Sunday 19 May 2019

মসজিদ নির্মাণ এবং আমরাঃ কোন্‌ পথে


মসজিদ নির্মাণ এবং আমরাঃ কোন্‌ পথে
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
কিছু দিন আগে আমি এক অনুষ্ঠানে গেছিলাম। মঞ্চ থেকে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার কারণ, উত্তরণের পথ ও উপায় ইত্যাদি নিয়ে নানা জন নানা মত দিচ্ছিলেন। অধিকাংশেরই বক্তব্য, মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণগুলির অন্যতম হল মাদ্‌রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। এখান থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা সমাজের কোনো কাজে লাগে না। মাদ্‌রাসা থেকে কখনো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-ডিএম-বিডিও-এসডিও বের হয় না, ইত্যাদি। এসব বস্তাপচা আলোচনা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, চর্বিতচর্বণের গাঁজা-সেবন কত ব্যাপকতা লাভ করেছে। এদের এই সব বক্তব্য যে অযৌক্তিক তা আমি অন্য এক লেখায় বিশদে আলোচনা করেছি। তাই এখানে সে বিষয়ে কিছুই বলবো না ওই অনুষ্ঠানের কোনো একটা সেশনের প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলছে। একজনের এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক বক্তা বললেন, আমরা মুসলিমরা কোথাও একটা বসত গড়ে উঠলে সর্ব প্রথমে কী করি, সেখানে একটা মসজিদ তৈরি করি। কখনো এমনটা ভাবি না, আগে স্কুল করি তারপর অন্য কিছু। এই কথা শুনে আমার পাশের এক শ্রোতা লাফিয়ে উঠল। জোরে জোরে হাত তালি দিতে লাগলো। সম্বিৎ পাত্রার যুক্তি শুনে কোনো ভক্ত যেমন করে লাফিয়ে উঠে, খানিকটা তারই মতো।
 
এ প্রসঙ্গে আমার যেটা মনে হয়েছে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়েরই ইসলামে মসজিদের কনসেপ্ট কী, সে সম্বন্ধে সঠিক ধারণা নেই। তাই নির্বোধের মতো কথার পীঠে কথা রেখে বক্তব্য দেয় বা শোনে। যদি ইসলামের ইতিহাসের পাতা ওলটাই খুব সহজেই চোখে পড়ে, নবী (সাঃ) ও তাঁর অনুগামীদের করা মদিনার মসজিদের কথা, যাকে আমরা নবীর মসজিদ বলে জানি। ওই মসজিদের এক পাশে একটা চালা লাগানো হয়েছিল। সেখানে অসহায়-আশ্রয়হীন লোকেরা থাকতো, যাদের চালচুলো ছিল না। এবং সময়-সুযোগ পেলেই নবীজির থেকে ইসলামের পাঠ গ্রহণ করতো। ওই চালার সেরা ছাত্র হলেন আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ), যিনি পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন মরসুমে মসজিদের প্রাঙ্গণে শিশুকিশোরদের জন্য ক্রীড়াকৌতুকের অনুষ্ঠান হতো। কুস্তি ও তিরন্দাজির মতো ইভেন্টও থাকতো। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে হঠাৎ কোনো সমস্যা তৈরি হলে মসজিদের ভেতরেই বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। জল সংকট থেকে সামরিক সংকটের মুকাবেলার জন্য অর্থ জোগাড় করা, সৈন্য প্রস্তুত করা সবই হতো মসজিদ চত্বরেই। বিদেশ-বিভূঁই থেকে কোনো রাজা বা সম্রাটের প্রতিনিধি দঃ, আসলে তাঁদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, শান্তি চুক্তি সবই হতো মসজিদের ফরশে বসে। দু’একটা বিশেষ ক্ষেত্রে রাজবন্দীদের রাখার ব্যবস্থাও মসজিদে করা হয়েছিল। মসজিদের কার্যকারিতার ও মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ গড়ার এমন অনেক নজীর রেখে গেছেন নবীজি (সাঃ)।
 
পরবর্তীতে যদিও মসজিদের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়েছে, তবে তা একেবারেই নবীজির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এর একটা উদাহরণ হল বিশ্ববিখ্যাত আয্‌হার বিশ্ববিদ্যালয়। যা মূলত একটি জামে’ মসজিদ ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে জামে’ আয্‌হারের ভেতরে ফজর ও আসর নামায বাদ বিভিন্ন জনের হাদিস, তাফ্‌সীর, ফিক্‌হ ও ইতিহাসের পাঠদানের আসর বসতো। ধীরে ধীরে তা বিদ্যাচর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয়। এমন নজীর বহু রয়েছে, বিশেষ করে দামেস্কাস, ইরাক, তিউনিসিয়া ও মুসলিম স্পেনে। এমনকি এখনো মসজিদে নববী ও কাবা চত্বরে ওপেন স্কুলের মতো করে সকাল সন্ধ্যা পাঠদানের আসর বসে। সেখানে পাঠদান করেন নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকেরা ও উভয় মসজিদের ইমাম ও খাতীবেরা। সেখানে যে কেউ পছন্দ মতো শায়েখের আসরে বসে পাঠ গ্রহণ করতে পারে। তবে এটা ঠিক যে ভারত বর্ষের মসজিদগুলোতে এমন দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। হাতে গোনা কিছু মসজিদে এমন আসর বসে। কিছু মসজিদ কমিটি ইদানীং শিক্ষণমূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু অধিকাংশই ধর্ম-শিক্ষা কেন্দ্রিক। তবে ভালো খবর হল কিছু মসজিদ কমিটি ব্যতিক্রমী ভাবনা গ্রহণ করেছে। এমন মসজিদের সংখ্যাটা খুব কম হলেও তার একটা বেশ ইতিবাচক প্রভাব সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত পড়েছে। আর তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মসজিদ কমিটি মেডিকেল প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ইউপিএসসির ফ্রি বা স্বল্প খরচে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। আল্‌-হাম্‌দু লিল্লাহ, তারা তার সুফলও পেতে শুরু করেছে।
 
এ প্রসঙ্গে নারী শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হুসাইনের একটা ঘটনার উল্লেখ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি। একদিন এক নারীবাদী কর্মী বেগম রোকেয়াকে বললেন, আপনি নারী শিক্ষার পক্ষে আওয়াজ তোলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলিম মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। আপনি মনে করেন, শিক্ষাই পারে নারীর প্রতি যে কোনো রকমের উৎপীড়ন ও অত্যাচারকে বন্ধ করতে। নারীকে স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলতে। অথচ আপনি নিজেই মাথায় ওড়না, কখনো ঘোমটা টেনে এর ওর বাড়ি গিয়ে মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য আকুতি করেন। আজব ব্যাপার না! বেগম রোকেয়া মৃদু হেসে ডিপ্লোম্যাটিক কিন্তু বাস্তব একটা উত্তর দিয়েছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন, আমি যদি প্রথমেই আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলি, তাঁর ও তাঁর পরিবারের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলি তাহলে আমার কথা, আমার বক্তব্য তাঁকে বোঝাবো কীভাবে?!
 
আমারও ঠিক তেমনই মনে হয়, কোথাও গিয়ে আপনি যদি প্রথমেই বলেন, গ্রামে মসজিদের কোনো দরকার নেই। আগে স্কুল গড়ে তুলুন। তারপর না হয় ছোটমোটো একখানা মসজিদ বানাবেন। তাহলে অধিকাংশ লোক আপনার বক্তব্যকে সমর্থন করবে না। বরং উলটো রিয়েকশন হবে। তা না করে, আপনি যদি ইসলামে মসজিদের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মসজিদের প্রকৃত রূপ কেমন হওয়া উচিৎ, নবীজির মসজিদ কেমন ছিল, তার ব্যবহার ও কার্যকারিতা কত ব্যাপক ছিল সেসব কথা তুলে ধরেন তা হলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে সংখ্যায় কম হলেও কিছু মসজিদের চত্বর শুধু মক্‌তবে আটকে থাকবে না। সেখানে কোথাও মন্টেসরী তো কোথাও নার্সারি ও কিশলয় গড়ে উঠবে, ইন্‌ শা আল্লাহ্‌।
 
আমার এমন ধারণা যে একেবারেই অমূলক নয়, তা আমার জেলার কিছু মানুষ বহু বছর আগে করে দেখিয়েছেন। আমার গ্রাম থেকে আট-দশ কিমি দূরে তা ঘটেছে। গ্রামের নাম বেলপুকুর। গ্রামে একটা ছোট্ট মাটির মসজিদ ছিল, আমি নিজেও তা দেখেছি, যদিও এখন আর মাটির নেই, বেশ ঝা চকচকে ইমারৎ সেখানে। পাশেই বিশাল মাঠ। ওই এলাকার ঈদগাহ। ঈদগাহের পূর্ব প্রান্তে একটি নিজামিয়া মাদ্‌রাসা। যেটা এক সময় গড়ে উঠেছিল ওই ছোট্ট মসজিদের মুসাল্লীদের প্রচেষ্টায়। পরবর্তীতে সত্তরের দশকে ওই মাদ্‌রাসার পাশে এলাকার কিছু মানুষ মিলে তৈরি করেন একটি হাই মাদ্‌রাসা। ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল সমাজ। এরপর ১৯৮৪-র কোনো এক সময়ে এলাকার কিছু যুবক মিলে মসজিদের ভেতরেই গড়ে তুললেন একটি লাইব্রেরী। বই কিনতে বাড়ি-বাড়ি চাঁদা তুললেন তারা। ভালো ইসলামী বইয়ের সন্ধানে তারা ওপার বাংলার রাজধানী ঢাকা অবধি গেলেন। পাঠক তৈরি হল। চেতনা সঞ্চারিত হল। আরও উদ্যোগ, আরও উদ্যম নিয়ে আরও অনেকে এগিয়ে এল। দিনদিন বইয়ের চাহিদা বাড়তে লাগলো। সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে লাগলো। তাই এবার শক্ত হাতে হাল ধরলেন কিছু মানুষ। সেখান থেকে প্রেরণা নিয়ে সংলগ্ন জমিতে ১৯৮৯ সালে মইনুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে তারা গড়ে তুললেন একটি ইসলামিক নার্সারি। এলাকার ছেলেমেয়েরা দলে দলে স্কুলে ভর্তি হল। শিক্ষার চর্চা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। মইনুদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, রুহুল আমীন, দিদার মণ্ডল, আব্দুল লতিফ প্রমুখ মিলে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। নার্সারিটিকে বৃহৎ রূপ দিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। দীর্ঘ দশ বছরের সাধনার ফল মিলল। ওই নার্সারিটি আল-আমীন মিশনের প্রথম শাখা রূপে উঁচু উঁচু বিল্ডিং, বিশাল মাঠ, ঘন সবুজ দৃশ্য, মনোরম পরিবেশ নিয়ে ইদানীং স্বমহিমায় সমাজকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে সামনের সারিতে। যদিও পার্থিব ও পারলৌকিক চিন্তার সেতুবন্ধনটা তেমন গভীর ভাবে এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে মইনুদ্দিন সাহেব একাই নিরলস ভাবে তার চেষ্টা করে চলেছেন।
 
মুসলিমরা বর্তমানে মসজিদ নির্মাণে কতটা আগ্রহী, কতটা অনাগ্রহী তা নিয়ে উভয় পক্ষেই বেশ কিছু ভ্যালিড পয়েন্ট রয়েছে। শেষে এখানে যে কথাটার উল্লেখ জরুরী মনে করি, তা হল মসজিদ-মন্দির-গির্জা নির্মাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। বিশেষে করে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু শিক্ষা যেহেতু প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার তাই স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য, তা আমরা সবাই জানি। এবং এই শুভ কাজে মুসলিম সমাজ যে এগিয়ে এসে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে রাষ্ট্রের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা কিন্তু একেবারেই বাস্তব যদিও সে বিষয়ে তেমন আলোচনা বা লেখালেখি চোখে পড়ে না। আমার জেলার এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বেস আন্‌ নূর এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। সংস্থার সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম সাহেব নিজেও এ বিষয়ে গবেষণায় বেশ আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার লোকজন নিয়ে কাজে নেমেও পড়েছিলেনকিন্তু অর্থ ও উপযুক্ত লোকের অভাবে মাঝ পথে গবেষণার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে তারা দক্ষিণ দিনাজপুরের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্কুলগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য পেয়েছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। কুশমুণ্ডি, বংশিহারি, হরিরামপুর, গঙ্গারামপুর ও গাজলের সিনিয়ার মাদ্‌রাসা-হাই মাদ্‌রাসার পাশাপাশি বহু স্কুল-কলেজ এমন রয়েছে যার জমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম। তাই আমি মনে করি, আমরা যদি সম্বিৎ পাত্রা স্টাইল ছেড়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা-সমালোচনা করি। তাহলে হয়তো ভালো কিছু, গঠনমূলক কিছু তৈরি করতে সমাজকে অনুপ্রাণিত করতে পারবো। আল্লাহু ওয়ালিউত্‌ তাওফীক।   
 

No comments:

Post a Comment