Thursday 2 May 2019

বদিউর রহমানঃ আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান!


সিগারেট খাওয়া শুরু হয়েছিল টান টান উত্তেজনা আর কৌতুহলবশতঃ। ছোটবেলার এক সঙ্গী বলল “একরকম সিগারেট আছে, খাবি? গলাটা দেখবি কী রকম ঠাণ্ডা লাগে!” আরও দু’জন সঙ্গী জুটে গেল। চারখানা কুল (Cool) সিগারেট অতি সন্তর্পনে কিনে আনল প্রথম উদ্যোগীসিগারেট তো জোগাড় হ’ল; কিন্তু খাওয়া যায় কোথায়? আমরা তখন বেশ ছোট। ঐগুলো খাওয়ার জায়গা নির্ণয় করা নিয়ে একটা আলোচনা হল। বুদ্ধিদীপ্ত এক সঙ্গী মতামত দিল মৌলানা চিস্তি সাহেবের[1] ঘেরা বাড়িটির পিছনের জঙ্গলে আমগাছ তলাটা বেশ উপযুক্ত জায়গা। ওদিকটায় সচরাচর কেউ যায়না। অতএব বড়দের নজর এড়িয়ে নিশ্চিন্তে সিগারেট টানা যাবে। সকলে তার বুদ্ধির তারিফ করে সেখানে গিয়ে চারজনে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটের প্রথম টানেই সত্যি সত্যি গলায় এক ধরনের ঠাণ্ডা ভাব অনুভব করলাম। উত্তেজনাবশত তাড়াহুড়ো করে ঘন ঘন টান দিলে বেজায় কাশি শুরু হয়। সেই বুদ্ধিমান বন্ধুটি উপদেশ দিল একটা টান দেওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার টান দিতে। সেভাবেই শেষ হল জীবনের প্রথম কুল (Cool) সিগারেটটা। তারপর সেই বন্ধুটি পকেট থেকে বের করল লবঙ্গ। একটা লবঙ্গ দিয়ে বলল “এটা মুখে রাখ, তা হলে সিগারেট খেলে মুখে যে গন্ধটা হয় সেটা চলে যাবে। বড়রা আর টের পাবে না”।
কয়েকদিন পর সেই বুদ্ধিমান বন্ধু বলল ‘আর এক রকমের সিগারেট আছে, যেটা ধরালেই খুব সুন্দর এবং মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়’। ঠিক হল সেটাও একবার পরীক্ষা করা হবে। একদিন বিকেলের দিকে সেই সঙ্গীটি বলল, সে কথামত সুগন্ধ সিগারেট এনেছে। আবার শলা-পরামর্শ হল একটা নিভৃত-নিরালা জায়গা সন্ধানের; যেখানে বড়দের চোখ এড়িয়ে নিশ্চিন্তে সিগারেটগুলো খাওয়া যাবে। ঠিক হল– জি. টি. রোড ধরে পশ্চিম দিকে ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ি পার হয়ে মাঠের মধ্যে একটা আমগাছে চড়ে সিগারেট খাওয়া হবে। মানুষজন সাধারণত গাছের উপরের দিকে তাকান না তাই কারও নজরে পড়ার ভয়ও নেই। একে একে চারজনে একটা ছোট আমগাছের ডালে চড়ে ব’সে ধরানো হল সিগারেট। সত্যি বলছি ঐ সিগারেট ধরানোর সাথে সাথে চারিদিকে এক সুগন্ধ ম ম করে ছড়িয়ে পড়ল। যতদূর মনে পড়ে, সেগুলো ছিল মার্কো পোলো সিগারেট। দেখতে ধূসর চকোলেট রঙের।
কিছুদিন পরে সিগারেট খাওয়ার ঐ রকম অভিযান আরও একবার হয়েছিল। এবার জায়গা ঠিক হল থৈপাড়া যাওয়ার ডি.ভি.সি. ক্যানেলের ব্রিজের নীচে। ব্রিজের বেস্‌মেন্ট, যার উপর ভর করে ক্যানেলের উত্তর-দক্ষিণে ব্রিজটা ঝুলে আছে– সেই বেস্‌মেন্টটার মাটি ধ্বসে না যায় তার জন্য নীচ থেকে ভাল করে পাকা গাঁথুনি করা। সেগুলোকে আবার ধনুকের মত বেড়ি দিয়ে রয়েছে পুব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার মত চারপাঁচ ফুট চওড়া ফুটপাত। ব্রিজের উপর থেকে নীচের ওই ফুটপাতে সাধারণতঃ কারও দৃষ্টি পড়ার কথা নয়। তাই ঠিক হল ওই জায়গাটায় সিগারেট খাওয়া হবে। এবারকার সিগারেট ছিল ‘চার মিনার’। একটা টান দিতেই কী কাশি! ওরা বলল ঐ ব্রাণ্ডটা সব থেকে কড়া। যে মানুষজন বুদ্ধির কাজ করে, মাথা ঘামায় তাঁরা ওটা পছন্দ করেন। একজন আবার টিপ্পনি কেটে বলল ‘বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া না দিলে ওঁদের মাথা খোলে না
এইভাবে কালে-কস্মিনে চলেছিল ধূমপান। কিন্তু আমরা কেউই ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম না। অনেকদিন পর আবার একবার চারমিনার সিগারেট খেতে দিল আমার দাদার এক সহপাঠী – রহমানদা। ঘটনাক্রমটা একটু বলি।
অনেকসময় মৃত ব্যক্তির রুহের শান্তি ও জান্নাত নসিবের উদ্দেশে অনেকে মিলে কোরআন পাঠ ক’রে দোওয়া করা হয়। তাই অনেকেই মাদ্রাসার ছাত্রদের ঐ ক্রিয়াকর্মে ডাকেন। যেমন সদলবলে গিয়েছিলাম পাণ্ডুয়া ষ্টেশন রোডে চাঁদ মিঞার স্ত্রী-বিয়োগের সময়আর এবার ছিল কলবাজারের গেনিভাইয়ের[2] মৃত্যু উপলক্ষে কোরআন-খানিতে। গেনি ভাই ছিলেন আমাদের আত্মীয়। আমাদের বাড়িতে তাঁর মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসিক মানুষতাঁর কথাবার্তায় আমি ও আমাদের বাড়ির সকলে খুব আনন্দ পেতাম। চল্লিশোর্ধ বয়সে হার্ট অ্যাটাকে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। আমি তখন ছোট হলেও বেশ ব্যথিত হয়েছিলাম। তাই তাঁর আত্মার শান্তির জন্য মনেপ্রাণে কোরআন শরীফ পাঠ করছিলাম তাঁর বাড়িতে। দীর্ঘক্ষণ সেখান থেকে উঠিনি। যখন বেশ ক্লান্ত হয়ে সেখান থেকে উঠেছি রহমানভাই[3] আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর নিজের কামরায় বসালেনটেবিলের ড্রয়ার থেকে চারমিনারের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি অবাক হলাম বাড়িতে বসে সিগারেট খাওয়ার সাহস দেখে। হঠাৎ বললেন “একটা খাও না!”বললাম “আমি খাইনা”। বললেন “আমি কি তোমার খলিলদাকে বলতে যাচ্ছি নাকি? খাও, ভাল লাগবে”। অগত্যা একটা সিগারেট ধরালাম। কিন্তু আবার সেই দমকা কাশি। তাই ঐ ব্রাণ্ড-এর সিগারেটটা আমার কোনো দিন পছন্দ হয়নি।
তারপর বহুদিন আর সিগারেট খাওয়া হয়নি। আমি না খেলে কী আর যায় আসে; সুলতানিয়া স্কুলের উঁচু ক্লাসের অনেককে দেখতাম রাধাদার দোকান ঘরের অর্ধেক বন্ধ পাল্লার পিছনে বসে সিগারেট টানতে। দোকানের বাইরে দশ-বারো ফিটের চালার নিচে তৈরী হত চা; আর বিভিন্ন আকারের কাচের বয়ামে থাকত রকমারি বিস্কুট ও কেক; আর একটা ক্যানেস্তারা টিনের ঢাকা-বাক্সে থাকত ‘লর্ডসের বান’। ঐ রকম সুস্বাদু বান রুটি আর আজকাল পাওয়া যায় না আর রাধাদার হাতের চা-ও ছিল অপূর্ব। দোকানের দরজার পাল্লায় কাগজ দিয়ে সাঁটা ছিল “বুদ্ধির ঘরে ধোঁয়া দিতে ভিতরে বসুন”ঐ দোকানের চা আর বান রুটির কথা জেনেছিলাম আমাদের মাদ্রাসা হস্টেলে থাকা কয়েকজনের অনুরোধ-উপরোধ রক্ষা করতে গিয়ে। কিন্তু আমরা কেউই কোনদিন সেখানে সিগারেট খাইনি।
পাণ্ডুয়ার মাদ্রাসায় পাঠ চুকিয়ে ১৯৬৫-তে কলকাতা আসার পর আমার অনেক পরিবর্তন হতে থাকে; বেশভূষা, চালচলন, কথাবার্তা ইত্যাদি লক্ষ্যণীয় ভাবে পাল্টে যেতে থাকেতদানিন্তন কালের বহমান স্টাইলে আমিও আবর্তিত হতে থাকি। শুধু আমার মেজভাইয়ের কথা অনুসারে মন দিয়ে পড়াশুনাটা করতাম। এক বছরের মাথায় আমাদের পাড়ার মানিকভাইয়ের শালা বুলুর সঙ্গে ভাব জমে ওঠে। উনি তখন মৌলানা আজাদ কলেজের ছাত্র। থাকেন ঐ কলেজের বেকার হস্টেলের দতলায়; সম্ভবত চুরাশি নম্বর রুমেআমাদের হস্টেল আর ওদের হস্টেলের মাঝে মসজিদ। তার পশ্চিম দিক দিয়ে যাওয়া আসার একটা প্যাসেজ আছে। সেখান দিয়ে বুলু সকাল সন্ধ্যায় আমার রুমের সামনে দিয়ে একটা সিগারেটের দোকানে যেত। ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বেশ গাঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উনি সিগারেট খাওয়ার সময় আমাকে অফার করতে থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে সিগারেটের প্রতি আমার আসক্তি জন্মাতে শুরু করে। তারপর থেকে আমার অজান্তে ঐ বস্তুটার প্রতি নেশা ধরে যায়। ব্রেক-ফাস্টে চায়ের পরে সিগারেট। লাঞ্চ-ডিনারের পরে পরে সিগারেট। এমনকি সকালের চায়ের পর সিগারেট না হলে টয়লেট হবে না। কখনও যদি পেটের সমস্যা হয়েছে, ঘন ঘন টয়লেট যেতে হচ্ছে, তখনও সিগারেট নিতে ভুলি নাঐ রকম অবস্থায় দাস্ত তো হবেই তার বেগ তো রোখা যায় না। তখন  সিগারেট কি কোনরকম স্টিমুলেট করে? আসলে ব্যাপারটা একেবারেই সাইকোলজিক্যাল।
আমার আলিয়া ছাড়ার আগেই বি.এ. পাশ করে বুলু চলে যায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। সেখানে বুলুদের কুসুম গ্রামের বিখ্যাত গায়ক কে.মল্লিকের জমিদার আত্মীয় বসবাস করতেন। বুলু বেশ কিছুদিন ওঁদের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতো। জমিদার পুত্রের সঙ্গে রোলস রয়েস চেপে ঘুরত। তারপর উনি P.T.C (পাকিস্তান টোবাকো কো)-তে চাকরী শুরু করেন। ওর চাকরী র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী কোম্পানি থেকে প্রতি সপ্তায় কয়েক কার্টুন করে ফ্রীতে সিগারেট পেতো। ঐ খবর পাওয়ার পর ভেবেছি বুলুর ভাগ্যটা বেশ সুপ্রসন্ন।
দীর্ঘদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ইতিমধ্যে গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়েছে। পাকিস্তান টোবাকো থেকে কোম্পানির নাম হয়েছে বাংলাদেশ টোবাকো। দীর্ঘদিন পর বুলু একবার কলকাতা এল। বললাম ‘সিগারেট কোম্পানির অফিসার, আমার জন্য সিগারেট কৈ?’ উত্তর এল “আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি”
বুলুর অবর্তমানে সিগারেট বন্ধু হয় আজিজ সাহেব। উনি পার্ক সার্কাসে থাকতেন। হস্টেলে আমার রুমে এসেই ধরাতেন সিগারেট। উনি আবার শেখাতেন “দাঁত ব্রাশ করার পরে পরেই একটা খেয়ে দেখবি, মুখের মধ্যে একটা মিষ্টি স্বাদ পাবি”। উনি সিগারেটে একটা টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়াটা একচোটে এমন দক্ষতার সাথে গিলে নিতেন যে সামান্যতম ধোঁয়াও মুখের বাইরে নষ্ট হত না। যেমন বুলু সিদ্ধহস্ত ছিল ঠোঁটদুটো গোল করে ধোঁয়ার রিং ছাড়ায়। তিনি কখন কখন আবার উত্তম কুমারের নকল করে দুই ঠোঁটের ধারে সিগারেট রেখে লেখা পড়া করতেন। বহুদিন দেখেছি উনি একটা সিগারেট শেষ করে তারই আগুন থেকে আর একটা ‘পানামা’ সিগারেট ধরাতেন। ওর ধারণা ছিল ইন্টেলেকচুয়াল-রা ওরকমই করেন। পানামার প্যাকেটে থাকত কুড়িটা সিগারেট প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করারও বুলুর ছিল বিশেষ ষ্টাইল। প্যাকেট থেকে একটা বের করার পর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখের উপর কয়েকটা টোকা দেওয়াটাও ছিল দর্শনীয় ভঙ্গিমার। আর সেই বন্ধু সিগারেট ছেড়ে দিল আমাকে সিগারেটের দাস করে দিয়ে।
আলিয়ায় ছ’ বছর পড়াশুনা করার পর আজাদ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও বাবার পয়সায় সিগারেট উড়িয়েছি, তার পর কর্মজীবনেও মুখের ধোঁওয়া দিয়ে পরিবেশ কলুষিত করে চলেছি। চোখের সামনে ডাক্তার ভাগ্নি জামাইয়ের ক্যান্সারে অকালমৃত্যু দেখেছি। ডাক্তার মেজ দোলাভাইও প্রষ্টেট ক্যান্সারে মৃত্যু বরণ করেন। আর দেখেছি মেজভাইকে[4] C.O.P.D. জর্জরিত হয়ে কঙ্কালসার হয়ে মারা যেতে। এরা সকলেই ছিলেন সিগারেটখোর। ইদানিং আমার থেকে অনেক ছোট সাগির ভাগ্না[5], হাই কোর্টের উকিলও C.O.P.D –র জন্য চলৎশক্তিহীন; কাশি দিয়ে বুকের জমাট কফটা মুখ থেকে দূরে ফেলার ক্ষমতা নেই – কাঁপা কাঁপা হাতে মুখ থেকে সেটা পরিস্কার করে। ইদানিং আমারও শ্বাস কষ্ট দেখা দিচ্ছে। High altitude-এ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ক্লাসে পড়ানোর সময় গলাটা শুকিয়ে যায়। আমার পরিণতি সম্পর্কে আমি নিজেই ওয়াকিবহাল। ডাক্তার ধূমপান নিষেধ করেছেন; কয়েক ধরনের ট্যাবলেট দিয়েছেন আর দিয়েছেন ইনহেলারএত কিছুর পরও কেন যে সিগারেটের নেশা ছাড়তে পারছি না জানিনা। ওটা খাওয়া শুরু করেছিলাম এক ধরণের ভ্রান্ত snobbery দেখাতে, কিন্তু সেটা যে এত মারাত্মকভাবে addiction হয়ে দাঁড়াবে কল্পনাও করতে পারিনি। বাড়িতে সিগারেট ধরালেই একরাশ বকুনি খাচ্ছি। মেজভাই ও অন্যান্যদের দৃষ্টান্ত দেয়। একদিন তো বকাঝকার climax করে বসল। বলল “কতলোক তো কত কিছু ছেড়ে দেয় এমনকি স্ত্রীকেও ত্যাগ করে আর তুমি সামান্য সিগারেট ছাড়তে পার না!”। আপনজন হিসেবে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা আমাকে ধূমপান ছাড়িয়ে সুস্থ সবল ভাবে বাঁচানোরকিন্তু চোর না বোঝে ধর্মের কাহিনি। স্ত্রীকে প্রতিউত্তরে বলেছিলাম “তোমার চেয়ে অনেক আগে থেকে সিগারেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব – সেটা ছাড়া কি উচিত!”
আমার ব্যক্তিগত পরিণতি কখনই সুখকর নয় – আমি জানি। এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জবাব দেওয়া শুরু করেছে। ইদানিং  আমি অন্যরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছি। কম বয়সের ছেলেদের সিগারেট খেতে দেখলে আমি একটা সিগারেট নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে বলি ‘একটু আগুন হবে’? অনেকে দেশলাই অথবা লাইটার বাড়িয়ে দেন আবার অনেকে বলেন সিগারেট থেকে ধরিয়ে নিতে। আমার সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাদের বলি “একটা মজা দেখবেন? যখনি সিগারেটের ধোঁয়াটা টানব আমার কীরকম দমকা কাশি হবে!” সত্যিই হয়। কাশি থামিয়ে কোনক্রমে তাদের বলি “আমার তো অতি দীর্ঘ দিনের নেশা; তাই কোনভাবেই আমি সিগারেট ছাড়তে পারছিনা। আর আপনাদের অল্পদিনের অভ্যেস। সিগারেট ছেড়ে দিন”। দেখছি কথাতে কাজ হচ্ছে। এইতো সেদিন তপনের দোকানে সিগারেট নিতে গিয়ে একজন চাবুক স্বাস্থের যুবককে শর্টস ও স্যান্ডো গেঞ্জীতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে দেখে তাঁর তৈরি করা সুন্দর স্বাস্থ্যের কথা বলে অনুরোধ করলাম সিগারেট খেয়ে স্বাস্থ্যটা অসময়ে নষ্ট না করতে। জানি না কেন ছেলেটি তৎক্ষণাৎ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল “আমি সারাদিনে এক আধটা খাই”। আমি বললাম “তাহলে ঐ এক আধটা ছেড়ে দেওয়াতো অনেক সোজা। একটা সিগারেটেও জানবেন বিষ গলধঃকরণ করছেন”। ছেলেটি খুবই ভদ্র। সে নিজের থেকে সংযোজন করল “ইদানিং আমারও মনে হচ্ছে- দৌড়ে যেন আগের মত দম ধরে রাখতে পারছিনা। বলল “কথা দিলাম আর খাব না। আপনার কাশি আর short breath থেকে আমি শিক্ষা নিলাম”।
গতকাল আলিয়া ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে যাওয়ার পথে ‘মা’ উড়ালপুলের শেষ প্রান্তে পার্কসার্কাস সেভেন পয়েন্টের কাছে সিগনালে দাঁড়িয়েছিলাম। পাশে টুকটুকে লাল রঙয়ের ভক্সওয়াগেনের ষ্টিয়ারিংএ দেখি এক সুন্দর চেহারার যুবক সিগারেট টেনে চলেছে। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষন করে ঐ সুন্দর চেহারাটাকে সিগারেট খেয়ে নষ্ট করতে বারণ করলাম। ছেলেটা খুবই ভদ্র। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিল।
এইতো সেদিন পাণ্ডুয়া থেকে সল্টলেক ফেরার পথে দিল্লি রোডে এক জায়গায় চা খেতে দাড়িয়েছিলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রী, এক দিদি ও একেবারে ছোট ভাইটাও ছিল। সে দু-তিন বার আমাকে বলল আপনি গাড়িতেই বসে থাকুন; আমি চায়ের অর্ডার দিচ্ছি। আসলে সে আবার আড়ালে আবডালে সিগারেট টানার জন্য সুলুকসন্ধি খুঁজছিল। সেও সিগারেটে addicted হয়ে বসে আছে। অথচ তার গলার স্বর ভেঙ্গে যাছে; গলার ভিতরে নাকি দানার মত হয়েছে। ENT ডাক্তার অনেকরকম test করতে বলেছে; আর বলেছে কথা বলবেন না। তা সত্বেও বাবু ধূমপান করে চলেছে। খেলাধুলা করা তার সুন্দর চেহারাটা ক্রমশঃ ভেঙ্গে যাচ্ছে।
আমার পরের ভাইটাকে মাস পাঁচেক পরে দেখে আমি অবাক। সে আমার থেকেও বেশি বুড়িয়ে গেছে। ওই দুভাই তাদের সুস্বাস্থ্য নষ্ট করছে সিগারেট খেয়ে। ওরা বিভিন্ন অসুখে ভুগছে, যেগুলোর মুখ্য কারণ সিগারেট। অথচ দুজনেই শিক্ষিত; কনিষ্ঠজন B.Sc. পাশ করে শিক্ষকতা করে আর অন্য জন Ph D; Horticulture এর Deputy Directorএরা হল জ্ঞানপাপীঅন্যদিকে বড়ভাই (FRCS) আশি অতিক্রম করলেও এখনও প্রচন্ড handsomeহয়ত non smoker (ধূমপায়ী নয়) বলে। বাবাও ছিলেন বড়ভাইয়ের মত non smokerসাতাশি বৎসর বয়সে stroke এ মারা যাওয়ার (১৯৯১) আগে পর্যন্ত শুধু ডাক্তারি নয় ভীষণভাবে সাংসারিক ও সামাজিক কাজে নিরলসভাবে ব্যস্ত বরং অতি ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন।
আমাদের সমাজের রীতি হল গুরুজনদের সামনে ধূমপান না করা। ভাইয়েরা তাই আমার সামনে ধূমপান করে না; আমিও আমার থেকে বড়দের সামনে ঐ রকম আচরণ করি। বড়দা আব্বার মৃত্যু দিবসে (৩ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে ঠিক কলকাতায় হাজির হন ১ ডিসেম্বর। নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে দু তারিখে ওঁদের re-union করে তিন তারিখ পাণ্ডুয়া গিয়ে আব্বার কবর জিয়ারত করেন। কমপক্ষে দুই তিন জায়গায় আব্বা-মায়ের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনায় দোওয়ার মজলিস করেন। গতবছর আমার গাড়িতে ওঁকে পাণ্ডুয়া নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন সকাল থেকে মাত্র একটা সিগারেট টয়লেটের জন্য খেয়েছিলাম। যাওয়ার পথে গাড়িতে আমার কাশি পেয়ে যায় যেমন প্রায়শঃ হয়ে থাকে। বড়ভাই একটু ইংলিশ সাহেব সুবোদের মতআমার কাশির ধরণ শুনে অভ্যস্থ soft আওয়াজে বললেন “কলকাতা ফিরেই lungs এর x-ray ছাড়াও কয়েকটা test দেব করবে। লক্ষণ ভাল মনে হচ্ছে না”। আমার প্রতি ওঁর ধারণা খুব ভাল ছিল। ওঁর কথা শুনে আমি লজ্জায় মরি। আমাদের সঙ্গে আমার just বড়দিদিও পাণ্ডুয়া যাচ্ছিল। সে একেবারে সরাসরি বলে দিল “সিগারেট খেলে কাশি হবেনা!” বড়দা আকাশ থেকে পড়লেন, “সে কি! বদু সিগারেট খায়!! আমি তো জানতাম ও ভাল ছেলে; এসব বিষ থেকে ও অনেক দূরে। যত দ্রুত সম্ভব সব test করে চিকিৎসা করাও”। আমি লজ্জায় মরি। আমার এতদিনকার ভাল মানুষের মুখোশটা বড়ভাইয়ের সামনে একটা বাজে ঘড়ঘড়ে কাশির জন্যে এক লহমায় খুলে গেল। এই ক’দিন আগেও যেমন অপ্রস্তুত হতে হল মেজবুবুর কাছে। বললেন ‘আমি জানতাম বদুর কোন খারাপ নেশা নেইতা তুমিও সাগিরের[6] মত সিগারেট খাও? তাই তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে দেখি যে তুমি হাঁপাচ্ছ। এখনই তওবা কর আর সিগারেট খাবেনা ব’লে।’ সেদিন লজ্জায় ওঁর দিলখুশা ষ্ট্রীটের বাড়ি থেকে পালানোর পথ পাইনি
দীর্ঘদিন ধরে ধূমপায়ীদের ব্রঙ্কাল অ্যাজমা অবশ্যম্ভাবী। ফুসফুস খারাপ হবেই। গলায় সব সময় কফ জমে থাকা স্বাভাবিকচোখের শিরা-উপশিরাগুলো স্ফীত হয়ে থাকে। যেমন আমাদের গ্রামের সিদ্দিক চাচাকে দেখতাম বিড়িতে টান মারার সঙ্গে সঙ্গে কাশিতে মুষড়ে পড়ে বসে পড়তে; তা সত্বেও বিড়ি ফেলে না দিয়ে কাশি একটু থামতেই আবার দিত টান; আবার কাশতে কাশতে তাঁর চোখমুখে কেমন হয়ে যেত; মুখ দিয়ে কফ, লালা ঝুলতে থাকত- যতক্ষণ না ঐগুলো সে তাঁর সরু প্যাকাটির মত কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে পরিস্কার করে। কেন! আমাদের সামনের বাড়ির আয়ুব সাহেবকেও শেষ জীবনে ঐ রকম কষ্ট পেতে দেখেছি। তাঁকে এর জন্য একবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেশ কিছুদিন থাকতেও হয়েছিল। শুধু আয়ুব ভাই কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেঞ্চ বিভাগের অধ্যাপক নারায়ন চ্যাটার্জিকেও অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার কারণে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছিল।
নারায়নদার কথা যখন এসে গেল ওঁর সম্পর্কে দু একটা কথা বলে নিই। ফ্রেঞ্চ ভাষা ও সাহিত্যে ওঁর প্রচণ্ড দখল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের স্বনামধন্য বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র। এম.এ. পাশ করে দীর্ঘদিন প্যারিসের এক কম্পানীতে চাকরী করাকালীন ঐ ভাষা ও সাহিত্যটা সম্যক চর্চা করেছিলেন। উনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈকালিক Language course এ পড়াতে শুরু করেন প্রায় তখন থেকেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ। তখনই লক্ষ্য করেছি ওঁর হাপানির টান। তা সত্ত্বেও আশুতোষ বিল্ডিং এর তিন তলার প্রফেসর হলে ঢুকে উনি সোজা দেবেনদার[7] কাছে চলে যেতেন। দেবেনদাকে এক কাপ চা অর্ডার করার আগেই বলতেন “দেবেনদা একটা বিড়ি দাও”। সেটা টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হত ওঁর কাশি। চা খেয়ে আবার ধরাতেন একটা সিগারেট। ইতিমধ্যে বৈকালিক ক্লাসের বিদেশী ভাষার ম্যাডামরা এসে গেলে নারায়নদা অবলীলাক্রমে তাঁদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। দেখতাম বিদেশী ম্যাডামদের সিগারেট প্যাকেট থেকে একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করে যাচ্ছেন। আমি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলতাম “চালিয়ে যান নারায়নদা”। চাপা উত্তর আসত “চুপ”। আবার কখন শুনতাম “চুপ বজ্জাত”। কতবার বলেছি “নারায়নদা আপনার সব সময় একটা টান হচ্ছে, তাঁর উপর সমানে বিড়ি-সিগরেট খেয়ে চলেছেন। শরীরটাতো আর ধকল সইতে পারছেনা সেদিকে খেয়াল আছে?” বলতেন, “চুপ করতো। সিগারেট খাওয়া শুরু করেছি যাদবপুরের ছাত্রজীবন থেকে। জানিস তখনকার স্টাইল ছিল drain Pipe প্যান্ট পরার। ক্লাসের মধ্যে একদিন বুদ্ধদেব বাবু আমার কাছে দেশলাই চেয়ে বসলেন। সচকিত হয়ে বলেছিলাম “স্যার আমি ধূমপান করিনা আমার কাছে দেশলাই থাকবে কী করে?” স্যার বললেন “নারায়ন তোমার টাইট প্যান্টের পকেট স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সিগারেট আর দেশালাইয়ের। দাও দাও; আর ভণিতা করো না”। নারায়নদা সুড়সুড় করে দেশলাই বার করে দিতে বাধ্য হনক্রমে ক্রমে নারায়ণদা বুদ্ধদেব বসুর প্রিয়ছাত্র হয়ে ওঠেন। সন্ধ্যার পর স্যার Blue Sky ইত্যাদিতে যেখানেই যেতেন প্রায়শই নারায়নদাকে লেখা-পড়ার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতে হলে সেখানে যেতে বলতেন। স্যারের সামনে থাকত সুরা আর নারায়নদার জন্য বরাদ্দ হত কোকাকোলা। বুদ্ধদেব বসুর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে, তাঁর লেখালেখি নিয়ে কত কথা বলতেন, মাঝে মধ্যেই আমাকে বলতেন “ছাড় একটা সিগারেট”।
নারায়ণদার ফ্রেঞ্চভাষা ও সাহিত্যে ভাল দখল থাকার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অনেক অধ্যাপককে দেখেছি সাহিত্য নিয়ে ম্যারাথন আলোচনা করতে। ওঁর দুষ্টু বুদ্ধিরও তারিফ করি। ইংরেজির এক অধ্যাপিকা ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের একটা বিষয়ে নারায়নদাকে জিজ্ঞাসা করলে প্রথমেই উনি বলে বসেন “একটা সিগারেট দে”। ম্যাডাম খুব অস্বস্তিতে প’ড়ে চাপা স্বরে বলেন “নারায়ণ পরে হবে”। নারায়নদা হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বললেন “জানি তুই সকলের সামনে সিগরেট খাসনা রে কিন্তু তোর Vanity bag এ তো সব সময় তোর বিশেষ ব্রাণ্ডের প্যাকেট থাকে – আমি তো জানি। আগে একটা ছাড়, তারপর এ বান্দা মুখ খুলবে। অগত্যা...আনন্দবাজার পত্রিকায় একবার বাৎস্যায়নের কামসূত্রের উপর পুরো পাতা ভরে একটা সুন্দর লেখা পড়ে ঐ বই সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে যায়। পরের দিন নারায়নদাকে ঐ লেখা সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করলে – ওদিক থেকে উত্তর পেলাম “লেখাটা দেখেছি। জোলো, জোলো”। আমি অবাক! উনি কয়েকজন ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিক-সমালোচোকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে শুরু করলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক উনি বলে গেলেন তার সঙ্গে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা প্রায় শূন্য করে ফেললেন। শুধুমাত্র লাগামহীন ধূমপানের কারনে চাকরিরত অবস্থায় নারায়নদা গত হন। যেমনটি ঘটেছিল আমাদের আরবী বিভাগের ড. গনির ক্ষেত্রে। উনিও ছিলেন ধূমপায়ী; আর তার জন্যই তাঁর হার্টের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তা স্বত্বেও তিনি ধূমপান ছাড়েননি। তারই পরিনামে হঠাৎ করে myocardial infarction. চিকিৎসার কোন সুযোগ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তিনি একেবারে অকস্মাৎ গত হলেন।  
আসলে সিগারেট-বিড়ি কোন উপকার করে না; ওগুলো চিন্তাশক্তি বাড়াতে কোন সাহায্যও করে না – যা করে তা হল ক্ষতি আর ক্ষতি। ওগুলোয় শরীরের ক্ষতি, আর্থিক ক্ষতি, পরিবেশ দূষণের দিক থেকেও ক্ষতিকর। ধূমপায়ীরা সিগারেট-বিড়ি থেকে নিজের যত শারীরিক ক্ষতি করে তার দশগুণ বেশি ক্ষতি করে তার পাশাপাশি মানুষদের; আর ঐ ধোঁয়া শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি করে। পোড়া সিগারেটের ফেলে দেওয়া অংশটি মাটির উর্বরা শক্তির ক্ষতি করে আর একটা সিগারেট থেকে যতটা ধোঁয়া নির্গত হয় তার ক্ষতিকারক কার্বনডাই অক্সাইড/মনোঅক্সাইড প্রায় কুড়ি পঁচিশ স্কয়ার মিটার এর প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি। এক প্যাকেট সিগারেটের যা দাম তাতে একটা গরীব মানুষের একদিনের সংসার খরচ হয়ে যেতে পারে।
আমি নিজে কতবার ঐ শেষের কথাটা ভেবেছি কিন্তু নেশার কারণে ভাবনাটা আজও ভাবনাই থেকে গেলসিগারেট কেনার সময় যুক্তি খাড়া করেছি ঠিক সমপরিমাণ টাকা কোন গরীবকে দান করে দেব খন। কিন্তু কখনও তা করিনি। কখনোসখনো ভাবি একমাসে কত টাকা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি; সেই অনুপাতে বৎসরে কত টাকা অপচয় করছি আর সারাজীবনে কত টাকা ঐ তামাকে নষ্ট করছি হিসাব করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু করিনা। হয়ত ঐ পয়সা সঞ্চয় করতে পারলে একটা বাড়ি নিদেনপক্ষে একটা গাড়ি অন্ততঃ কেনা যেত। এই প্রসঙ্গে আমার আব্বার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯২৫ ব্যাচের মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনীরা প্রতি বৎসর ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার গেট-টুগেদার করতেন। প্রতিবারই যে কজন ডাক্তার কলকাতায় বসবাস করতেন তাদের মধ্যেই[8] ঘুরে ফিরে ঐ মিলন তিথি পালন হত। সেখানে এক বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার বাবু রসিকতা করে বলেছিলেন “ছাত্রজীবন থেকে দেখে আসছি আব্দুর রহমান বড় নিরস। না সুরা রসিক না ধূমে রসিক। তা রহমান, আমরা ঐ সবে যত পয়সা উড়াই তা দিয়ে তোমার পাণ্ডুয়ার বাড়ির মত আমাদের আরও একটা করে বাড়ি হয়ে যেত”। আব্বা তার ঐ উক্তিটা অন্যভাবে না নিয়ে complement হিসাবেই নিয়েছিলেন।
তামাকে পয়সা নষ্ট না করে বাড়ি তৈরীর কথায় মনে পড়ল অধ্যাপক মৃণাল নাথের[9] কথা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Comparative Philology বিভাগ থেকে বিখ্যাত জাতীয় প্রফেসর সুনীতি চ্যাটার্জির ছাত্র। তিনি কিছুদিন স্বনামধন্য অধ্যাপক সুকুমার সেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেছিলেন; কোন কারণবশঃত তার কাছে রিসার্চ শেষ করেন নি; অন্য এক অধ্যাপকের কাছে পিএইচ ডি করেন। পাশ করার পরে লেকচারার হয়ে পড়াতে শুরু করেন গুজরাটের বরোদার একটা কলেজে।
ছাত্রজীবন থেকেই প্রচুর সিগারেট খান। কলেজে পড়ানোর সময় থেকে তার সঙ্গে যোগ হয় Pipe টানা। ওতে সিগারেটের থেকে অনেক বেশি বেশি ধোঁয়া বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। শরীরের পক্ষে আরও ক্ষতিকারক। কিন্তু ওতে ষ্টাইল করার মাইলেজ বাড়ে। পাইপ দাঁত দিয়ে চেপে রাখলে ব্যক্তিত্বটা বাড়ে বলে মনে করেন। ক্লাসরুমের বাইরে মৃনালদাকে সব সময় ধোঁয়া ছাড়তে দেখে ওকে বলা হত বাঙালী-চুলহাবাবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এলেন তখনও সেই একই ভাবে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছেন। অনেক সময় কাশির দমক আসে; তার আওয়াজ শুনলে মনে হবে ভদ্রলোকের বুকটা এখনই ফেটে যাবে। দেবেনদার কাছে দৌড়ে গিয়ে গরম জল খেয়ে কোন রকম ধাতস্ত হন। তৎক্ষণাৎ আবার সিগারেট ধরান। কোন কোন শুভাকাঙ্খী অধ্যাপক বন্ধু তাঁকে বলেন “সিগারেটের পিছনে আপনি যত পয়সা নষ্ট করছেন তাতে একটা ফ্ল্যাট হয়ে যেত”। মৃণালদা তার উত্তরে বলেছিলেন “জার্মানির একটা ছিমছাম বাড়ির মালিককে তাঁর এক বন্ধু ঠিক ঐ রকম কথা বলেছিলেন যে আপনি যদি স্মোকিং এ অত পয়সা অপচয় না করতেন তাহলে সামনের ঐ পাহাড়ের উপর সুন্দর বাংলোটার মতো আপনারও একটা বাংলো হোত”। উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলেন “দুর্ভাগ্য বশতঃ ঐ বাংলোটা আমারই”।
যারা ধূমপান ছাড়বে না তাঁদের বোঝান দুষ্করতারা নিজেদের মতো করে যুক্তি সাজিয়ে চলে। আর যারা সিগারেট-বিড়ির বিক্রেতা তারাও নিজেদের ব্যবসা করে চলেছে। সরকারী আইন কানুনের কোনও তোয়াক্কা না করে স্কুল ছাত্রদেরকেও সিগারেট বিক্রি করছে। সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলোও সরকারী আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কয়েকশ কোটি টাকার ব্যবসা করে কোটি –কোটি মানুষকে দিনের পর দিন বিষ খাইয়ে চলেছে। ইদানিংকালে সিগারেট প্যাকেটের উপর ক্যান্সারের ক্ষতযুক্ত ছবিটা প্রথম দিন তপনের দোকানে, সিগারেট কিনতে গিয়ে দেখে – ঘৃণায় শিউরে উঠেছিলাম। তপনকে বলি “আগের কোন প্যাকেট থাকলে দিন। এই প্যাকেটের ছবি দেখে সিগারেট খেতে পারব না”। তপন পাকা সেলসম্যানের মত বলল “ছবির দিকে তাকাবেন কেন? প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করবেন আর ধরাবেন”। কয়েকদিন ঐ রকম প্যাকেটে হাত দিতেও ঘৃণা করছিল। এখন দেখছি ওটা সয়ে গেছে। আমরা ধূমপায়ীরা ভাবি, আমার কিছু হবে না। যেমন অনেকে বলেন কই মেয়েরাতো সাধারণত সিগারেট খায় না, তা তাঁদের কেন ক্যান্সার হচ্ছে? এই জাতীয় অনেক যুক্তি খাড়া করে সিগারেট খাচ্ছি। কিন্তু সিগারেট-বিড়ি এত ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্যভাবে ক্ষতি করে তা বলে শেষ করা যায় না। মানুষের শরীরের প্রত্যেকটা organ -এর ওপর তার খারাপ প্রভাব পড়তে থাকে। ইদানিং কিছু মেয়েদের দেখছি নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করতে প্রকাশ্যে সিগারেট খাচ্ছেন। ভবিষ্যতে তাঁদের মা-হওয়ার সম্ভাবনা কমছে; আর পুরুষ ধূমপায়ীরা আখেরে হারাচ্ছেন পৌরুষ।
এই লেখাটার সময় একজন স্বনামধন্য হার্ট স্পেসালিষ্টের কথা মনে পড়ছে; তিনি হলেন ডাক্তার এস সি কুণ্ডু। শিয়ালদার বি.আর. সিং হাসপাতালে চাকরি করার সময় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ছিলেন এ.বি.এ. গনি খান চৌধুরি। একদিন মন্ত্রীমশায় হঠাৎ ফোন করে ডাক্তার কুণ্ডুকে দিল্লি তলব করেন। তিনি ডাক্তার বাবুর ওপর দায়িত্ব দেন  বি.আর.সিং হাসপাতালের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টটাকে একেবার আধুনিক করে তুলতে। অভয় দেন টাকার কোন অভাব হবে না। আর ছ-সাতবার দিল্লি আসা যাওয়ার এয়ার টিকিট ডাক্তারবাবুর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওঁর তত্বাবধানে ঝাঁ চকচকে আধুনিক হার্টের চিকিৎসার ইউনিটটা তৈরী হয়।
ঐ বিখ্যাত ডাক্তারবাবু আমার শাশুড়ির চিকিৎসা করতেন। সেই উপলক্ষ্যে ফুলবাগান সিআইটিতে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে কয়েকবার গিয়েছিবসার জায়গায় C.O.P.D. তে জর্জরিত একটা কঙ্কালসার কাট আউট রাখা আছে।[10] তার নীচে ধূমপানের থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। পাশে একটা চ্যারিটির জন্য বক্স রাখা আছে ধূমপান বিরোধী সমিতি’র সাহায্য কল্পে। ঐ কাট আউটটায় যতবার চোখ পড়েছে আমার মেজ ভাইয়ের তৎকালীন চেহারাটা ভেসে উঠেছে। মনে হয়েছে ঐ ধরণের সচেতনতা কর্মে আমিও যোগ দিই। কিন্তু আজও তা হয়ে ওঠেনি। মূলতঃ আমি নিজে প্রতিদিন ক্ষয়ে যাচ্ছি অনুভব করেও আজও সিগারেট ত্যাগ করতে পারিনি। প্রতি বছর রমজান মাসে সিগারেট ছাড়তে উদ্যোগ নিই। রোজার দু একদিন মাত্র একটা কি দুটো সিগারেট খাই। কিন্তু তিন-চারদিন পর থেকে সিগারেটের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে  ছ-সাতটায় পৌঁছে যায়। আর ইদের দিন থেকে প্রায় লাগাম ছাড়া হয়ে পড়েসারাদিন অন্ততঃ দশটার কমে চলেনা। সকালে চা খাওয়ার পর টয়লেটে একটা দিয়ে শুরু হয়। বছর দশ থেকে সকালের ওই সিগারেট ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কাশি। ইণ্ডিয়ান ষ্টাইলের টয়লেটে বসা অবস্থায় কাশতে গিয়ে হার্নিয়ায় ব্যাথা হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে বাঁদিকের হার্নিয়াটা ফুলে ওঠে। অপারেশন করাতে বাধ্য হই। ডাক্তার এম এল সাহার নিপুণ সার্জারির কারণে বাঁ দিকটা এখন ভাল আছে। এখন কাশির জন্য ডান দিকের হার্নিয়াটা সামান্য হলেও গোলমাল করছে। প্রথমবার অপারেশনের সময় আমার একমাত্র মেয়ে সঙ্গে ছিল – অপারেশনের bond টা ওই সই করেছিল। সত্বর ভাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম তার সঙ্গে। সে মারা যাওয়ার কারণে এখন অপারেশন অনিবার্য হলেও আর O.T. তে ঢুকবোনা সঙ্কল্প করেছি। কিন্তু সিগারেট ছাড়ার সংকল্পটা একেবারেই করতে পারছিনা; পেরেছেন বাংলার এক অধ্যাপক বিশ্বনাথ রায়তিনি ডাক্তার সুকুমার মুখার্জির বকা খেয়ে এবং তাঁর চিকিৎসায় এখন অনেক সুস্থ আছেন।
আমি বার্দ্ধক্যে পৌঁছে সঙ্কল্প নিয়েছি যে আমি নিজে না হয় শেষ হয়ে যাচ্ছি কিন্তু নুতন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের ধূমপান থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করব। অনেকজনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি; এখনও কেউই কিন্তু মুখের ওপর বলেনি “আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে”
আমি আমার মত করে ধূমপান বিরোধী সজাগতা করে যাব – আপনি ধূমপায়ী হন বা না হন সকলকে সুস্থ সবল বাঁচার সুপরামর্শ দিন। আপনিও ভাল থাকবেন আর অন্যরাও।[11]




বদিউর রহমান। রিটায়ার্ড প্রোফেসর ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, আরবি ও  ফার্সি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং প্রোফেসর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; ২০১৮-তে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত। 
[1] মৌলানা আব্দুল হাই চিস্তি ছিলেন একজন সুযোগ্য ও সুবক্তা আলেম। আযমগড়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনে আমাদের মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষগণের মধ্যে ধনকুবের রাইসমিল মালিক ওহিদুল হক সাহেব তাঁকে আমাদের পাণ্ডুয়ার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতে অনুরোধ করেন। চিস্তি সাহেব পাণ্ডুয়া আসতে রাজি হন দুটি শর্তে।
(১) ওঁর ফ্যামিলি থাকার সুবন্দোবস্ত করতে হবে (২) ওঁর বিশিষ্ট বন্ধু মৌলানা নে’মতুল্লাহ সাহেবেকেও পাণ্ডুয়া পড়ানোর জন্য নিতে হবে। ওহিদুল হক (মেজবাবু) সাহেব নিজের প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গায় চওড়া বারান্দাসহ বড় বড় দু-কামরা ঘর ও বিশাল দহলিজসহ একতলা পাকা বাড়ি ক’রে বাথরুম, রান্নাশাল ইত্যাদি করে চারিদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরিয়ে দিয়ে ওঁর থাকার বন্দোবস্ত করেন নিজ খরচায়নে’মতুল্লাহ সাহেবকে শিক্ষকতা করতে দেওয়াটা তো কতৃপক্ষের কাছে কোন ব্যাপারই ছিল না। ওঁরা পাণ্ডুয়ায় দীর্ঘ আট-দশ বৎসর শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতা করা ছাড়াও চিশতি সাহেবের ওপর বড় মসজিদের ইমামতির গুরু দায়িত্বও অর্পিত হয়। ইমামতি যে কত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ওঁকে দেখে কিছুটা বুঝেছিলাম। আযান হওয়ার পাঁচ-দশ মিনিট আগে থেকে পশ্চিম দিকে মুখ করে, কাঠের টুলের উপর বসে, ধীরে সুস্থে ও অতীব মনোযোগ সহকারে ওযু সম্পন্ন করতেনতারপর পরিধেয় কাপড় ছেড়ে ভাল পায়জামা-পাঞ্জাবী-সুন্দর টুপি পরে মসজিদ পৌঁছে দুখুলুল মসজিদ থেকে আরম্ভ করে সুন্নাত নামাজ ইত্যাদি সেরে জামাতের অপেক্ষা করতেন। জাহরিয়া নামাযে ওয়াক্ত অনুযায় বড় অথবা ছোট কেরাত পাঠ করতেন – পরিস্কার গুরুগম্ভীর স্বরে। জুম্মার খুৎবার আগে খুব ছোট কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। প্রতিদিন আসরের পর হাদিসের তালিম দিতেন। আর বৃহস্পতিবার শাহসূফি সাহেবের মাযার সংলগ্ন মসজিদ প্রাঙ্গনে বক্তব্য রাখতেন বিশেষতঃ শিরক-বেদাতের বিরোধিতায়।
রিটায়ার্ড প্রোফেসর ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, আরবি ও  ফার্সি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং প্রোফেসর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; ২০১৮-তে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত। 
[2] আব্দুল গনি, পিতা- কামালুদ্দিন, পিতামহ- হাজি আতর আলি যিনি পাণ্ডুয়ায় সর্ব প্রথম রাইসমিল করেন, ‘ইসলামিয়া রাইসমিল’ নামে। কিছু কালের মধ্যে আরও একটা ‘রাজ্জাকিয়া রাইসমিল’ করেন। সেই অল্প শিক্ষিত মানুষটি পর পর দুটো পেট্রোলপাম্পও করে যান।
আব্দুল গনি সাহেবের ছোট বেলার অনেক কথা শুনেছি আব্দুল হক (সেজবাবু) সাহেবের বড় ছেলে ফজলুল হক সাহেবের কাছে। এই হক সাহেবরা সকলেই ধনকুবের। পাণ্ডুয়ায় রাইসমিল ছাড়াও ভবানিপুরে ছ-সাতটা বাড়ি। ব্রেবোর্ণ রোডে বর্তমানে গোদ্রেজ শোরুম এর বাড়িটাও ওঁদের ছিলএছাড়াও ওঁদের বাড়ি আছে পার্কসার্কাস লেডিস পার্কের উল্টোদিকে এবং ইলিয়ট রোড ও কলিন লেন ইত্যাদিতে। শিবের গাজন না গেয়ে আসল কথায় ফিরি।
ফজলুল সাহেবের সময় পাণ্ডুয়ায় স্কুল না থাকায় হাজি মহসিন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চুঁচুড়ার হুগলী মাদ্রাসায় পড়তে পাঠানো হয়। ঐ মাদ্রাসা সংলগ্ন হস্টেলে থাকতেন। একদিন কামালুদ্দিন সাহেব তার পুত্র আব্দুল গনিকে (ডাকা হত গেনি নামে) ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি করলে হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়। কামাল সাহেব ফজলুল সাহেবকে ডেকে বলেন ‘তুমিতো উঁচু ক্লাসে পড় তাই গেনিকে লক্ষ্য রাখবে যাতে ভাল করে পড়াশুনা করে’ হক সাহেব বললেন ‘ওমা! পরদিন সকালে আমরা সকলে পড়াশুনা করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য স্নান খাওয়া করব তখনও দেখি গেনি ঘুমাচ্ছে। সকালেও উঠতে বলেছিলাম। কিন্তু সে আর ওঠেনা। ভাবলাম বাড়ি ছেড়ে প্রথমবার বাইরে এসেছে সেজন্যে হয়তো মন খারাপ করছে। আমরা যথারীতি স্কুল চলে গেলাম। পরে দেখি প্রায়শই সে ওঠেনা। তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম এক হস্টেলমেট যখন বলল যে “তোদের ঐ ছেলেটা পায়খানায় বিড়ি খায়”। হক সাহেব আশ্চর্য্য হয়ে বললেন – “সে কিরে! ক্লাস ফাইভ অবস্থা! সেদিন বিকালে গেনিকে ধরলাম “হ্যাঁরে তুই বিড়ি খাস?” উত্তরে গেনি বলল “কোন শালা বলে?” তার রুদ্রমূর্তি দেখে এবং ভাষা শুনে হক সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে যান। পরে গেনির অনুপস্থিতিতে তার বাক্স খুলে দেখেন এক তাড়া বিড়ি
ঐ স্কুলেই হক সাহেবের সহপাঠী ছিলেন আব্দুশ শুকুর। আমার ছোট চাচা। MBBS পাশ করার পর ফজলুল হক সাহেবের এক বোনের সঙ্গে বিয়ের জন্য আমার আব্বাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় কেননা আমার আব্বাই ছিলেন পরিবারের গার্জিয়ান। আব্বা এক শর্তে রাজি হন যে শুকুর সাহেবকে বিয়ের পর লন্ডনে পড়তে পাঠাতে হবে। ওঁরা রাজি হন। চাচা লন্ডন গিয়ে DMRD এবং DMRE করে ফিরে আসেন।
ঐ বিয়ের সময় মগলামপুরের আদি বাড়িতে গেনি ভাইয়েরা বাবা-মা সমেত সকলে কয়েকদিন ছিলেন। আর গেনিভাই ছোট চাচার সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য বিয়ের বেশ কিছু দিন আগে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ছিলেন হৈ-হুল্লোড় করে সকলকে জমিয়ে, মজিয়ে। বিয়ের আগের দিন সকলে কাজ নিয়ে, খাওয়ানো-দাওয়ানো নিয়ে, হ্যাজাক জ্বালানো নিয়ে খুব ব্যস্ত। ছোট চাচা চিলেছাদের ঘরটায় ঘুমাচ্ছিলেনগেনিভাই সদলবলে সেখানে উঠে চাচার বুকের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষটাকে বলছেন “আমরা সকলে বিয়ে উপলক্ষে কাজ করতে করতে পেরেশান আর তুমি এখানে নাক ডাকছ!”গেনিভাইয়ের অগুনতি কাণ্ড কারখানার মধ্যে শুধু আর একটা বলব।
স্কুলে পড়াশুনায় তিনি খুবই অমনোযোগী। মাষ্টারমশাই পড়া ধরলে কিছু বলতে সক্ষম হন না। অতএব মাষ্টারদের শাসন ছিল বাঁধা। কোন মাষ্টার ছড়ি ব্যবহার করতেন, কোন মাষ্টার চুল ধরে টান দিতেন। আর একজন কান মলে শাসন করতেন। গেনিভাই সেগুলো থেকে বাঁচার নিত্যনতুন ও অভিনব উপায় বের করতেন।
দেখা গেল স্কুল যাওয়ার পূর্বে মাথা জবজবে তেল দিচ্ছেন; কান দুটোতেও তেল দিয়ে রাখছেন। এমন কি মাষ্টারদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ঘন ঘন ন্যাড়াও হতেন।
[3]  পাণ্ডুয়ার রাজ্জাকিয়া রাইসমিল মালিক আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের মধ্যম পুত্র আব্দুর রহমান। অপূর্ব সুশ্রী চেহারা। কেতাদোরস্ত পোষাকে সবসময় পরিপাটি। প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধি। দুটো কোল্ড স্টোরেজ ও নতুন করে একটা পেট্রলপাম্প করেছিলেন। সব থেকে বড় কথা ভীষণ বন্ধুবৎসল ছিলেন। যখনই কলকাতা আসতেন বড় হোটেলে বন্ধুদের ডেকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করাতেন। তাঁর বন্ধু সার্কেলের মধ্যে প্রখ্যাত আয়ান রাশিদ ও কলকাতা ও বঙ্গের বহু চিত্র পরিচালক ছিলেন। তাঁর শুধু সেলিব্রেটির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি সাধারণ অশিক্ষক কর্মচারী শ্রীধর বাবুকেও খাওয়া দাওয়ার জন্য ডেকে নিতেন। শ্রীধর বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রহমান ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি সেকশনে বহুবার গিয়েছেন। আর শ্রীধর বাবু অফিস ফেরৎ রহমান ভাইয়ের পেট্রোল পাম্পে আড্ডা দিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরতেন।
[4] মজিবুর রহমান সাহেব A.M.U. থেকে Civil Engineering BE করেন ১৯৬৫ সালে। আলিগড়ে পড়ার সময় থাকতেন Ross Masud হলে হলের Volley ball ক্যাপ্টেন ছিলেন আর ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল টিমের সদস্য। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করার পর কয়েকটা বেসরকারী কোম্পানীতে বছর চারেক কাজ করে মক্কার Kara Establishment এ দীর্ঘ তেইশ-চব্বিশ বৎসর চাকরী করেন। তারপর বছর দশেক আমেরিকায় ছিলেন। আলীগড়ের ছাত্রজীবন থেকেই উনি ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কর্মজীবনে মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান করে অতি সুন্দর Sportsman চেহারাটা বরবাদ করে বসেন।
এই মেজভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ওঁকে আমার Mentor বলা চলে দুটো কারণে
(১) আলিয়াতে ফারসির বদলে ইংরেজি নিতে বলেন। ঐ সময় গরমের ছুটিতে আমাকে আক্ষরিক অর্থে ইংরেজির ABC (Capital letter & Small letter) লিখতে শিখিয়ে আলিয়ায় আমার ক্লাসের ইংরেজি পাঠ্যবই Clarendon Reader – Book IV পড়ানো শুরু করে দিয়ে যারপরনা সাহায্য করেছিলেন।
(২) কলকাতায় আলিয়ার হস্টেলে আসার আগের রাতে ছাদে দুভাই শুয়েছিলাম। আমাকে বলেছিলেন “হষ্টেলে লেখাপড়া করছিস কি না করছিস কেউ দেখার নেই – তার ওপর আবার কলকাতার মত শহরে যাচ্ছিস। যাই করিস তোদের যা পড়ার সেটাই খুব ভাল করে পড়বি। তারপর খেলাধুলা, বদমায়েশি যা পারিস করবি কিছু যায় আসেনা।
[5] লেখার সময়, ১৩-০৭-২০১৭ বেঁচে ছিল। তবে দু’মাসের মাথায়, ৯ই সেপ্টেম্বর ২০১৭-তে তার মৃত্যু হয়  
[6] মেজদিদির বড়ছেলে, আমার ভাগ্না C.O.P.D -তে মারা গেল অসুস্থ 
[7] দেবেনদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি এবং কয়েকশ’ অধ্যাপকবৃন্দকে নবীন থেকে প্রবীণ হতে দেখেছেন। বেশ কয়েকজন অধ্যাপককে উপাচার্য হতেও দেখেছেন। সকলের সঙ্গেই তাঁর ব্যবহার ছিল অম্ল মধুর। দীঘার শেষ প্রান্ত থেকে কোন এক শুভক্ষণে তের বৎসর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ওঁর এক আত্ময়ের সঙ্গে এসেছিলেন। এক অধ্যাপকের কথায় সে বয়সেই অধ্যাপকদের হলের চা বানানোর লোকটির সঙ্গে ওঁকে কাজে যোগ দিতে বলা হয়। সেই থেকেই দীর্ঘদিন অভূতপূর্ব দায়িত্বের সঙ্গে অধ্যাপকদের শুধু চা দিয়ে নয়, বিভিন্নভাবে সকলের উপর গুরুজনসুলভ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ছিলেন সততার প্রতীক ও ভীভাবে নির্ভক। এক অধ্যাপককে অত্যাধিক ছাত্রী-বেষ্টিত হয়ে অধ্যাপক হলে প্রায়শঃ রিসার্চের নামে আড্ডা দেওয়া দেখে দেবেনদা তাঁকে মুখের ওপর বলেছিলেন “দোতলায় তোমাদের বিভাগে বসবে। আর যেন এখানে না দেখি”। এহেন দায়িত্বপূর্ণ কথা বলার সাহস কোন অধ্যাপক তো দূরের কথা কোন V.C.-র ও আজ পর্যন্ত হয়নি।
[8] ওঁদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন রীপন নার্সিং হোমের প্রফেসর সুধাংশু ঘোষ। (পার্ক সার্কাস) সি.আই.টি. মোড়ের পদ্মপুকুরের কাছে এক ডাক্তার (যার ছেলে Plastic Surgery এর প্রফেসর); টালা ট্যাঙ্কের কাছে ডাক্তার শোড়সি। আর একজন সম্ভবতঃ থাকতেন ১০ নং বিডন ষ্ট্রীটে। হাওড়া থেকে যোগ দিতেন ডাক্তার সিংহ রায় আর বর্ধমান থেকে আসতেন ঐ ব্যাচের সবচেয়ে কৃতি ছাত্র – ডাক্তার শৈলেন মুখার্জি (যাকে বলা হয় বর্ধমানের বিধানচন্দ্র)। তাছাড়াও থাকতেন চৌরঙ্গীর Calcutta Serological Institute এর ডাক্তার বাবু ও পার্ক সার্কাসের ডাক্তার হালদার প্রমুখ।
[9] উনি আমাদের থেকে কয়েক বৎসরের সিনিয়র। বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন। এবং মুশায়েরা থেকে ওঁর ‘প্রবাদ ও প্রবচন’ নামে কয়েকটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তাই ইদানিং আমি ওঁকে প্রবাদ পুরুষ বলে সম্বোধন করি। শ্রদ্ধাও করি। হিংসা করি তাঁর এখনও ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যাতায়াত দেখে।
[10] দেখুন- Smoking Kills – Brayan Stay – “He wanted you to know”. http//google/images/HRgXEg
[11] ধূমপানে স্বাস্থহানীর কথা জানতে দেখুন— দ্য স্টেটসম্যান ...


2 comments:

  1. Sir, I am Abdul Hai, your student at the University of Kolkata. I read the article that includes your life from childhood until now and it is a good article that I liked very much.

    ReplyDelete