আমি তখন খুব
ছোট। ক্লাস টু-থ্রি’তে পড়ি; পাশের কদমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই সাথে সকাল
বেলা গ্রামের মক্তবেও। গ্রামে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল; তবে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল
গুটি কয়েক বাড়িতে। সবার তো আর সামর্থ্য ছিল না। সে-সময়ে গ্রামের মসজিদটিতেও
বিদ্যুতের সংযোগ সম্ভব হয়নি। রাত্রিবেলা মাগ্রিব, এশা ও ফাজ্রের নামাযের সময়
আছোল কাকু কখনো হ্যারাকিন তো কখনো টুকটুকি জ্বালাতেন। কখনো আবার নিজের বাড়ি থেকে
নম্ফ নিয়ে আসতেন। বাম পাশে নির্মিত মিনার-আকৃতির উঁচু জায়গায় চেপে সর্বস্ব শক্তি
দিয়ে জোরে আযান দিতেন। কিন্তু তাঁর আওয়াজ মসজিদ লাগোয়া গুটি কয়েক বাড়ির চৌহদ্দিতেই
আটকে থাকত। তাই তখন রমযান মাস আসা মানে
বাড়ির বাচ্চাদের বাড়তি দায়িত্ব- মাগরিবের আযানের বার্তা বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। সুতরাং
সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসলে কেউ লুকোচুরি-বুড়ি ছোঁয়া-কিতকিত-গাদি ছেড়ে, তো কেউ
ছেঁড়া প্লাস্টিক ও দড়ি দিয়ে বানানো ফুটবলটা ফেলে রেখে, আবার কেউ গাছের ডাল মেঠে
তৈরি করা ব্যাটটা দাঁড় করিয়ে রেখে সবাই মসজিদের পাশে কলতলায় গিয়ে হাজির হতাম।
‘গাঁ-পোখোরিয়া’র নালায় নেমে জলকেলি করতাম। চলতো হুড়োহুড়ি। জামা টানাটানি। মুখ
ভ্যাংচানো। নাম বিকৃতি করে তো কখনো কুনামে ডেকে খেপানো। আরও কতকিছু। কিন্তু যেই
আছোল কাকু মাগ্রিবের আযান দিতেন। সবাই যে-যার বাড়ির দিকে দৌড়াতাম। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে। প্রাণপণে। সঙ্গে কণ্ঠ উজাড় করে চেঁচাতাম- “আ—যা—ন হই
গেইছে—। এফ্তা—র করি নে—ও”। কোনরকমে দরজাটা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢুকতাম।
মা-বাবা আমার
কণ্ঠস্বর শুনে আগেই ইফতার করে নিতেন। বাড়ি ঢুকে সোজা ছুটে যেতাম মায়ের কাছে।
স্বর্গ-আঁচলে মুখ মুছতাম। আর মা তখন কী যেন বিড়বিড় করতে করতে আমার মুখে এক চিমটে
আদা-কালাই পুরে দিতেন। হ্যাঁ তখন তা-ই দিয়ে লোকে ইফতার করতো। এমনকি এখনো অধিকাংশ
গ্রামে লোকে এক বাটি মুড়ি, সঙ্গে বাসি তরকারি বা শাক ভাজা। বরাত ভালো হলে, অবস্থা ভালো হলে, একটু ছোলা-মটরের ঘুগনি। কখনো বা হাট থেকে আনা
গরম গরম দুটো জিলিপি, তো কখনো মোড়ের দোকানের দু’ পিস পেঁয়াজি-বেগুনী। শহুরে ‘ইফতার
পার্টি’র এই বাহারি ইফতার গ্রাম-বাংলার শতকরা পঁচানব্বই জনের জোটে না, আমি হলফ করে
বলতে পারি...!
অনেক বছর পর,
বড় হয়ে দু’ চারটে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম। আদা-কালাই-র থেকে খেজুর বা
জল দিয়ে ইফতার করাই উত্তম। কারণ, আমাদের নবি (মুহাম্মদ সা) নিজে খেজুর না থাকলে জল
দিয়ে ইফতার করতেন এবং অনুসারীদেরকেও তা-ই আদেশ করেছেন [মুস্নাদ আহ্মাদ- ১২২৬৫,
আবু দাউদ- ২৩৫৬]। আরও জানতে পারলাম, মা আমাকে ইফতার করানোর সময় বিড়বিড় করে
ইফতারের দুআ (আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিয্ক্বিকা আফ্তার্তু [আবু দাউদ-
২৩৫৮]) পড়তেন। কয়েক বছর আগে, হঠাৎ করে একদিন জানতে পারলাম, ঐ হাদিসটির
বর্ণনাসূত্রে দুর্বলতা রয়েছে; যার কারণে হাদিসটির প্রামাণ্য হওয়ার যোগ্যতায় কমতি
দেখা দিয়েছে। জার্হু ওয়া তাদীল (বর্ণনাকারীদের সত্যতা পরীক্ষা করার ব্যাকরণ)-এর
বিদ্বানদের মতামত ও সিদ্ধান্তও দেখলাম। সত্যিই বর্ণনা-ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে
হাদিসটি দুর্বল। তবে ইফতারের আরও একটি পঠিতব্য দুআ রয়েছে; যেটি ব্যাকরণের বিচারে
হাসান (প্রামাণ্য)। দুআটি হল- “যাহাবায্ যামাউ ওয়াব্-তাল্লাতিল্ উরুক্বু ওয়া
সাবাতাল্ আজ্রু ইন্ শা আল্লাহ্” [আবু দাউদ- ২৩৫৭। শেখ আল্বানি (রাহ্) হাদিসটিকে
হাসান বলে মন্তব্য করেছেন]।
মা এখন সত্তরের
দোরগোড়ায়। শরীর, স্মৃতিশক্তি দিনদিন দুর্বল হয়ে চলেছে। এ বয়সে নতুন কিছু রপ্ত করা
সত্যিই বড় কঠিন। অনুশীলন তো আরও। ইদানীং, প্রতি বছর রমযান মাসের শুরুতে মেছুয়া-নিউ
মার্কেট চষে মা’র জন্য আলাদা করে ভালো এবং নরম খেজুর কিনে লোক মারফৎ পাঠিয়ে দিই। মাসের শেষে ঈদের
ছুটি পেয়ে বাড়ি পৌঁছোই শেষ রোযার দিন। বিকেলে মা’র সাথে আমিও ইফতার সামগ্রী সাজাই। পাশের বাড়ির
দু’ চারজনকে নেমন্তন্নও করি। কখনো আবার পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে সম্মিলিত ইফতারের
আয়োজনও করা হয়। সবাই বসে অপেক্ষা করি আযানের। সাথে কেউ দুআ-দরূদ পড়ি, কেউ
ইহলোক-পরলোকে মঙ্গল কামনা করি, কখনো সমস্বরে বিশ্ব শান্তির জন্য রবের নিকট
প্রার্থনাও করা হয়। অতঃপর মসজিদের মাইক থেকে ‘আল্লা—হু আক্বার’ ধ্বনি কানে আসতেই সবাই খেজুর মুখে
দিয়ে ইফতার করি। কিন্তু মা, সামনে খেজুর থাকা সত্ত্বেও কেন জানিনা ঐ এক চিমটে
আদা-কালাই আগে মুখে দেয়, এখনো। তারপরে খেজুর। জিজ্ঞেস করলে বলে– “ও—মা, মনে থাকে না,
বেটা...!”
অসাধারন..... নিজের অজান্তেই কখন যেন চোখে জল চলে এসেছিল...
ReplyDeleteMamu osadharon likhecho...
ReplyDeleteHeart touching
ReplyDeleteহৃদয় ছুঁয়ে যায়......
ReplyDeleteKichu Boler ney ...sotty .. Allah apnk uttom protidan dik... present /future every day jno notun valo kichu sekhar/ korer toufik dan koruk
ReplyDelete