Friday 26 April 2019

নাজিব মাহফুযঃ বন্দীর উর্দি



বন্দীর উর্দি
মূল- নাজিব মাহফুয, মিশর
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

[নাজিব মাহ্‌ফুয (১৯১১ – ২০০৬)। কায়রোএকটি ধার্মিক পরিবারে জন্ম। অংক ও বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া শুরু হলেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন দর্শন নিয়ে কর্মজীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ উচ্চতর পদ অলঙ্কৃত করে ১৯৭১ সালে অবসর নেন। লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবনে তিনের দশকের মাঝামাঝিতে। প্রথম উপন্যাস আবাসুল্‌ আক্বদার (নিয়তির নিষ্ফলতা) প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫, ছোটগল্প ২২৩টি এবং ছোটগল্পের সংকলন ১৯টি। এছাড়া রয়েছে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ৭টি নাটক, ২৬টি চিত্রনাট্য এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাঁর উপন্যাস এবং গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ৩০টিরও অধিক। অসামান্য সাহিত্যকৃতির জন্য বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এমনকি ১৯৮৮ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি 'সুলাসিয়্যাতুল-ক্বাহেরাহ্‌’ (কায়রো ট্রিলজি বা কায়রো তিনগ্রন্থি, ১৯৫৬-৫৭তে প্রকাশিত)-এর জন্য তবে মৌলবাদীদের হাত থেকে তিনিও নিস্তার পাননি ১৯৯৪ সালে, বিরাশি বছর বয়সে, কায়রো শহরে নিজ বাড়ির কাছেই আক্রন্ত হন তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেও ঐ আক্রমণের ফলে জখম হয় তাঁর ডান হাতের স্নায়ুএকটানা কয়েক মিনিটের বেশি আর লিখতে পারেতেন না অবশেষে ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট কায়রোতে মৃত্যু হয় তাঁর] 

যাকাযিক স্টেশনে ট্রেনের সময় হয়ে গেছে জাহ্‌শা সিগারেটের বাক্সটা গুছিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তুত হতে লাগল ট্রেন এসে দাঁড়াতেই স্টেশনটা ভোল পাল্টে আস্ত একটা বাজারে পরিণত হ মানুষ এধার-ওধার ঘোরাফেরা করে এটা-সেটা কিনতে লাগলো ট্রেন এসে যখন প্লাটফর্মে দাঁড়াল, ছোট্ট জাহ্‌শা তাঁর ক্ষুদে অথচ অভিজ্ঞ চোখে খদ্দের খুঁজতে আরম্ভ করল

সিগারেট বেচতে তার একদম ভালো লাগে না তাই কেউ তার পেশা জানতে চাইলে, ভীষণ মন খারাপ করে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে প্রশ্নকর্তাকেই অভিশাপ দেয় তারপর অভিশাপ দেয় নিজের কপালকে। আর মনে মনে ভাবে, যদি ইচ্ছেমতো চাকরি করার স্বাধীনতা থাকতো, তাহলে সে নিশ্চয়ই কোনো ধনী লোকের গাড়ি চালাতো তাতে সে পেতো চকচকে, পরিষ্কার জামাকাপড়, অভিজাত লোকেদের মত রকমারি খাবার। কী শীত, কী গ্রীষ্ম ঘুরতে যেত নানা জায়গায়! দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে এত ঝক্কি পোহাতে হত না তাকে ধুর! এই জীবনে না আছে শান্তি, না আছে কোনো আনন্দ! 

কোনো এক আমলার গাড়ি চালায় ড্রাইভার আলগুর ক’দিন আগে বিপুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে তল্লাটের সবচেয়ে সুন্দরী যুবতী নুব্‌ওয়ার কাছে সে প্রেম নিবেদন করছিল আর হাত নেড়ে নেড়ে বলছিল— ‘নুব্‌ওয়া, খোদার কসম, তোমার জন্য শিগগিরি একটি আংটি নিয়ে আসবো আমি নিজে হাতে তোমার আঙুলে সেটা পরিয়ে দেব’ নুব্‌ওয়া লজ্জা পেয়েছিলো, ভুবন ভোলানো হাসি হেসে ওড়নাতে মুখ ঢেকেছিলো। আর তার ঘন-কালো চুল হাওয়ায় দোল খাচ্ছিলো। সে-দিন জাহ্‌শা সেখানেই ছিলো; তাদের আশেপাশেই কোথাও সে দেখে ফেলেছিল তাদের এই প্রেমের দৃশ্য নুব্‌ওয়ার সেই হাসি যেন তীর হয়ে বিঁধেছিল জাহ্‌শার বুকে। ওর বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা হচ্ছিল বুকের ভেতর আর আলগুরের ভাগ্য দেখে ভীষণ হিংসা হচ্ছিলো  

সে-দিন থেকে জাহ্‌শাও নুব্‌ওয়ার পেছন পেছন ঘুরতে আরম্ভ করলো নুব্‌ওয়া যে-পথে চলাফেরা করে, সিগারেটের বাক্সটা নিয়ে সারাদিন সে-পথেই বসে থাকে জাহ্‌শা তৃষ্ণার্ত চোখে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়ায় হঠাৎ একদিন নুব্‌ওয়াকে একাকী পেয়ে আলগুরের মতো করে বলে উঠলো- 'নুব্‌ওয়া, আমি তোমার জন্য আংটি নিয়ে আসব একদিন!' কিন্তু তার কথা শুনে নুব্‌ওয়া লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ না-ঢেকে তার দিকে এক নজর তাকালো এবং অবজ্ঞার স্বরে বললো— আগে নিজের জন্য একপাটি ভালো জুতো কেনো।” 

কথাটা শুনে নিজের পায়ের দিকে তাকালো জাহশা পায়ে এত পুরু হয়ে ময়লা জমে আছে, মনে হচ্ছে যেন দু’ পায়ে উটের চামড়ার খসখসে মোজা পরে আছে তার উপর জুতোর অর্ধেকটা ক্ষয় হয়ে গেছে কাপড় নোংরা মলিন মুখ,  টুপিটা ছেঁড়া এবং পুরাতন। দীর্ঘশ্বাসের সাথে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো— ‘হায় পোড়া কপাল আমার!’তারপর সিগারেটের বাক্সটা আঁকড়ে ধরে মনে মনে ভাবতে লাগল— ‘ইস্‌ যদি আলগুরের মতো ড্রাইভার হতে পারতাম! কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? গরিবের স্বপ্ন তো স্বপ্নই থাকে!’ অতঃপর নিজের কল্পনা, স্বপ্ন ও হতাশাকে সেই ছেঁড়া পকেটে পুরে ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে অপেক্ষা করতে লাগলো ট্রেনের।

অনেক দূরে দেখা দিল একটা ধোঁয়াটে আকৃতির কিছু ক্রমশ নিকটে আসছে...; ট্রেন আসছে! ধীরে ধীরে বগিগুলো স্পষ্ট হতে লাগলো একসময় কর্কশ ও বিকট শব্দ তুলে ট্রেনটা প্লাটফর্মে এসে থামলো। জাহ্‌শা সিগারেটের বাক্সটা নিয়ে দৌড়ে গেলো বগির কাছে দেখে অবাক, সবক’টা দরজার সামনে একজন করে সশস্ত্র সিপাহী পাহারা দিচ্ছে জানালা দিয়ে উঁকি মারছে ভিনদেশী কিছু চেহারা আর উদ্বিগ্ন ক'জোড়া চোখ। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, এরা সবাই যুদ্ধবন্দী ইতালীয় সৈনিক এদেরকে এখন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

জাহ্‌শা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ বন্দী সৈনিকদের মলিন-বিবর্ণ মুখগুলো দেখে বুঝতে পারল, এরা সবাই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হতাশাগ্রস্থ এদের কেউই সিগারেট কিনবে না; এদের কারো কাছে কেনার মত পয়সাও নেই। তবুও, সিগারেটের বাক্সটা উঁচু করে এ-বগি থেকে সে-বগি ঘুরে এলো কয়েকবার যদি তাদের কেউ কিছু কেনে; কিন্তু তারা সবাই নিজেদের মধ্যে গল্প করতে ব্যস্ত ছিলো কয়েকজন বন্দী ছাড়া আর কেউ তার দিকে তাকায়নি ঐ ক'জন ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর হাতের দিকে; যেন বাক্সসুদ্ধ গিলে খাবে। বিরক্ত হয়ে যখন সে ফিরে যেতে লাগল পেছন থেকে শুনতে পেল এক বন্দীর কণ্ঠ, ভাঙাচোরা আরবি টানে— “সাজায়ের (সিগারেট)”!   

জাহ্‌শা অবাক হয়ে, সন্দেহভরা চোখে তাকালো তার দিকে তারপর বৃদ্ধা ও তর্জনীর মাধ্যমে ইঙ্গিত করল— পয়সা? বন্দী বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে জানালো— পয়সা আছে। জাহ্‌শা এগিয়ে গেল জানালার কাছে গিয়ে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়ালো যাতে কোনো বন্দী ছোঁ মেরে সিগারেট নিতে না পারে ইতালয় সৈনিকটি শান্তভাবে গায়ের জ্যাকেটটা খুলে এগিয়ে দিল জাহশার দিকে— এই নাও পয়সা।  

জাহ্‌শা অবাক লাগল। ব্যাপারটা অমন হবে সে আশা করেনি। লোভাতুর দৃষ্টিতে জ্যাকেটটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। খাকি রঙের একটা পোশাক। তাতে সোনালি রঙের বড় বড় গোল গোল বোতাম লাগানো বেশ ভালো লাগল তার। কিন্তু বন্দীকে তা বুঝতে দিল না পাছে ঠকিয়ে নেয় 'নিতান্ত সাধারণ একটা জিনিস' এরকম ভাব দেখিয়ে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে জ্যাকেটটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল সৈনিক ভ্রু কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠল— মাত্র এক প্যাকেট! না না, দশ প্যাকেট চাই, দশ প্যাকেট সিগারেট জাহ্‌শা মাথা নেড়ে পিছিয়ে এলো। সৈনিক সুর নরম করে— আচ্ছা, নয় প্যাকেট!
জাহ্‌শা নির্বিকার, বেপরোয়া হয়ে অন্যদিকে হাঁটা দিল।
—আরে দাঁড়াও, আট প্যাকেট দাও!
জাহ্‌শা মাথা নেড়ে জানালো, ‘হবে না’   
—তাহলে সাত প্যাকেট দাও।

জাহ্‌শা আবারও পূর্বের মতো না-সূচক ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বগির কাছ থেকে সরে এলো। সৈনিক এবার নেমে এলো ছ’য়ে। প্লাটফর্মের দিকে যেতে যেতে সৈনিক নেমে এলো পাঁচে হাত নেড়ে ‘হবে না’ জানিয়ে টুলটার উপরে বসার উপক্রম করেছে, ততক্ষণে সৈনিক চারে। কিন্তু জাহ্‌শা এমন ভান করল যেন শুনতেই পায়নি তার কথা। টুলের উপর বসে মেজাজে একটা সিগারেট ধরালো তারপর একটা লম্বা সুখটান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। এবার সৈনিকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে অস্থির হয়ে উঠল ছটফট করতে লাগল বগির ভেতর। সিগারেট না পেলে যেন মারা যাবে এবার সে কাকুতি-মিনতি করতে আরম্ভ করল— এই যে ভাই, এই, তিন প্যাকেট দিলেই জ্যাকেট তোমার!

জাহ্‌শা তখনো নির্বিকার। এমন ভাব দেখাল যেন জ্যাকেটের প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই সিগারেটের সুখটানই যেন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অবশেষে বন্দী-সৈনিক পরাজিত কণ্ঠে দুপ্যাকেটের দাবী জানালো এবার জাহ্‌শা অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু নড়ে উঠল। সৈনিক জ্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে হাত পাতলো অস্থিরভাবে—এবার তো দাও।

জাহ্‌শা বগির কাছে গিয়ে দু’প্যাকেট সিগারেট সৈনিকের হাতে ধরিয়ে দিল তারপর জ্যাকেটটা বগলদাবা করে ফিরে এলো প্লাটফর্মে তখন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে বিজয়ের আনন্দঠোঁটে মৃদু হাসি। সিগারেটের বাক্সটা টুলের ওপর রেখে পরে নিল জ্যাকেটটা। একটু বড়, ঢিলেঢালা। তাতে কিছু যায় আসে না। দু’প্যাকেট সিগারেটের বদলে অমন একখানা জিনিস পেয়েছে— কে বিশ্বাস করবে সে কথা! এবার বাক্সটা কাঁধে ঝুলিয়ে, বুক চিতিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। চোখের সামনে তখন সুন্দরী নুব্‌ওয়ার চেহারা ভাসছে আর মনের ভেতরে আত্মবিশ্বাসের স্বরএবার আর নুব্‌ওয়া আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না আমার জামাকাপড় নিয়ে হাসাহাসিও করতে পারবে না। এমন জিনিস কি আছে আলগুরের কাছে? ছ্যাঃ, এমন জ্যাকেট ওর চোদ্দগুষ্টিও দ্যাখেনি!   

‘ওহ হো’— জাহ্‌শার হঠাৎ মনে পড়ে গেল— আলগুর হতভাগাটা তো জ্যাকেটের সাথে প্যান্টও পরেছিল। এবার ভাবতে লাগল,একটা প্যান্ট কীভাবে জোগাড় করি?’ জ্যাকেট পেয়ে যে আনন্দ হয়েছিল তার পুরোটা ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে মন-মস্তিষ্কজুড়ে তখন শুধু প্যান্টের চিন্তা। হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল চোখে-মুখে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত হাসি। ট্রেনের বন্দীদের ওপর নজর বুলাতে লাগলো। তারপর ট্রেনের কাছে গিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করল— সিগারেট, সিগারেট, পয়সা না থাকলে প্যান্ট দিলেও চলবে! সিগারেট, সিগারেট, প্যান্টের বদলে সিগারেট!  

কয়েকবার আওয়াজ দেওয়ার পর যখন কোনো সাড়া মিলল না জাহ্‌শার মনে হল, হয়তো বন্দীরা ওর কথা বুঝতে পারছে না। একটু ভেবে, সিগারেট এবং পরনের জ্যাকেটটার দিকে ইশারা করে আওয়াজ দিল এরকম সাংকেতিক বিজ্ঞাপনের সুফলও মিলল তাড়াতাড়ি। এক সৈনিক লাফাতে লাফাতে জ্যাকেট খুলতে লাগল। জাহ্‌শা আঙুল দিয়ে দেখাল— জ্যাকেট না, ও প্যান্ট চায় লোকটা বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে, শেষে প্যান্ট খুলে ধরিয়ে দিল তার হাতে।  

আর কী চাই তার! খুশিতে নাচলো কিছুক্ষণ তারপর প্লাটফর্মে নিজের জায়গায় ফিরে মুহূর্তের মধ্যে পরে নিল প্যান্টটা এবার দেখতে পুরো ইতালীয় সৈনিকদের মতো লাগছে ভাবতে লাগল, ‘আর কী নেওয়া যায়? টুপি...? কিন্তু, এরা তো কেউই ফেজ টুপি পরে নেই সবার মাথা খালি। অবশ্য সবার পায়ে জুতো তাহলে..., জুতো? আলগুর হারামজাদাকে হারিয়ে বাজিমাত করতে হলে এক জোড়া জুতো দরকার! আবার সে সিগারেটের বাক্সটা হাতে নিয়ে বগির কাছে গিয়ে চেঁচাতে লাগল, সাথে পায়ের দিকে ইঙ্গিত করতে থাকল—সিগারেট, জুতোর বদলে সিগারেট, চাই কারো জুতোর বদলে সিগারেট! 
   
কিন্তু নতুন কোনো খদ্দের পাবার আগেই কর্কশ শব্দে হর্ন বেজে উঠল সময় হয়ে গেছে, এখনই ট্রেন ছেড়ে দেবে। বন্দীসৈনিকরাও গল্প ছেড়ে সজাগ হল। ততক্ষণে চারিদিকে আঁধার হয়ে এসেছে। আকাশে পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করছে; বাড়ি ফিরছে সবাই স্টেশন চত্বরে আকাশটা ধীরে ধীরে ডুবে যেতে লাগল অন্ধকারের গহ্বরে। ঠিক তেমনই জাহশার মনের আকাশ হতাশার এক খণ্ড মেঘে আচ্ছন্ন হতে লাগল। মন খারাপ করে সে দাঁড়িয়ে রইল প্লাটফর্মে ওর আর জুতো পাওয়া হল না। ট্রেন চলতে শুরু করেছে, হঠাৎ সামনের বগির পাহারাদার সিপাহীর নজর পড়ল জাহশার উপর সে রেগেমেগে প্রথমে ইংরেজিতে তারপর ইতালীয় ভাষায় খিস্তি করে বলল — এই শালা, ট্রেনে ওঠ! তাড়াতাড়ি ওঠ বলছি!

জাহ্‌শা বুঝতে পারলো না সিপাহী কী বলছে ও তখন সিপাহীর নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে সিপাহী চাইলেও ধরতে পারবে না তাকে তাই মন থেকে হতাশা ঝেড়ে ফেলতে সিপাহীর অঙ্গভঙ্গি নকল করে মুখ ভ্যাংচালো। ওদিকে, ট্রেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিলো; আরও দূরে... সিপাহী রেগেমেগে এবার আরও জোরে চিৎকার করল— হারামজাদা ট্রেনে ওঠ, নইলে খবর আছে তোর, বলে দিলাম!

জাহ্‌শা ঠোঁট উল্টে আরেকবার মুখ ভ্যাংচালো তারপর ট্রেনের দিকে পিঠ করে হাঁটতে লাগল নিজ গন্তব্যের দিকে সঙ্গে সঙ্গে সিপাহীটি বন্দুক তুলে গুলি করল ওর পিঠে। নিমেষেই বন্দুকের কান-ফাটানো শব্দের নীচে চাপা পড়ে গেল জাহ্‌শার বিস্ময়মাখা আর্তনাদ। প্লাটফর্মেই ঢলে পড়ল তার শরীর হাত থেকে বাক্সটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেটগুলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে। উপুড় হয়ে পড়ে রইলো তার নিথর দেহ।

[হামাসুল্‌ জুনূন ১৫৭ – ১৬২]

[সৌতি বর্ষ ২, সংখ্যা ১, শারদীয়া ১৪২৬, সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত] 


بذلة الأسير
نجيب محفوظ
كان جحشة بائع سجائر أول السابقين إلى محطة الزقازيق حين اقترب ميعاد قدوم القطار. وكان يعد المحطة بحق سوقه النافقة. فيمضى على الإفريز فى نشاط منقطع النظير يتصيد بعينيه الصغيرتين الخبيرتين. ولعل جحشة لو سأل عن مهنته للعنها شر لعنة لأنه كبقية الناس برم بحياته ساخط على حظه. ولعله لو ملك حرية الاختيار لآثر أن يكون سائق سيارة أحد الأغنياء، فيرتدى لباس الأفندية، ويأكل من طعام البك، ويرافقه إلى  الأماكن المختارة فى الصيف والشتاء، مؤثرا من أعمال الكفاح فى سبيل القوت ما هو أدنى إلى  التسلية والملهاة. على أنه كانت له أسبابه الخاصة ودواعيه الخفية لإيثار هذا العمل وتمنيه من يوم رأى الغر سائق أحد الأعيان يتعرض للفتاة نبوية خادم المأمور فى الطريق ويغازلها بجسارة وثقة بل سمعه مرة يقول لها وهو يفرك يده حبورا: "سآتى معك قريبا ومعى الخاتم". ورأى الفتاة تبتسم فى دلال، وترفع طرف الملاءة عن رأسها، كأنها تسويها والحقيقة أنها أرادت أن تبدي عن شعرها الفاحم المدهون بالزيت.  
رأى ذلك فالتهب قلبه وأحسّ الغيرة تنهشه نهشا موجعا. وكان به من عينيها السوداوين أوجاع وأمراض. وكان يتبعها عن كثب، ويقطع عليها السبيل فى الذهاب والإياب، حتى إذا خلي بها فى عطفه، أعاد على أذنيها ما قال لها الغر: "سآتى قريبا ومعي الخاتم". ولكنها لوت عنه رأسها، وقطبت جبينها وقالت باحتقار: "هات لك قبقاب أحسن". فنظر إلى  قدميه الغليظتين، كأنهما بطنا بخفي جمل. وجلبابه القذر. وطاقيته المعفرة وقال: هذا سبب شقائى وأفول نجمى. ونفس على الغر عمله. وتمناه على أن آماله لم تقطعه عن مهنته. فثابر على كده قانعا من آماله بالأحلام. وقصد فى ذلك الأصيل إلى محطة الزقازيق، يحمل صندوقه، وينظر القادم. ونظر إلى  الأفق. فرأى القطار قادما من بعد، كأنه سحابة دخان. وما زال يدنو ويقترب، وتتميز أجزائه ويتصاعد ضجيجه حتى وقف على إفريز المحطة. وهرع جحشة إلى العبات المتراصة. فرأى لدهشته على الأبواب حراسا مسلحين ووجوها غريبة تطل من النوافذ بأعين ذاهلة منكسرة. فقيل لهم بأن هؤلاء الأسرى الإيطاليين، تساقطو بين يدى عدوهم بغير حساب. وأنهم يساقون اليوم إلى المعتقلات.
فوقف جحشة متحيرا يقلب عينيه فى الوجوه المغبرة. ثم أدركته الكآبة، لأنه أيقن أن تلك الوجوه الشاحبة الغارقة فى البؤس والفقر لن يكون فى وسعها إشباع نهمها من سجائره. ووجدهم يلتهمون صندوقه بشراهة جوع. فألقى عليهم نظرة سخط واحتقار. وهمّ أن يوليهم ظهره، ويعود من حيث أتى. ولكنه سمع صوتا يصيح به بالعربية بلهجة أفرنجية قائلا: "سجائر".
فحدجه بنظرة دهشة وريبة. ثم فرك سبابته بابهامه: أي نقود. ففهم الجندي وأومأ برأسه. فاقترب محاذرا ووقف على بعد لا تبلغه يد الجندي فخلع الجندي جاكتته بهدوء. وقال له وهو يلوح بها: هذه نقودي. فتعجب جحشة وتفرس فى الجاكتة الرمادية ذات الأزرار الصفراء بين الدهشة والطمع. ووجب قلبه، ولكنه لم يكن ساذجا أو مغفلا. فأخفى ما قام بنفسه أن يقع فريسه للايطإلى. وأبرز فى هدوء ظاهري علبة سجائر، ومدّ يديه ليأخذ الجاكتة. فقطب الجندي جبينه وصاح به: علبة واحدة بجاكتة؟ هات عشرا. فذعر جحشة وتراجع إلى  الوراء، وقد غاض طمعه وأوشك أن يأخذ فى غير السبيل، فصاح به الجندي: أعطنى عددا مناسبا تسعا أو ثمانية. فهز الشاب رأسه بعناد. فقال الجندي: إذن سبعا. ولكنه هزّ رأسه كما فعل فى الأولى، وتظاهر بأنه يعتزم المسير. فقنع الجندي بست، ثم هبط إلى  خمس. فلوح جحشة بيده متظاهرا باليأس وتراجع إلى المقعد وجلس. فصاح به الجندي المجنون: "تعال رضيت بأربع". فلم يلق له بالا، وليدله على عدم اكتراثه أنه أشعل سيجاره، ومضى يدخن فى تلذذ وهدوء. فثارت ثائرة الجندي وأهاجه الغضب وبدا، وكأنه ليس له غاية فى الوجود سوى الاستيلاء على سجائر، فهبط بطلبه إلى ثلاث، ثم اثنين. ولبث جحشة جالسا يغالب اضطرام عواطفه وأوجاع طمعه. ولما نزل الجندي إلى اثنتين، أبدى حركة بغير إرادة. رآها الجندي، فقال له وهو يمدّ يده بالجاكتة: "هات".
فلم ير بدا من النهوض، ودنا من القطار حتى أخذ الجاكتة. وأعطى الجندي العلبتين. وتفرس الجاكتة بعين جذلة راضية، وقد لاحت على شفتيه ابتسامة ظفر. ووضع الصندوق على المقعد. وارتدى الجاكتة، وزررها. فبدت فضفاضه، ولكنه لم يعن لذلك. وتاه عجبا وسرورا. واسترد صندوقه، وأخذ يقطع الإفريز فخزرا طروبا. وارتسمت لعينيه ورة نبوية فى ملاءتها اللفة. فقال متمتما: "لو ترانى الآن، نعم لن تتجافانى بعد اليوم، ولن تلوى وجهها عني احتقارا، ولن يجد الغر ما يفخر به علي". ولكنه ذكر أن الغر يرتدي بدلة كاملة، لا جاكتة مفردة. فكيف السبيل إلى  البنطلون؟ وفكر مليا، وألقى على رؤوس الأسرى المطلة من نوافذ القطار نظرة ذات معنى. ولعب الطمع بقلبه من جديد. فاضطربت نفسه بعد أن أوشكت أن تستقر. ودلف إلى  القطار ونادى بجرأه: "سجائر، سجائر، العلبة ببنطلون لمن ليس معه نقود. العلبة ببنطلون." وأعاد ندائه هذا مثنى وثلاثا. وخشى أن يغيب على الأفهام مقصده. فمضى يومىء إلى  الجاكتة التى يرتديها، ويلوح بعلبة سجائر. وأحدثت إيمائته الأثر المرجو. فلم يتردد جندي أن يهم بخلع جاكتته، ولكنه سارع نحوه وأومأ اليه أن يتمهل. ثم أشار إلى بنطلونه يعنى، أن ذلك بغيته. وهزّ الجندي منكبيه باستهانه. وخلع البنطلون. وتم التبادل. وقبضت يد جحشة على البنطلون بقوة، يكاد يطير من الفرح. وتقهقر إلى  مكانه الأول، وأخذ يرتدي البنطلون، وانتهى فى أقل من دقيقة. فصار جنديا إيطاليا كاملا، ترى هل ينقصه شىء، الموسف حقا أن هؤلاء الأسرى لا يغطون رأسهم بالطرابيش، ولكنهم يضعون أقدامهم فى أحذية. ولا غنى عن حذاء، ليتساوى بالغر الذى يكرب حياته. وحمل صندوقه وهرع إلى القطار وهو يصرخ: "سجائر، العلبة بحذاء، العلبة بحذاء". واستعان على التفاهم بالإشاره، كما فعل فى المرة الأولى. ولكنه قبل أن يظفر بزبون جديد آذنت صفارة القطار بالمسير، فتمخضت عن موجة نشاط، شمل الحراس جميعا. وكانت سحائب الظلام تغشي جوانب المحطة، وطائر الليل يحلق فى الفضاء. فتوقف جحشة وفى نفسه لوعة، وفى عينيه حسرة وغيظ. ولما أخذ القطار يتحرك لمحه حارس فى عربة أمامية. فبدا على وجهه الغضب وصاح بالإنجليزية ثم بالإيطالية: "اصعد بسرعة، أيها الأسير".
فلم يفهم جحشة ما يقول، وأراد أن ينفس عن صدره، فجعل يقلده فى حركاته مستهزءا مطمئنا إلى بعده عن متناول يديه. فصاح به الحارس مرة أخرى، والقطار يبتعد رويدا ورويدا: "اصعد، إنى أحذرك، اصعد".
فزم جحشة شفتيه احتقارا، وولاه ظهره، وهم بالمسير. فكور الحارس قبضة يسراه مهددا، وصو بندقيته نحو الشاب الغافل، وأطلق النار، ودوى عزيف الرصاصة يصم الآذان. واعقبتها صرخة ألم وفزع. وتصلب جسم جحشة فى مكانه. فسقط الصندوق من يده، وتناثرت علب السجائر والكبريت. ثم انقلب على وجهه جثة هامدة.

همس الجنون 157 – 162



8 comments:

  1. অসাধারণ...
    ধন্যবাদ অনুবাদক শায়েখ আঃ মাতিন সাহেব কে গল্পটিকে সহজ সরল ও প্রাঞ্জল মাতৃ ভাষায় আমাদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete
  2. Lot of thanks for beautiful transaltran

    ReplyDelete
  3. আল্ল-হ তায়া'লা তোমার হায়াত বৃদ্ধি করুন এবং এ ভাগা জাতির কল্যাণে তোমাকে সুস্থ সবল ও বলিষ্ঠ রাখুন। এ আমার আন্তরিক প্রার্থনা

    ReplyDelete
  4. ধন্যবাদ অনুবাদক আঃ মাতিন স্যার কে..

    ReplyDelete
  5. না।এভাবে শেষ হবে কেন! কেবল তো শুরু।ছোট গল্প বলেই কি এভাবে শেষ হতে হবে।

    ReplyDelete
  6. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  7. অসাধারণ! দক্ষ কলমের অনবদ্য অনুবাদ! মূল গল্পের সম্পূর্ণ রস-কষ সহ বঙ্গানুবাদটি যেন বাংলায় প্রাণ পেল! স্যার (ভালোবাসার দাদা) কে সেলাম!

    ReplyDelete