Monday 15 February 2016

আবুল আলা আল-মাআররী

আবুল্‌ আলা আল্‌-মার্‌রী   

(৯৭৩ ১০৫৭ খ্রী)

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

পরিচিতি ও জন্মঃ

আল্‌-মাআ’ররী আব্বাসী যুগের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আরবি সাহিত্যের সমৃদ্ধিকরণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মুতানাব্বীর পথ ধরে তিনিও সাহিত্য ও দর্শনকে একাত্ম করেছেন। প্রকৃত নাম আহ্‌মাদ, পিতার নাম ‘আব্দুল্লাহ, পিতামহের নাম সুলায়মান তানুখ গোত্রে মা’আর্‌রাতুন্‌ নু’মান নামক স্থানে জন্ম লাভ করায় আল্‌-মা’আর্‌রী ও আত্‌-তান্নুখী নামেও পরিচিত। তাঁর উপনাম আবুল্‌ ‘আলাআর এ নামেই তিনি অধিক প্রসিদ্ধ। এই দার্শনিক কবি মা’আর্‌রাতুন্‌ নু’মানে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৩৬৩ হিজরিতে এক উচ্চ শিক্ষিত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ মাআ’ররার বিচারক ছিলেন।


অন্ধত্বের শিকারঃ

কবি চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তাঁর বাম চোখটি নষ্ট হয়ে যায় এবং ডান চোখটি সাদা হয়ে যায়। তিনি নিজেই লাল রঙ ছাড়া অন্য কিছু চিনতে না পারাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন

"لا أعرف من اللون إلا الأحمر لأني البست في الجدري ثوبا مصبوغا بالعصفر"

তাঁর এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর বিদ্যার্জন ও খ্যাতি লাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।


শিক্ষালাভঃ

আরবি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা নিজ পিতার নিকট হতে প্রাপ্ত হন। তারপর দেশীয় বিভিন্ন শিক্ষমন্ডলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এমন সব জ্ঞান অর্জন করেন, যেগুলির মাধ্যমে পৃথিবীতে ইসলামের মর্যাদা বর্ধিত হয়। অতঃপর আলেপ্পো, ত্রিপলি এবং আন্তাকিয়াতে লেখাপড়া করেন। তারপর ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য সিরিয়া যাত্রা করেন। অতঃপর বাগদাদ গিয়ে গ্রীকদর্শন ও ভারতীয় দর্শন বিদ্যা অর্জন করেন।


শিক্ষকরূপে মাআ’ররীঃ

তিনি একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অসাধারণ শিক্ষা প্রদান নীতির কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্যার্থীরা তাঁর নিকট আসতো। তিনি তাঁদেরকে তত্ত্বগত ও পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন।


বৈরাগ্য জীবনঃ

তিনি বাগদাদে বিদ্যার্জনে রত ছিলেন, এমন সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। আর ঠিক এ সময়েই রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ তাঁর আকীদা ও কর্মে সন্দেহ পোষণ করতে আরম্ভ করেন। এ দু’য়ের কারণে তিনি বিষাদময় ও অস্থির হয়ে নিজেকে গৃহ বন্দী করে নেন এবং নিজেকে “রাহীনুল্‌ মাহ্‌বাসাইন” নামে আখ্যায়িত করেন।


রচনাসমূহঃ   

এ সময়ে তিনি জীবনের আনন্দ হতে বিমুখ হয়ে যান। মাংশ আহার করতেন না। বাচ্চা প্রসবকারিণী জীব হতে তৈরী কোন খাদ্য ভক্ষণ করতেন না। সবধরনের সুস্বাদু খাদ্য পরিহার করে শুধু ডাল ও ডুমুর ফল খেয়ে জীবন ধারন করতেন। তিনি মোটা কাপড় ও বিছানা ব্যবহার করতেন। আর নিজের ওপর বিবাহকে হারাম করে নিয়েছিলেন।


বৈরাগ্য জীবন গ্রহনের পর তিনি অধ্যয়ন ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি বহু পুস্তক রচনা করেন। তার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল— রিসালাতুল্‌ গুফ্‌রান, আল্‌-লুযূমিয়্যাত, সাক্‌তুয্‌ যান্‌দ ইত্যাদি।


জীবনদর্শনঃ

আল-মাআররী পান্ডিত্য, মৌলিক চিন্তাশীলতার উৎকর্ষ ও সৃষ্টিধর্মের ঐশ্বর্যে আধুনিক সমাজে প্রাচ্যর অন্যতম মহামনীষী ও যুক্তিবাদী-প্রগতিবাদী কবি হিসেবে স্বিকৃতি লাভ করেছেন তিনি তাঁর লুযুমিয়াত গ্রন্থে কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ, কালো পাথর চুম্বন, সাফা-মারওয়া পর্বর্তে দৌড়ানো, প্রস্তর নিক্ষেপ প্রভৃতি বর্ণনা করে হজ্জ করাটাকে একটা পৌত্তলিক ভ্রমন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি রোজ কেয়ামতেও বিশ্বাসী ছিলেন না। এবং মুত্যুতেই তার শেষ সমাপ্তি দেখে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের প্রতি আস্থাহীন হয়ে উঠেন। তার মতে ধর্ম হচ্ছে পুরাকালের রচনা-কাহিনী। যা ভন্ডরা কাজে লাগায় নিরীহ, নির্বোধ ও কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষকে ঠকাবার জন্য। লোকাচারের ইসলামও অন্য কোন ধর্মের চেয়ে ভালোও নয়, খারাপও নয়। তিনি তার রিসালাতুল গাফরান গ্রন্থে বেহেশতকে পৌত্তলিক যুগের কবি ও দার্শনিকদের প্রমোদগার হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এবং বলেছেন তারা সকলেই আল্লাহর রহমত লাভ করেছেন।

রিসালার দ্বিতীয় ভাগে যিন্দীক ও মুসলিম স্বাধীন চিন্তানায়কদের বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন এবং তাদের উদৃতি ও রচনার দ্বারা দেখিয়েছেন যে, তাদেরকে যেভাবে অধার্মিক হিসেবে চিত্রিত করা হয় তা সঠিকও নয় সত্যও নয়। সম্প্রতি পন্ডিতদের দ্বারা নি:সন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, তার রিসালা কবি দান্তের ডিভাইনিয়ার রচনায় নিশ্চিত প্রভাব বিস্তার করেছিল। ওমর খৈয়ামের উপরও তার প্রভাব বিদ্যমান।


অসিয়ত ও মৃত্যুঃ

মৃত্যুর পূর্বে তিনি জনসাধারণকে তাঁর কবরের নিকট নিম্নলিখিত কবিতার অংশটি লিখে দেওয়ার অসিয়ত করেছিলেনঃ

هذا ما جناه أبي عليّ     وما جنيت على أحد

(জন্ম দিয়ে পিতা আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। তবে আমি এ অপরাধ ও অন্যায় কারোর প্রতি করিনি।)


এই প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক, প্রখ্যাত জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও দার্শনিক কবি ১০৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৪৪৯ হিজরিতে নিজ জন্মভূমিতেই ইন্তেকাল করেন তিনি বহু জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। পৃথিবী ও তার ঐশ্বর্য হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে বিমুখ ছিলেন। তিনি মুতান্নাবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দর্শন ও কাব্যের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাব্য রচনা করে আরবী ভাষাকে অধিক সমৃদ্ধিতর করে তুলেছেন।

No comments:

Post a Comment