অচেনা পথে চেনা আশ্রয়
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
প্রতিদিনের মতোই, স্কুল থেকে
বেরিয়ে অংকের অনুরাধা ম্যাডামকে নামিয়ে দিল রাস্তার মোড়ে। তারপর স্বাভাবিক স্পীডে স্কুটি চালিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হল সালমা।
সে এখন বাড়ি থেকে আট কিলো মিটার দূরে বাজিতপুর হাই স্কুলে ইতিহাসের দিদিমণি। আগে
সে গ্রামেরই প্রাইমারীতে শিক্ষকতা করত। আট মাস হল অনার্স-পিজি ক্যাটাগরিতে জয়েন
করেছে ওই স্কুলে। এই ক’দিনেই বেশ ভাব হয়েছে তার অনুরাধা-মালবিকা-রিনা
টুডু-সুপ্রিয়াদের সাথে। তারা একসাথে টিফিন করে। মাঝেমধ্যে স্টাফরুমের এক কোণে বসে
এটা-সেটা নিয়ে গল্পগুজব করে, আড্ডা দেয়।
রাস্তার ওই মোড় থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে
মোল্লার পুর। মিনিট পনেরোর মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেল সালমা। কিছু
দূর যাওয়ার পর আচমকা দেখল, কিছুটা
দূরে দক্ষিণ দিকের সরু রাস্তা দিয়ে
উন্মত্তের মতো ছুটছে একদল লোক।
কারো হাতে কাটারি,
কারো হাতে বল্লম, কারো
হাতে তলোয়ার; ছেলে-ছোকরাদের হাতে রয়েছে লাঠিসোটা। ঝপাঝপ বন্ধ হচ্ছে দোকানের ঝাপ। মানুষজন উদ্ভ্রান্তের মত ছুটছে আর সমানে চিৎকার করছে,“দাঙ্গা
লেগেছে...দাঙ্গা”। অন্যদিকে, দাঙ্গাবাজের দল অতি চেনা কিছু শব্দ-বন্ধনী দিয়ে বাতাসে স্লোগানের ঢেউ
তুলছে। আর সেই সাথে হুঙ্কার ছাড়ছে, “আজ
কিসিকো নেহি ছোড়েঙ্গে, সাব্কো জ়িন্দা জালা দেঙ্গে”।
মোল্লার পুর পুরোটাই হিন্দু পাড়া। এ পাড়ার কাউকে চেনে না সালমা। তাই
কী করবে? কোথায় যাবে? কিছুই বুঝতে পারছিল না। নিরুপায় হয়ে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ইতিহাসের দিদিমনি হওয়ায় একে একে হাজারো ছবি ভেসে উঠতে লাগল তার
মনে, স্লাইড শো-এর মতো করে। ৪৬-এর
কোলকাতা দাঙ্গা থেকে ২০০২-এর গুজরাট ম্যাসাকার,
সর্বত্র মহিলাদের
কীভাবে টার্গেট করা হয়েছিল সে-সব ছবি। মুহূর্তেই আতঙ্কের স্রোত ছড়িয়ে পড়ল তার শিরা-উপশিরায়। মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল ঠাণ্ডা শীতল বাতাস।
অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকাল
তার চারদিকে। কোথায় যাবে,
কাকে ভরসা করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। এমন সময় আস্তে করে মন্দির-লাগোয়া
বাড়িটার ছোট্ট দরজাটা খুলে
গেল। বেরিয়ে এলো নীলপাড় সাদা শাড়ি
পরা এক বৃদ্ধা। সালমাকে
উদ্দেশ্য করে মৃদু
স্বরে ডাকল,“ও দিদিমনি, চলে এসো। দেখছো না বাইরে কী
অবস্থা!”। সালমা স্কুটিটা নিয়ে দ্রুত তাঁর বাড়িতে ঢুকল।
ঢুকেই তাঁর হাত ধরে
ডুকরে কেঁদে উঠল, “মাসিমা আপনি না থাকলে আজ কী যে হতো আমার!”।
সালমার
ওই কথা শুনে ভদ্র মহিলার চোখের সামনে তখন একে একে ভেসে উঠেছে কতশত স্মৃতি— দেশভাগের,
দেশান্তরী হওয়ার, রাতের অন্ধকারে ফরিদপুর ছাড়ার, ৪৭-এর সংকটময় সেই দিনগুলির। আপনা
থেকেই চোখের কোণ ভিজে গেল তার। নিজেকে শামলে নিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। তারপর সালমাকে বুকে টেনে ধরে বলল— “মা’রে, দাঙ্গা
কীভাবে বহু মেয়েকে জীবন্ত লাশে পরিণত করে আমি জানি!”
০৫-০৪-২০১৮
কোলকাতা-২৩
No comments:
Post a Comment