সম্পাদনায়।
লেবাননে স্বেচ্ছা নির্বাসনের ক’বছর আগে, ১৯৫৩-তে দালাল আল্‌-মুফতি-কে বিয়ে করেছিলেন। এক পুত্র সন্তানের বাবাও হয়েছিলেন ক’বছর পরে। তাই শেকড়ের টানে ১৯৭৭ সালে আবার ফিরে আসেন ইরাকে। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি প্রাচ্যের এই শীরায-এ। ১৯৮০-র শুরুর দিকে আবারও পা বাড়ান প্রবাস জীবনের দিকে, তবে এবার লন্ডনে। এবং আমৃত্যু লন্ডনেই ছিলেন। এখানে ‘ফুনুনুল্‌ আরাবিয়া’ নামক একটি শিল্পবিষয়ক ম্যাগাজিনের সম্পাদনাও করতেন। পাশাপাশি, সৌদি আরবের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আল্‌-মাজাল্লাহ্‌’-তে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলামও লিখতেন। ১৯৯৬-র ৬ই আগস্ট মঙ্গলবারে, ৭০ বছর বয়সে লন্ডনের ব্রোম্পটন হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হায়দারি প্রথম জীবনে কুর্দি ভাষায় লিখতেন। আরবিতে লেখা শুরু করেন অনেক পরে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খাফাক্বাতুত্‌ ত্বিন’ (মৃত্তিকা-স্পন্দন) প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। সে-সময়েই আরবি কবিতায় আধুনিকতার শুরু। তাই তাঁকেও (মুক্ত ছন্দের) আধুনিক আরবি কবিতার একজন অগ্রপথিক গণ্য করা হয়। তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু জামাআতুল্‌ ওয়াক্ব্‌তিয্‌ যায়ে’ (দ্য লস্ট গ্রুপ) নামে একটি শিল্পসংঘ গঠনের মাধ্যমে। যার সদস্যরা মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ ও পশ্চিমের নতুন নতুন সাহিত্য আন্দোলনের সমন্বয়ে তৈরি আধুনিকতাবাদী চেতনার প্রতিনিধিত্ব করতেন।
হায়দারি কবি-জীবনের সূচনালগ্নে প্রভাবিত হয়েছিলেন ইলিয়াস আবু শাবাকাহ (১৯০৩-১৯৪৭) ও তাঁর সমকালীন কবিদের দ্বারা। তাঁরা ছিলেন মূলত রোমান্টিকদের মধ্যে কিছুটা প্রাগ্রসর চিন্তার। তাঁরাই কবিতায় প্রচলিত প্রথাগত এলিটিজমকে ভেঙে দিয়ে কবিতাকে জনতার কাতারে নিয়ে যাওয়ার সফল প্রয়াস করেছিলেন। হয়তো এজন্যেই আরবি কবিতায় আধুনিকতা ছিল একটি জীবনমুখী ও সমাজমুখী পদক্ষেপ।
হায়দারির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি সাহিত্য ও সমালোচক মহলকে চমকিত করে তোলে। সমালোচকরা একে আধার ও আধেয়—উভয় দিক থেকে একেবারে আলাদা ধরণের বলে মন্তব্য করেন। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘আগানিল মাদিনাতিল মাইতাহ্‌’ (মৃত শহরের গান, ১৯৫১), ‘জি’তুম মায়াল ফাজ্‌র’ (ভোর নিয়ে এলে তোমরা, ১৯৬১), ‘খুত্বুওয়াতুন ফিল্‌-গুরবাহ্‌’ (প্রবাসে পদচারণাবলী, ১৯৬৫), ‘রিহ্‌লাতুল্‌ হুরুফিস্‌ সুফ্‌র’ (হলুদ বর্ণের অভিযাত্রা, ১৯৬৮), ‘আগানিল্‌ হারিসিল্‌ মুত্‌আব’ (এক রণক্লান্ত যোদ্ধার গান, ১৯৭১), হেওয়ার আবারাল্‌ আব’আদ আস্‌-সালাসাহ্‌ (দূরবর্তী উপত্যকাত্রয়ীর গল্পকথা, ১৯৭২), ইলা বাইরুত মা’আ তাহিয়্যাতি (অভিবাদন সহ বেইরুতের পথে, ১৯৮৯), আব্‌ওয়াবুন্‌ ইলাল্‌ বায়তিয্‌ যীক্বি (এক সংকীর্ণ গৃহের দ্বারসমূহ, ১৯৯০), আখিরুদ্‌ দারবি (অন্তিম অভিপ্রয়াণ, ১৯৯৩)। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ দুরুবুন্‌ ফিল্‌-মান্‌ফা (প্রবাসে অভিপ্রয়াণ) প্রকাশিত হয় মৃত্যুর বছর, ১৯৯৬ সালে। মৃত্যুর চার বছর আগে, ১৯৯২ সালে, তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইসমূহ নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতাসমগ্র কায়রোর সুয়াদ আস্‌-সাবাহ প্রকাশনী থেকে।
ফ্রি ভার্স মুভমেন্ট ও আরবি কবিতার আধুনিকীকরণে হায়দারির অবদান অনস্বীকার্য। বহু আরব কবির মতোই তাঁর জীবনও রাজনীতি ও কবিতার এক যুগলযাপনের ইতিহাস। রাজনীতি তাঁর জন্মগত স্বভাব ছিল না। বরং জীবনের বাস্তবতা তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল রাজনীতির সম্মুখসমরে। এমনকি সাদ্দামবিরোধী ইত্তেহাদুদ্‌ দিমোক্বিরাত্বিয়ীন আল-ইরাক্বিয়ীন (ইরাকি গণতান্ত্রিক জোট)-এর সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। একজন মার্ক্সবাদী হওয়া সত্ত্বেও কবিতাকে কখনোই স্লোগান করে তোলেননি। বরং শিল্পকে শিল্পের জায়গায় রেখেই চিরকাল বিচার করেছেন; অনেক কমিউনিস্ট কবি যা করতে পারেননি।
তাঁর কবিতার মূল সুর ছিল বামপন্থী মানবতাবাদ। আর এক্ষেত্রে নাযিম হিক্‌মাত (তুরস্ক), পাবলো নেরুদা (চিলি), লুইস আরাগঁ ও পল এলুয়ার্দ (ফ্রান্স) এবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (স্পেন)-দের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হয়। এর পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল তাঁর কবিতার আর একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে মূলত তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের জীবন যাপনের হাল হকিকত। অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর জীবনের প্রতি করুণ আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাঁর কবিতায়। হয়তো তাই, তাঁর কবিতা একইসঙ্গে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী, গীতল ও রুক্ষ, শীতল ও রুদ্র। তাঁর কবিতা জীবন্ত রূপকসমূহের এক ঝর্ণাধারা। যা একেবারে সচিত্র। তিনি তাঁর কবিতায় প্রচলিত আড়ম্বরপূর্ণ কাব্যিক ভাষাকে এড়িয়ে গিয়ে সহজ-সরল ভাষায় অকপট ভঙ্গিতে ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে কাব্যরস সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন। স্বগতোক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে এক অভিনব ও সৃজনশীল কবিতা কাঠামোয় অনন্য দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপনও করেছেন তিনি। তাই তাঁর কবিতা আধুনিক আরবি কবিতার প্রধান সংকলনগুলোতে এবং কবিতা বিষয়ক গবেষণাপত্রগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। এবং তাঁর বহু কবিতা ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, কুর্দি, চীনা, তুর্কি, বাংলাসহ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তিনি আজীবন মানুষ ও মানবতার স্বপ্ন দেখেছেন। যদিও তাঁর স্বপ্ন দ্রুত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। জীবদ্দশায় কমিউনিজমকে সমাধিস্ত হতে দেখেছেন। পশ্চিমা আধুনিকতার করাল রূপ তাঁর চোখের সামনেই ভয়ানক হয়ে উঠেছে। দিনের শেষে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। রক্তাক্ত হয়েছে তাঁর কবি মন। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে সব কল্পনা, সব স্বপ্ন...! প্রবাস জীবনে একাকীত্বের বিষণ্ণ বিকেলে কোথাও নিভৃতে বসে এসব কথা তিনি ভাবতেন কি না তা আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। হয়তো ভাবতেন। হয়তো ভাবতেই চাইতেন না। হয়তো বা এ জীবনের সবকিছুকে ব্যর্থ মনে করতেন। আর ভাবতেন, আবার যদি নতুন করে শুরু হয় সব! আর তাই, তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘দুরূবুন্‌ ফিল্‌ মান্‌ফা’ (১৯৯৬)-এর শেষে ঝরে পড়ে তাঁর এই আকুতি— “ইস্‌! কী সুন্দর হতো, স্বপ্ন হয়ে ফের জন্ম নিলে/ সেই স্বপ্ন, যা আমাদের সাহায্য করবে ভুলে যেতে/ তীর ও ছিলার মাঝের যাবতীয় অপমানবোধ!” তাঁর মনের গহীনকে জারণ করত এক অদ্ভুত রকমের দ্বিধা। যে দ্বিধা শব্দের জামা পরেছে এভাবে— “কেটে গেছে বহু বছর/ চোখের সামনেই বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে অন্ধকার রাতগুলি/ তীব্রতর হয়েছে মেঘের পিপাসা/ এখন ফিরে যাব কার জন্য...!/ গ্রামের জন্য? না সেই ধারালো শীতের জন্য/ যার তীক্ষ্ণতায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল প্লাটফর্মটা?/ না সেই ছোট্ট দীপশিখার জন্য/ যার তোড়ে অবিরাম দুলছিল আমার দ্বেষী গ্রামটা?/ নাকি লজ্জা-অপমানে আত্মহত্যা করা নারীদের জন্য?/ না, আমি আর ফিরব না। কেন ফিরে যাব আমি? কার জন্য ফিরে যাব?” হয়তো তাই, আজীবন প্রবাসেই থেকেছেন তিনি!

[শব্দের মিছিল, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮-তে প্রকাশিত। 

No comments:

Post a Comment