Thursday 11 April 2019

বদিউর রহমানঃ মীরা, কেমন আছ?




মীরা, কেমন আছ?
বদিউর রহমান

“মীরা কেমন আছ?” কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। সে তখন সস্তা মদের নেশায় টলতে টলতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। চুলগুলো অবিন্যস্ত, ক্ষুধাতুর শীর্ণকায় শরীরটাকে টানতে টানতে। মুহূর্তের জন্য তার থেমে যাওয়ায় আমার ধারণা সেও বিলক্ষণ আমাকে চিনতে পেরেছে। হয়তো সেও কুশল জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল। ছোটবেলার এক খেলার সঙ্গীকে।
আমাদের বাড়ির অনতিদূরে আমাদের একটা পুকুর আছে। পশ্চিম পাড়ে বেশ কিছু আমগাছ। একপাশে রউফদের মাটির ঘর। ওর বাবা একজন রাজমিস্ত্রী। বিহারের লোক। নন্দীবাবু তাদেরকে ঐ জায়গায় থাকতে দিয়েছিলেন।
নন্দীবাবুর বিশাল রাইস মিল। ধান শুকানোর জন্য বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সিমেন্ট করা ঘেরা চাতাল। সেই চাতাল, দেওয়াল ইত্যাদিতে প্রায়শই মিস্ত্রী কাকুর কাজ। তাই তাদেরকে নন্দী বাবুর ঐ জায়গায় বসবাস করতে দেওয়া। মিস্ত্রী কাকুর ছেলেমেয়ে—আনোয়ার, রউফ, যুবাইদা কাউকে কখনো স্কুলে যেতে দেখিনি। তারা ছোট থেকেই লোকের বাড়ি কাজ করত। আনোয়ার ভাই আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েক বছর ছিল। তার ছোট ভাই রউফ ছিল আমার বয়সী। সে ছিল ভীষণ দুরন্ত ও সাহসী। যুবাইদা তাদের ছোট্ট ফুটফুটে বোন। সুন্দর মুখশ্রী। গায়ের রঙটা চাপা হলেও ভারি মিষ্টি ছিল তার চেহারা। কে বলবে যে সে এক রাজমিস্ত্রীর মেয়ে।
রউফদের বাড়ির কাছে একটা আমগাছের ডালে বাঁধা ছিল একটা দোলনা। কখনো কখনো খেলার জন্য রউফদের বাড়ি যেতাম। দোলনাটা ছিল বিশেষ আকর্ষণ। আমরা পালা ক’রে দুলতাম। সেখানে মাঝেমধ্যেই আর একটা মেয়ে আসত। নাম তার মীরা। সে দোলনা চাপায় খুব পটু। আমরা যত জোরে তাকে দোলা দিতাম সে নির্ভয়ে দোল খেত আর ততোধিক জোরে হাসত। তার হাসিটা মনে হতো পর্বত শিখর থেকে ঝরে পড়া প্রবল স্রোতের ঝর্ণা। অমন নির্মল হাসি খুব কম শুনেছি। মীরা ছিল ছিপছিপে শ্যামবর্ণের। কাটা কাটা নাক চোখ। হাসলে পরে সারিবদ্ধ উজ্জ্বল সাদা দাঁতগুলো মুক্তমালার মতো দেখাত।
একদিন বিকেলে দোলনা চড়ার পর রউফ বলল, “চল বালির পাহাড়ে”। নন্দী বাবু বালির খাদ করছে আর বালিগুলো মাটির তলা থেকে তুলে পাহাড়ের মতো স্তূপ করা বালির পাহাড় ছিল অনতিদূরে। অতএব সেখানে যেতে কোনো বাধা ছিল না।
রউফের দেখাদেখি আমরা সকলে বালির পাহাড়ে উঠলাম। অনেক উঁচুতে উঠে রউফ নীচের বালিতে দিল ঝাঁপ। আমরাও বালিতে ঝাঁপ  দেওয়া খেললাম। বালির স্তূপে ঝাঁপ দেওয়ায় কোনো কষ্ট নেই। আছে বেশ শিহরণ। এক নতুন ধরণের খেলা। বেশ উপভোগ করলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমরা সকলে যে যার বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা দিতে চাইলে মীরা বলল “আমি এখন বাড়ি যাব না। বাড়িতে এখন লোক থাকে। মা মারবে।” তাকে বললাম, “সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসবি না?” সে বলল, “আমি পড়ি না। তোদের মতো স্কুলেও যাই না।” ভেবেছিলাম ওর কী মজা! পড়াশুনোর কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই। দিনরাত শুধু খেলা আর খেলা।
তারপর যত বড় হয়েছি আমার খেলাধূলা তত কমেছে পড়াশুনোর চাপে। বিশিষ্ট বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ছাড়তে হয়েছে নিজের গ্রাম। দীর্ঘদিন কলকাতা শহরে থাকতে থাকতে ভুলে গিয়েছিলাম অনেক কথা, বহু চেনা-জানা মুখ। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর পর হলেও মীরাকে চিনতে ভুল করিনি যদিও ছেলেবেলার মীরার সঙ্গে বর্তমান মীরার আকাশ-পাতাল তফাৎ। বর্তমান মীরা বিগত দিনের জীবন্ত প্রেতাত্মা। চেনা সত্ত্বেও তাকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। ছেলেবেলায় বুঝিনি, বড় হয়ে জেনেছিলাম ওরা নিষিদ্ধ এলাকার মানুষ। এক সময় মীরা ছিল নির্মল, নিষ্পাপ। খেলা করেছি নির্দ্বিধায়। এখন তাকে আমার জিজ্ঞাসা করা যাবে না “মীরা কেমন আছ?”

০২-০৬-২০০৭
সল্টলেক, কলকাতা


1 comment: