ইম্রাউল্ ক়ায়েস-এর মু‘আল্লাক়া
[মু‘আল্লাক়া। অর্থ ঝুলন্ত। আরবি সাহিত্যের প্রাচীন কবিতার একটি মূল্যবান ও অনবদ্য কাব্য সংকলন। কাব্যিক বৈশিষ্ট ও সাহিত্যমানের বিচারেও বেশ সমাদৃত। এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, অশালীন শব্দ ও ভাব সম্বলিত হওয়া সত্ত্বেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বহু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যতালিকায় প্রণিধান হয়ে রয়েছে।
মু‘আল্লাক়া শব্দটির বহুবচন মু‘আল্লাক়াত। উৎপত্তি ‘আলাক়্ ধাতু হতে, যার অর্থ ঝুলিয়ে রাখা, আঁকড়ে ধরে রাখা। ঐতিহাসিক ইবনু ‘আব্দি রাব্বিহী আল্-‘ইক়্দুল্ ফ়ারীদ গ্রন্থে মু‘আল্লাক়া প্রসঙ্গে লিখেছেন— ৪৫০ খ্রিঃ হতে ৬২২ খ্রিঃ মধ্যবর্তী সময়ে সুপ্রসিদ্ধ ‘উকাজ়’ স্থানে প্রতি বছর আনন্দ মেলা বসত। ২০ দিনের এই মেলায় দ্রব্য-প্রদর্শনী, ঘোড়া-দৌড়, জুয়া খেলা, গান, নৃত্য ছাড়াও কবিতার আসর জমে উঠত। উকাজের এই মেলায় অনুষ্ঠিত কাব্য-প্রতিযোগিতায় যে কবিতগুলি শ্রেষ্ঠ ঘোষিত হত সেগুলিকে কা’বা শরীফের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হত; তাই এগুলিকে মু‘আল্লাক়াত (ঝুলন্ত কবিতা) বলা হয়। এগুলি স্বর্ণ-পানি দ্বারা লিখিত হত বলে এগুলিকে মুজ়াহ্হাবাত (স্বর্ণময়ী)-ও বল হয়। এই মতকে ইবনু রাশীক়্ ও ইবনু খ়ালদুনও সমর্থন করেছেন।
আরবির এই অনবদ্য কাব্য-সংকলনটি হ়াম্মাদ আর্-রাবিয়াহ্–এর দীর্ঘ সাধনার ফসল। উমাইয়াদের শেষ দিনগুলিতে ও আব্বাসীদের শুরুর দিনগুলিতে তিনি এই সংকলনটি সম্পন্ন করেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, মু‘আল্লাক়া কবি সাতজন—১) ইম্রাউল্ ক়ায়েস আল্-কিন্দী ২) ত়ারাফা বিন-‘আব্দ আল্-বাক্রী ৩) যুহাইর বিন-আবু সুলমা ৪) লাবীদ বিন-রাবি‘আহ আল্-‘আমেরী ৫) ‘আম্র বিন-কুলসুম ৬) ‘আন্তারা বিন-শাদ্দাদ ৭) হ়ারিস বিন-হ়িল্লাজ়া। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, আটটি; অতিরিক্তটির রচয়িতা হচ্ছেন, নাবিগ়াহ আজ়্-জ়ুব্ইয়ানী। একদল ঐতিহাসিক আবার মু‘আল্লাক়াতের সংখ্যা দশটি মনে করেন। তাঁরা উল্লেখিত আটটির সঙ্গে আ’শা ও ‘ওবাইদ বিন-আল্-আব্রাস-এর মু‘আল্লাক়া দুটিও যোগ করেছেন।
এই কবিতাগুলি অনারবীয় শব্দের অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত। তাছাড়া এই কবিতাগুলিতে ভাবের দূর্বোধ্যতার তেমন কোনো প্রকোপ পড়েনি। কৃত্রিমতা দুরস্ত। মরু পরিবেশের কথা অকৃত্রিম ও সুনিপুণ ভাবে ফুটে উঠেছে এই কবিতাগুলিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আরবি অভিধান মু‘আল্লাক়া সহ অন্যান্য জাহেলী অর্থাৎ প্রাক্ ইসলামি কবিতার আলোকে রচিত।]
(বন্ধু,) দাঁড়াও! আমি একটু কেঁদে নিই, দাখ়ূল ও হ়াওমাল[1]-এর মাঝে বালুর এই আঁকাবাঁকা টিলার শেষ প্রান্তে প্রেয়সী ও তার ধূলো মলিন আবাসভূমির স্মরণে।
(তাঁর আবাসভূমিটি দাখ়ূল ও হ়াওমাল এবং) তুজ়িহ়্ ও মিক়্রাত[2]-এর মধ্যখানে (অবস্থিত)। তা আজও টিকে আছে; পালাক্রমে উত্তুরে বাতাস আর দক্ষিণা বায়ুর পরশে তার অবশিষ্ট চিহ্নাবলী আজও ভেসে ওঠে।
(বন্ধু!) এখানে প্রেয়সীর আঙিনা জুড়ে এবং পার্শ্ববর্তী নালা-নর্দমায় তুমি দেখতে পাবে শ্বেত মৃগের বর্জ্য গোল মরিচের দানার ন্যায় যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
(আজও স্পষ্ট মনে পড়ে) সেদিন, বিরহের প্রত্যুষে প্রেয়সী ও তাঁর গোত্রের লোকেরা যখন যাত্রা আরম্ভ করেছিল; আমি তখন হান্জ়াল চূর্ণকারির ন্যায় গ্রামের বাবলা গাছের তলে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলাম।
(আমার কান্না দেখে) আমার বন্ধুরা আমার পাশে তাদের সওয়ারী থামিয়ে আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিল— তুমি কষ্টের তীব্রতায় নিজেকে এভাবে তিল তিল করে শেষ করে দিও না।
(আর আমি উত্তরে তাদেরকে বলেছিলাম) শোনো, অশ্রুই আমার যাতনাসমূহের নিরাময়। আমার প্রশান্তি। অন্যথা, নিশ্চিহ্ন প্রায় এই নিদর্শনগুলির কাছে কান্নার কী বা যৌক্তিকতা আছে? জনমানবহীন এই মরুভূমিতে কেঁদে আমার কী বা লাভ হবে?!
(তারপর আমি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে,) মন আমার শোনো, এবার উনাইজ়ার সাথে তুমি ঠিক তেমনই আচরণ করো, যেমনটা করেছিলে মা’সাল পর্বতের উম্মুল্ হ়ুয়াইরিস ও উম্মুর্ রুবাবের সাথে।
তাঁরা দু’জনেই ছিল অপরূপ সুন্দরী। যখন তাঁরা দাঁড়াতো, তাদের দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হতো লবঙ্গ মিশ্রিত পুবালি বাতাসের কস্তুরী সুবাস।
আর তাই তাদের বিরহে অবিরাম অশ্রু ঝরাত আমার দু’ নয়ন। সেই অশ্রুজলে ভেসে যেতো আমার বুক। ভিজে যেত কোমরে ঝোলানো আমার অসিবন্ধনি।
(মন আমার) স্মরণ করো আনন্দঘন সেই দিনগুলির কথা, যেগুলি তুমি অতিবাহিত করেছো প্রেমিকাদের সাথে; বিশেষ করে দারাতুল্ জুল্জুল্ সরোবরের ধারে আনন্দ উল্লাসের মাঝে কাটানো দিনটির কথা।
সেদিন আমি তাদের জন্য জবাই করেছিলাম আমার একমাত্র সম্বল, আমার উটটিকে। আহ্, কি অপরূপ ছিল সেদিনের উটের পীঠে উত্তোলিত সেই হাওদাটি[3]!
উনাইজ়া ও তার সখীরা সেদিন মেতে উঠেছিল সেই উটের মাংস ও চর্বি নিয়ে নানা রকম ক্রীড়াকৌতুকে। তারা একে অপরের দিকে ছুঁড়ছিল, কেউ চর্বি তো কেউ মাংস। আর ওই উটের চর্বিগুলো ছিল রেশমের তৈরী ঝালরের মতো।
অতঃপর (ফেরার সময়) আমি যখন উনাইজ়ার হাওদায় ঢুকলাম, সে বলে উঠলো— “হতভাগা, তোমার সর্বনাশ হোক! দূর হটো তুমি। তুমি যা শুরু করেছো, এবার হয়তো আমরা দু’জনেই পায়ে হাঁটতে বাধ্য হবো।
আর যখন আমাদের দু’জনের ভারে কাজাওয়াটা এক দিকে ঝুঁকে গেল, উনাইজ়া বলে উঠলো— “ইম্রাউল ক়ায়েস, আর নয়। এবার তুমি নেমে পড়ো! তা নাহলে, অধিক ভারে আমার উটটা মারা যাবে।”
আমি তখন উনাইজ়াকে বললাম— “তুমি উটের লাগাম ছেড়ে দাও। উট যে দিকে যায় যাক! তুমি আমাকে সাথে নিয়ে চলতে থাকো। আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। বঞ্চিত করো না তোমার হাতের কোমল ছোঁয়া ও ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ থেকে।
আর হ্যাঁ, (আমাকে বেশি ভাব দেখিয়ো না) তোমার মত সুন্দরী অনেক এসেছে আমার জীবনে; আবার চলেও গেছে। বহু গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী যুবতী আমার প্রেমে বুঁদ হয়েছিল। আমার স্পর্শ তাদের উতলা করে তুলতো। আমাকে পেয়ে তারা ভুলে যেতো তাদের এক বছরের মাদুলি পরিহিত ছেলের কথা।
তবে ছেলেটি যখন তার পেছন দিকে ক্ষুধার জ্বালায় কেঁদে উঠতো, তখন ওই যুবতী তার বুক বাড়িয়ে দিত নিজ ছেলের দিকে। আর দু’পা ও কোমর দিয়ে জড়িয়ে থাকতো আমায়। মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে দিত না।
(আমার সেদিনের কথাও খুব মনে পড়ে,) যেদিন বালুময় উপত্যকার মাঝে উনাইজ়া অভিমান করে আমায় বলেছিল— “আজ থেকে তোমার সাথে আড়ি। আজ এই মুহূর্তে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন তোমার সাথে কথা বলবো না।”
আমিও তখন তাঁকে বলেছিলাম— ফাত়িমা[4] এমন ছলনায় আর ডুবে থেকো না। যদি তুমি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো, তা স্পষ্ট করে আমায় বলো।
আর হ্যাঁ, আমার বাহ্যিক অবস্থা দেখে তুমি নিজেকে প্রতারিত করো না। তুমি মনে করো না যে, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো; আমি তোমার ভালোবাসায় প্রাণ দিয়ে দেবো।
তবে হ্যাঁ, যদি আমার কোনো আচরণে তুমি আঘাত পেয়ে থাকো, তাহলে ধীরে ধীরে আমার আলোয়ান থেকে তোমার আলোয়ান পৃথক করে নাও। তারপর তুমি তোমার পথে; আর আমি আমার পথে।
আর হ্যাঁ, (অতীতের কথা স্মরণ করে) তুমি কান্নাকাটি করো না। কারণ, তোমার দীঘল আঁখিদ্বয় হতে নির্গত প্রতিটা অশ্রু ফোঁটা তীরের ফলার মতো এসে বিঁধে আমার এই ভগ্ন হৃদয়ে। আর আমার হৃদয় ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়।
আরও এক যুবতী (আমার প্রেমে বুঁদ) ছিল (ফাত়িমা, তুমি জানো সে-কথা)। সে ছিল উট পাখির ডিমের মতো শুভ্র বর্ণের। তারই মতো সুরক্ষিত। ওই যুবতীর তাঁবুর ধারে ঘেঁষার দুঃসাহসও কারও ছিল না। কিন্তু আমি (সঙ্গমের তাড়নায় দুঃসাহসের পর্বত পেরিয়ে) তার সাথে দেখা করেছি। অতঃপর আমরা দু’জনে দীর্ঘক্ষণ প্রেম-লীলায় মত্ত থেকেছি।
একলা দেখা পেলেই মেরে ফেলার হুকুম ছিল আমার তরে। তাই তারা সবাই মুখিয়ে ছিল আমার প্রতি। অমন সজাগ ও সতর্ক অসংখ্য চোখ ও প্রহরীদের এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ডিঙিয়ে আমি তার কাছে পৌঁছেছিলাম।
আমি যখন তার কাছে পৌঁছোলাম, তখন রাতের আকাশে সপ্তর্ষি ঝলমল করছিলো;
যেমন করে রত্নখচিত ঘাঘরার ঝালর ঝলমল করে।
আমি যখন তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলাম, সে পরিধেয় কাপড়চোপড় ছেড়ে শুধুমাত্র শয়ন বস্ত্রে পর্দার ওপারে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
অথচ আমাকে দেখে বলে উঠলো— “আমি শপথ করে বলতে পারি, তোমার প্রেমান্ধতা কখনো ঘুচবে না। আর তোমাকে আটকাবে, সে ক্ষমতাও কারও নেই।”
তারপর, আমি তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা হাঁটছিলাম সমান তালে পায়ে পা মিলিয়ে। আর সে চিত্রাঙ্কিত পশমী চাদরের আঁচল দিয়ে আমাদের পদচিহ্ন মিটিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা গ্রামের আঙ্গিনা পেরিয়ে উঁচু উঁচু বালির স্তূপে ভরা এক নিম্ন ভূমির মাঝামাঝি পৌঁছোলাম। সেখানে চারিদিকে কোথাও কেউ ছিল না; পরিবেশ একেবারে নীরব ও শান্ত।
সেখানে দাঁড়িয়ে আমি তার চুলের বেনী ধরে আলতো করে একটা টান দিলাম। আর সে তৎক্ষণাৎ ক্ষীণ কটিদেশ, চিকন কোমর ও পুষ্ট পায়ের গোড়ালি সমেত আমার গায়ে হেলে পড়লো।
আমি লক্ষ্য করলাম, তার কোমর পাতলা এবং মানানসই। গায়ের রং ফর্সা। শারীরিক গঠনও স্বাভাবিক। আর বক্ষদেশ আয়নার মতো মসৃণ ও ঝকঝকে।
যেন শ্বেত-হলুদ মিশ্রিত মুক্তো অথবা উট পাখির ডিম; যাকে একটু আগেই স্বচ্ছ-সুবিমল জল দ্বারা ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে থাকলাম। তারপর হঠাৎ অভিমান করে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তখন আমি তার প্রশস্ত গণ্ডদেশে মৃদু আলোর স্পর্শ দেখতে পেলাম। তারপর সে ওয়াজরা বনের শাবকবতী বন্য গাভীর মতো মায়াবী চোখে আমার দিকে তাকালো।
যখন সে (আমার দিকে) গ্রীবা উঁচু করে তাকালো আমি দেখতে পেলাম, তার গ্রীবা শ্বেত মৃগের গ্রীবার মতো সুন্দর। তবে হরিণীর গ্রীবার মতো অলংকার ও ভূষণ হীন নয়। বরং জুতসই নানা আভরণে সজ্জিত।
(আরও দেখতে পেলাম,) তার ধবধবে সাদা পীঠ জুড়ে আলম্বিত কেশরাশি; যা ভারে অবনত খেজুর কাঁদির ন্যায় ঘন এবং কয়লার মতো মিশমিশে কালো। আর তাতে তার সৌন্দর্য যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে।
এবং তার মাথা ভর্তি চুল। মাঝে মাঝে যখন সে গোঁড়া পর্যন্ত বেণী করে চুলগুলোকে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখে, তখন তার খোপা-বাঁধা এবং খোলা চুলে কোথাও সেই ফিতার দেখা পাওয়া যায় না।
(দেখতে পেলাম,) তার কোমর লিকলিকে পাতলা। উটের লাগামের মতো মসৃণ। আর তার পদযুগল জলজ নলখাগড়ার মতো সিক্ত ও কোমল।
তাছাড়া, যখন সে (আমার কাছ থেকে) কোনো কিছু গ্রহণ করতো আমি তার আঙুলের স্পর্শ পেতাম; বুঝতে পারতাম তার আঙুলগুলো জাবি উপত্যকার কেঁচো অথবা ইস্হাল গাছের দাঁতনের মতো কোমল ও মসৃণ।
সে রাতের ঘন অন্ধকারকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিতো। তার মুখমণ্ডল ছিল উজ্জ্বল ও দীপ্তিময়; যেন সংসার ত্যাগী কোনো খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীর সন্ধ্যা বাতি।
তার অভ্যাস ছিল, সে বেলা করে ঘুম থেকে উঠত। আর তখন তার বিছানায় ছড়িয়ে থাকতো মেশক রেণু। এবং রাতের বেলা সে নিজ গাউনের ফিতা বাঁধতো না।
(সে ছিল চিরকালীন লাবণ্যময়ী এক নারী) যখন সে নানা আভরণ ও অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে কামিজ পরিহিতা নারী এবং ফ্রক পরিহিতা বালিকাদের মাঝে দাঁড়াতো তখন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমান ব্যাক্তিরও মতিভ্রম ঘটতো এবং সে তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকতো।
(শোনো উনাইজ়া) যৌবন অতিক্রম হওয়ার পর অনেকের প্রেমান্ধতা দূর হয়েছে। কিন্তু আমার হৃদয় থেকে তোমার প্রেম কখনই পৃথক হবে না।
(তুমি জানো) আমি তোমার জন্য আমার অনেক হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের ত্যাগ করেছি। তাদের তীব্র বিরোধ, নিন্দা ও তিরস্কারকে অবলীলায় সহ্য করেছি। তারপরেও আমার প্রতি তোমার এত অনীহা কেন?
(তুমি জানো!) সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার মতো ভয়ঙ্কর রাতগুলো আমার ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্য নানাবিধ বিপদে ভরা অন্ধকারের এক দীর্ঘ পর্দা বিস্তৃত করেছিলো আমার অস্তিত্বের ললাটে (তবুও আমি ঘাবড়ে যাইনি)।
বরং রাত যখন আড়মোড়া ভেঙ্গে, নিজ মেরুদণ্ডকে প্রসারিত করে, বুককে ভেতরে টেনে নিতম্ব বিস্তৃত করেছিলো, তখন আমি তাকে বলেছিলাম—
হে দীর্ঘ রজনী, তুমি ঊষার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠো! কিন্তু, প্রভাতের আলো ফুটলে আমার এমন কী বা লাভ হবে ?!
হায় রে, এ রাত কত দীর্ঘ! যেন নাইলনের অসংখ্য রশি দিয়ে রাতের আকশের তারাগুলোকে বড় বড় পাহাড়ি পাথরের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে; (আর তাই এই তারাগুলো অস্ত যাচ্ছে না আর রাতেরও অবসান হচ্ছে না!)
(উনাইজ়া তুমি হয়তো জানোই না যে, শুধু তোমার জন্য) আমি আমার এই ভ্রমনে অভ্যস্ত ও বিনীত কাঁধে অনেক মানুষের মশকের দড়ি (অর্থাৎ মশক) বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি (এই ভেবে যে ওরা তোমার পরিচিত জন, আর তাতে তুমি খুশী হবে)।
এবং (শুধু তোমার জন্য) গাধার পেটের মতো এক বিরাট জনশূন্য প্রান্তর একা অতিক্রম করেছি। সেখানে (আমাকে একলা পেয়ে) এক ক্ষুধার্ত নেকড়ে চিৎকার করছিলো যেমন করে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকর্তা জুয়ায় হেরে গিয়ে চিৎকার করে।
তারপর (আমরা যখন মুখোমুখি দাঁড়ালাম) সে চিৎকার করে উঠলো, তখন আমি তাকে বললাম— আমাদের দু’জনের অবস্থা একই রকম। আমি স্বল্প বিত্তবান; আর তুমি এখনো সম্পদের মালিক হওনি।
তাছাড়া, আমরা দু’জনেই যখনই কোনো কিছু অর্জন করি মুহূর্তেই তা খরচ করে ফেলি (অর্থাৎ হারিয়ে ফেলি)। আর তাই যারাই ভবিষ্যতে তোমার ও আমার মতো করে উপার্জন করবে, তারা (নিশ্চিত অভাবগ্রস্থ হয়ে পড়বে এবং তার ফলে) জরাজীর্ণ ও শীর্ণকায় হয়ে যাবে।
(উনাইজ়া তুমি কি আমাকে অকর্মা বা কাপুরুষ ভাবছো! তাহলে শোনো) আমি প্রত্যুষে স্বল্প লোমের হৃষ্ট-পোষ্ট এক শিকারি ঘোড়ায় চেপে (শিকারে) বের হই; আর পাখিরা তখনও তাদের নীড়ে ঘুমিয়ে থাকে ।
আমার ওই ঘোড়াটি খুবই চতুর ও চপল। নিমেষেই আক্রমণ, পলায়ন, অগ্রগমন ও পশ্চাত্গমন করতে পারে। পাহাড়ি ঢলের অবারিত পাথরের মতো দ্রুতগামী।
আমার ওই ঘোড়াটি রক্তিম বর্ণীয়। তার কলিজা-সদৃশ মসৃন ও তৈলাক্ত পীঠ থেকে ঘর্ম চোষক গদিটা খসে পড়ে যেমন ভাবে প্রবল বর্ষণে মসৃণ পাথর পিছলে পড়ে।
হাজার ক্লান্তি সত্ত্বেও সে সর্বদা প্রাণবন্ত থাকে। আর যখন তার উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়, তার হ্রেষা ধ্বনি ভাত উতলানো হাড়ির টগবগে ফুটন্ত পানির মতো আওয়াজ করে।
অন্য ঘোড়াগুলো যখন ক্লান্তির কারণে রুক্ষ মাটিতে বারবার পদাঘাত করে ধুলো ওড়ায়, আমার ঘোড়াটি তখনও তীব্র বর্ষণের তীক্ষ্ণ বৃষ্টিবিন্দুর ন্যায় দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে।
(সে এতই ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে যে,) অনভিজ্ঞ ও শীর্ণদেহী আরোহী তার পীঠ থেকে ছিটকে পড়ে যায়। আর অভিজ্ঞ ও সুঠামদেহী আরোহীর পরিধেয় বস্ত্রাদি বাতাসের আলিঙ্গনে প্রায় উন্মুক্ত হয়ে যায়।
আমার ওই ঘোড়াটি চক্রাকারেও বেশ দ্রুতগামী। যেন কোনো বালকের লাটিম, যে লাটিমটি একটি মসৃণ ও পাকানো সুতোর সাহায্যে বালকের হাতের দ্রুত সঞ্চালনায় ক্ষিপ্র গতিতে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
আমার ওই ঘোড়াটির কোমর হরিণের মতো চিকন। তার পা দু’টো উটপাখির মতো সোজা। স্বভাবতই সে নেকড়ের মতো ক্ষীপ্র এবং শিয়াল শাবকের মতো দুরন্ত ও নিঃশব্দ পদচারণকারী।
আমার ওই ঘোড়াটি বেশ শক্তপোক্ত ও সুঠাম দেহের। তুমি যখন তাকে পেছন থেকে দেখবে, দেখতে পাবে এক সরলাকৃতির মাটি ছুঁইছুঁই লেজে তার পশ্চাদাংশ সম্পূর্ণ রূপে ঢেকে গেছে।
(আমার ওই অশ্বের) পাশে দাঁড়ালে মনে হবে, তার পীঠ যেন কনে সাজানোর জন্য ব্যবহৃত সুগন্ধি তৈরীর শিলাপাথর কিংবা হানযাল চূর্ণ করার পাটা।
আরও মনে হবে, তার বুকের মধ্যখানে যেন লেগে আছে অগ্রগামী বন্য গরুর রক্তাভ রং বা চিরুনী করা শ্বেত লোমে মেহেদীর নির্যাস।
অতঃপর সেখানে আমাদের সম্মুখে ছিল একপাল গরু। আর ওই পালের নীল গাইগুলো ছিল কুমারী নারীর মতো। দেখে মনে হচ্ছিলো, তারা যেন আঁচল বিশিষ্ট চাদর পরে দোয়া প্রতিমার চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে।
তারা ছুটে চলেছিল। পেছন থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো, সাদাকালো ইয়েমেনি মোহর দুলছে এবং তার উপর অন্যান্য মুক্তো ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। আরও মনে হচ্ছিল, মোহরটি যেন কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের বালকের গলায় শোভা পাচ্ছে।
ঘোড়াটি আমাদেরকে সাথে নিয়ে দ্রুত বন্য গরুর পালে মিশে গেলো। আর তখনও পেছনে পড়ে থাকা গরুগুলো দলবদ্ধই ছিল; বিক্ষিপ্ত হওয়ার সময়টুকুও পায়নি তারা।
তার পরস্পর ও লাগাতার আক্রমণে একটি গাভী ও একটি ষাঁড় কুপোকাত হয়ে গেলো। অথচ সে বিন্দু মাত্রও ঘামেনি। আর তাই তাকে স্নান করাবার কোনো প্রয়োজনই হল না।
অতঃপর রাঁধুনিরা দু’দলে সারিবদ্ধ হয়ে বসে গেলো। একটা দল মাংস আগুনে সেঁকে কাবাব বানাতে লাগলো। আর অপর দল উনুনে মাংসের হাড়ি চাপিয়ে চলার তলায় তড়িঘড়ি আগুন দিতে লাগলো।
তারপর, সন্ধ্যাবেলা যখন আমরা ফিরলাম, তার ক্ষিপ্রতার প্রতি দৃষ্টি রাখা ছিল দুষ্কর। তার দিকে চোখ ওঠালেই নিমেষেই সে চোখ নীচে নেমে আসছিল।
আমার ঘোড়াটা সারা রাত লাগাম ও গদি সহ দাঁড়িয়ে থাকলো। সারা রাত তার ঘাস ও জলের একটুও প্রয়োজন হয়নি। আমার চোখের সামনেই সে দাঁড়িয়ে থাকলো; এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যায়নি।
আচ্ছা তুমি কি কখনো বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে ওঠা আকাশ দেখেছো? এসো, আমি তোমায় দেখিয়ে দিই, ঘোড়ার সামনের পা দু’টো বিস্তৃত মেঘমালায় উজ্জ্বল বিজলীর মতো।
সেই বিদ্যুতের আলো ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। তার উজ্জ্বলতা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। যেন কোনো খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর জ্বলন্ত প্রদীপ, যা উন্নত তেলের স্পর্শে সব কিছুকে আলোকিত করে তোলে।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর, দ়ারিজ ও উজ়ায়েব[5]-এর মধ্যবর্তী জায়গায় বন্ধুদের নিয়ে আসন পেতে বসলাম।
সেই জায়গাটি ছিল লালচে মেঘের খেলায় মত্ত হওয়ার জায়গা। তার ঠিক ডান দিকে ছিল ক়াতান[6] পর্বত আর বাঁ দিকে ছিল সাতার ও ইয়াজ়বুল[7] পর্বতদ্বয়।
সেখানে অঝোরে বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো। আর বর্ষণের তীব্রতায় কুতাইফাহ[8] উপত্যকা প্লাবিত হয়ে উঠেছিল। এবং সেখানে কানাহবাল[9] বৃক্ষগুলো অধোমুখী হয়ে পড়ে ছিল।
কিনান[10] পর্বতের উপরেও বর্ষণের খানিকটা তীব্রতা আছড়ে পড়েছিল। ফলে বন্য ছাগলগুলো পর্বত পৃষ্ঠ হতে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলো।
সেই তীব্র বর্ষণে তাইমা[11] অঞ্চলের খেজুর বাগান ও পর্ণকুটিরগুলো ধূলিসাৎ হয়ে গেছিলো। সেখানে টিকে ছিল শুধু মাত্র পাথর নির্মিত অট্টালিকাগুলো।
আর মক্কার নিকটবর্তী সাবীর[12] পাহাড়কে বর্ষণের শুরু থেকেই ডোরাকাটা চাদরে আবৃত ধনী ব্যক্তির মতো লাগছিল।
আর প্রবল বর্ষণের সকালে মুজায়মির[13] পর্বতের শৃঙ্গ গুলোকে সুতাকাটার চরকার লৌহদণ্ডের মুখে লেগে থাকা গোল কাঠ বা চামড়ার টুকরোর মতো আবর্জনা সিক্ত দেখাচ্ছিল।
অতঃপর গাবীতের[14] বিশাল মাঠে মেঘমালা ঢেলে দিয়েছিল তাদের সকল সামগ্রী; যেমন করে ইয়ামেনের কাপড়-ব্যবসায়ীরা মালবাহী উটের পীঠ থেকে কাপড়ের বোঝা বাজারের বুকে নামিয়ে দেয়।
আর জিওয়া[15] বনে ধবধবে সাদা মুকা[16] পাখির দল বাদল দিনের প্রত্যুষে গোল মরিচ মেশানো পুরনো মদিরা পান করে মাতাল হয়ে উঠেছিলো।
আর হিংস্র প্রাণীর দল সন্ধ্যার আলো মেখে উপত্যকার নানা প্রান্তে অবাধ বিচরণ করছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো, তারা যেন এক-একটা বন্য পেঁয়াজের শেকড়।
[1] তৎকালীন আরবের দুটো গ্রামের নাম। অনেকের মতে দুটো পর্বত ও সেই পর্বতদ্বয়ের পাদদেশে অবস্থিত দুটি গ্রামের নাম।
[2] এ দুটোও গ্রামের নাম
[3] উটের পীঠের
উপর স্থাপিত
পাল্কির ন্যায়
বসার স্থান
[4] উনাইজ়াকে কবি এ নামেই ডাকতেন।
[5] দুটো জায়গার
নাম
[6] প্রাচীন আরবের
একটি পাহাড়
[7] এ দুটোও পাহাড়ের নাম
[8] আরবের একটা
জায়গার নাম
[9] এক প্রকার
প্রকাণ্ড বৃক্ষ
[10] তৎকালীন আসাদ
গোত্রের মালিকানাধীন
একটি পাহাড়
[11] আসাদ গোত্রীয়
গ্রাম
[12] প্রাচীন মক্কা
অঞ্চলের একটি
পাহাড়
[13] আরব্য অঞ্চলের
একটি পর্বত
[14] আরবের একটি
বিশাল মাঠ
[15] প্রাচীন আরবের
একটি জঙ্গল
[16] সাদা
রংয়ের এক প্রকারের
পাখি, যারা খুব বেশি চি চি করে।
No comments:
Post a Comment